প্রশান্তির মনস্তত্ত্ব

খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ
Published : 18 Nov 2012, 05:57 AM
Updated : 18 Nov 2012, 05:57 AM

আপনি যদি এতই মেধাবী হন আপনার এতো এতো তারল্য সঙ্কট বা আর্থিক টানাপড়েন কেন ? প্রশ্নটি খুবই সাধারণ এবং সোজা-সরল মনে হয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত সচরাচর ধারণা হল মেধা ও জীবনের উন্নতি তো পরস্পরের হাত ধরেই চলে। হল্যান্ডে এ বিষয়ে পরিচালিত এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে মেধা বৈষয়িক উন্নতির বেলায় তেমন কোনো কাজেই আসে না বরং উল্টো কখনও পথরোধক হতে পারে। এ বিষয়ে নিজের এক গবেষণাপত্রে ডাচ প্রফেসর ব্রিঙ্ক প্রশ্ন তুলেছেন, তবে এই মেধা-মননের সুফলটাই বা কি যদি ভালো বেতন আর উচ্চপদে চাকুরি সত্ত্বেও একজন মেধাবী ব্যক্তি ঋণ-স্তুপের নিচে চাপা পড়ে থাকেন ? এ প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে তিনি একই বিষয়ে ব্রিটেনের কেন্দ্রীয় জরিপ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত একটি সার্ভে রিপোর্ট গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। এ জরিপে সাড়ে দশ হাজার টগবগে তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী গণ্যমান্য লোকজনের কাছে ২৫ টি প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয়েছে। এই জরিপের বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা থেকে তারা নিশ্চিত হয়েছেন, মানুষের আইকিউতে একটি স্কোর বৃদ্ধি মানে তার বার্ষিক আয় সাধারণভাবে ৩৪৪ ইউরো পর্যন্ত বেড়ে যাওয়া। বিষয়টার উদারহণ এভাবেও দেখানো যায়Ñ ১০০ আইকিউ-সম্পন্ন কোনো ব্যক্তির বার্ষিক ৬০ হাজার ইউরো হলে এ ফর্মুলা মতে ১২০ আইকিউধারী ব্যক্তির বার্ষিক আয় দাঁড়াবে ৮০ হাজার ইউরোর কাছাকাছি। অনুসন্ধান মাধ্যমে এটাও প্রতিভাত হয় যে, বেশি আইকিউ-সম্পন্ন ব্যক্তি বেশি আয় করেন বটে; কিন্তু খরচের পর সঞ্চয় রাখতে পারে না। ফলে কম আইকিউ'র লোক এবং তার মাঝে তেমন কোনো তফাৎ দেখা যায় না। জীবনযাপনসংক্রান্ত দুশ্চিন্তা দূর করার ক্ষেত্রে বেশি বুদ্ধি অকার্যকর বলা চলে। ১৪০ আইকিউধারী (সর্বোচ্চ মেধাবী) কম আইকিউসম্পন্ন (স্মর্তব যে, মধ্যম পর্যায়ের আইকিউ ১০০) লোকের চেয়ের ঋণের কিস্তিতে পরিশোধে পিছিয়ে থাকেন। এরূপ লোকের আর্থিক দেউলিয়াত্বের সূচক ১.১৫ যা ৮০ আইকিউ'র লোকদের বেলায় পরিলক্ষিত হয়। এখানেও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ৮০ আইকিউ মেধাহীন বলে পরিগণিত।

প্রফেসর ব্রিঙ্ক এর অনুসন্ধান মতে যাদের আইকিউ একশ'র চেয়ে সামান্য ওপরে তারা জীবনের প্রাত্যহিক সঙ্কট সহজে কাটিয়ে উটতে পারেন। তা সত্ত্বেও আল্লাহর পক্ষ থেকে কারো ভাগ্যে আইকিউ কম জুটলেও হীনন্মন্যতায় ভোগার কোনো দরকার নেই। কেননা অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানী নিজের গবেষণায় প্রমাণিত করেছেন যে, জীবনে সফলতা অর্জনর বেশি মেধার সঙ্গে শর্তযুক্ত নয়। তাই অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ব্যক্তিও সমাজে বিশেষ মর্যাদা অধিকার ও দৃষ্টিগ্রাহ্য অবস্থানে পৌঁছুতে পারেন। এ জন্য জনৈক অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানী বিশেষ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এক বিস্ময়কর টুপি তৈরি করতে যাচ্ছেন। এটা পরিধানকারীর সুপ্ত প্রতিভাগুলো প্রকাশ করবে। এতে এমন কিছু বৈদ্যুতি যন্ত্র স্থাপন করা হবে যা মস্তিষ্কের এক অংশকে নিষ্ক্রিয় এবং অপর অংশকে সক্রিয় করতে পারবে। ধারণা করা হচ্ছে এটুপি ব্যবহার করে মানুষ মেধাবী ও অনুসন্ধানে ব্যক্তিতে পরিণত হবে। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সিডনীর প্রফেসর ইলেন শানায়েড্রা ও তার এক সহযোগী টুপিটির ব্যাপারে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে প্রত্যেক প্রকারের প্রতিভা বিদ্যমান রয়েছে তা জাগ্রত ও সক্রিয় করার উপায় আমাদের জানা নেই। তিনি আরও বলেন, আমি আশা করছিÑ এই গবেষণার মাধ্যমে মানুষের মনের স্বরূপ, প্রকৃতি, গতি, কাঠামো ও চরিত্র সম্পর্কে সম্যক তথ্য লাভ করতে পারব।

