সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর বালু ও একটি দুর্লভ পুলিশ প্রতিবেদন

আসিফ কবীর
Published : 26 June 2021, 07:47 PM
Updated : 26 June 2021, 07:47 PM

২০০৪ সালের ২৭ জুন সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হুমায়ূন কবীর বালু বোমা হামলায় খুলনায় নিজ পত্রিকা অফিসের সামনে নিহত হন। সে সময়ে তিনি খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। এর আগেও ১৯৮৪ ও ১৯৯৮ সালে তিনি এ বিভাগীয় বৃহত্তম সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের খুলনা জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে খুলনায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলকদের অন্যতম ছিলেন। ২০০৯ সালে তাকে সরকার একুশে পদক দেয়।

তার আগের বছরই ২০০৮ সালে বালু হত্যা মামলার সব আসামীকে আদালতের রায়ে খালাস দেওয়া হয়। আদালত একই রায়ে তদন্তের দুর্বলতা, তথ্য-প্রমাণের ঘাটতি, সাক্ষ্য প্রদানের অপ্রতুলতা ইত্যাদির উল্লেখ করে রায়ের প্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করেন। ২০০৯ সালে একই ঘটনার বিস্ফোরক মামলাটি রায় ঘোষণার পূর্বমুহূর্তে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করে অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিতে ন্যস্ত করার আদেশ লাভ হয়। 

দীর্ঘ পুনর্তদন্ত শেষে চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হয়, পুনরায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি বিস্ফোরক আইনে করা মামলার আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেওয়া হয়।

হত্যা মামলায় সব আসামীর খালাস লাভ অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ছিল। মোটা দাগে এর প্রতিক্রিয়ায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকেই একরকম অস্বীকার করার নামান্তর বলে আপাত দৃষ্টিতে আমাদের অনুভূত হয়। যদিও আদালত রায়ে বিচারিক সীমাবদ্ধতার কথা ও দুর্বলতার কারণগুলি উল্লেখ করে। দ্বিতীয় বারের রায়ে কিছুটা স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। সাংবাদিকদের, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যারা এ পেশায় যুক্ত তাদের মধ্যেও একটি  অদৃশ্য সামাজিক নিরাপত্তা পাওয়ার বোধ তৈরি হয়েছে। মামলা নিয়ে এ পর্যন্ত অর্জনও সহজ ছিল না। এ পথ পরিক্রমায় পাশে থাকা সাংবাদিক সমাজ, আইনজ্ঞ, অধিকার কর্মী ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

১৯৭২ সালে আরও একবার হুমায়ূন কবীর বালুর জীবন বিপন্ন হতে বসেছিল। এ বিষয়ে স্বাধীনতা পদক ও পদ্মশ্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত বীর প্রতীক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির এর মাধ্যমে একটি গোয়েন্দা নথি হুমায়ূন কবীর বালুর পরিবারের হাতে আসে। 'ইনডেক্স টু দ্য বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাবসট্রাক্ট সাপলিমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স' শিরোনামে ওই রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে-

খুলনার ইকবাল নগর এলাকার [কাজী] শওকত আলী মামলাটির বাদী। হুমায়ূন কবীর বালু (বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা), বিবাদী (একজন ইউনিফর্ম অফিসার)-কে ধর্ষণ চেষ্টাকালে হাতেনাতে স্থানীয় আরো কয়েকজনের সহায়তা নিয়ে ইকবাল নগর এলাকায় ধরেন ও পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে বিবাদী জামিন লাভ করেন।

জামিনে মুক্তি পেয়ে বিবাদী কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ১৯৭২ সালের ৯ মার্চ রাত আনুমানিক ১২ টা ৪৫ মিনিটের (আগে-পরে) হুমায়ূন কবীর বালুকে তুলে নিয়ে যায়। এসময় ১৫, ইকবাল নগরস্থ তার পৈতৃক বাড়ি ভাঙচুর করে বিবাদী ও তার সঙ্গীরা। পরিবারের অভিযোগ পেয়ে পুলিশ তাঁর খোঁজ শুরু করে। পরদিন সকালে শহরের জোড়াগেট এলাকায় তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ছাত্র সমাজ ক্ষিপ্ত ও প্রতিবাদী হয়। তারা দোষীদের সকলকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি করে। একই সাথে 'বাংলাদেশ ফোর্স' এর শহরে অনুপ্রবেশ বন্ধের দাবি জানায়। 

(পয়লা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭২ এর ভলিউম ১ ভুক্ত ৪২ পাতার ৩২২ নম্বরে খুলনা উপশিরোনামে প্রতিবেদনটি বিবৃত হয়েছে। খুলনা পুলিশ স্টেশন কেইস ১২ নং ৫ মার্চ ১৯৭২-এ রেকর্ডকৃত।) 

জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘটনার পরপরই এ ব্যাপারে জানান খুলনায় বসবাসকারী তার ভাই শেখ আবু