উল্লেখ্য, মস্তিষ্কের বাম পাশ স্মৃতি, মুখসংশ্লিষ্ট বিষয় ও পর্যালোচনাকেন্দ্রিক ব্যাপারগুলো সম্পাদন করে। এখানে বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর ৯৫% মানুষের ক্ষেত্রে দুর্বল মেধাসম্পন্ন লোকেরা মেধাবীদের তুলনায় অর্থের শক্তিকে স্বীকার করেন এবং এই শক্তির ক্যারিশমাকে বেঘোরেই উপলব্ধি করে। আমরা লেখার শুরুতে তারল্যের কথা তুলেছিলাম। বিশ্বমন্দার ফলে মানুষের মনোরোগ বা ডিপ্রেশন বেড়ে যাওয়া থেকেও অর্থসম্পদের বিশেষ গুরুত্ব পরিষ্কার বুঝতে পারি। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের ফলে অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকা ব্যক্তির বেলায় মনস্তাত্ত্বিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার দিকেও দৃষ্টি ফেরানো যায়। বিশেষজ্ঞদের মতো জগতের অসন্তোষ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, খুনোখুনি ও নৈরাজ্যের পেছনে কোনো না কোনোভাবে অর্থের নেপথ্য সক্রিয়। অর্থ মানুষের মৌলিক প্রয়োজন না হলেও এর গুরুত্ব অস্বীকারেরও অবকাশ নেই। অনেকেই জীবনে অর্থকে খুব বেশি পাত্তা দিতে নারাজ কিন্তু পৃথিবীতে টিকে থাকতে ও সমাজে নিজের সম্ভ্রমপূর্ণ অবস্থানটা ধরে রাখতে এর অপরিহার্যতা স্বীকার করেন। বিশেষজ্ঞরা আরো দেখিয়েছেন যে, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ ইঁরষফ ঈযবসরংঃৎু- পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান ও ভ্রুণতত্ত্বের বিশ্লেষণ মতে পকেটে টাকা-পয়সার উপস্থিতি মানসিক প্রফুল্লতা ও সজীবতা আনে। মুড পরিবর্তন বিষয়ক এরূপ গবেষণাকর্মে দেখা গেছে এতে পুরুষের তুলনায় নারীরা প্রভাবিত হওয়ার হার ৭ ৯ গুণ বেশি। পকেটে পয়সা না থাকাটা পারিবারিক সমস্যাবলির অন্যতম বড় কারণ। কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা-পয়সার মাধ্যমে এমন বহু সমস্যা মিটমাট হয়ে যায় যা সাধারণ ঝগড়া-ঝাটি, মনোমালিন্য ও দূরত্ব এমনকি মারামারিরও কারণ হতে পারে। আপনি জানেন, আর্থিক অনটনে জর্জরিত নয় এমন সমাজ দীর্ঘদিন টিকে থাকে। অর্থকড়ি দিয়ে সুখশান্তি কেনা যায় না এটা ধ্র"ব সত্য বটে কিন্তু এমন উপকরণ তো কেনা যায় যা মনে প্রফুল্লতা ও স্থৈর্য নিয়ে আসে। খুশি, প্রফুল্লতাবোধ, স্বাচ্ছন্দ কিছু অনুভূতির নাম যা অনেকাংশে বিরাজিত পরিপার্শ্ব দ্বারা প্রভাবিত। আমার পর্যবেক্ষণে আপনি কতটুকু সুখী তার পরিমাপ এভাবেও করা যায় যে, আপনি কতটুকু সুস্থ। সুখের সূচক নির্ণয়ে প্রথম এবং বড় একটি শর্ত হল এ প্রশ্নটি যে, আপনি কি সুস্থ ? মানুষের সুস্থতা মানবিক সুখের প্রথম ধাপ। এরপরের প্রশ্ন হল আপনার কাছে অর্থসম্পদ কেমন রয়েছে। প্রশ্ন এটাও প্রাসঙ্গিক যে, এ অর্থ আপনি কীভাবে উপার্জন করেছেন কঠিন আয়াসে নাকি তা অনায়াসলব্ধ ? একটি ছোট্ট মুদ্রাও হাতে আসা আনন্দের কারণ হতে পারে কিন্তু কারুনের মতো বিশাল সম্পদের পাহাড়ও একজন সৎ, নীতিবান ও ধর্মনিষ্ঠ মানুষের জন্য স্রেফ মানসিক অসস্তি ছাড়া কিছু নয়। একজন মনোবিজ্ঞানী বলেন, মানসিকভাবে ভালো থাকার জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত আপনার অর্থকড়ির প্রয়োজন রয়েছে। যদি আপনার আয়-উপার্জন সেই সীমারেখার নিচে পড়ে থাকে তাহলে আপনি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে সমধিক স্বাচ্ছন্দ কিনতে পারেন। যদি আপনার উপার্জন প্রয়োজনের সূচক ছাড়িয়ে যায় তাহলে দিন দিন আপনার উপার্জনের ক্রবর্ধমান পরিমানের সঙ্গে সুখের অনুভুতিও হ্রাস পেতে থাকবে। একথা ভুলে যাবার সুযোগ নেই যে, পুঁজির স্তুফ গড়ে তোলা বা মজুদদারী সবসময়ই মন্দ ও নিন্দনীয়। কয়লা গরম হলে হাত পোড়ায় আর ঠাণ্ডা হলে হাতে মেখে দেয় কালি।

কোথাও একবার পড়েছিলাম, মানুষের জীবনে বড় দু'টি সম্পদ হল- জীবন ও জীবনের লক্ষ। জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছুতে স্নায়ুতৃপ্তির চেয়ে মনের প্রশান্তিটার মূল্য অনেক বেশি।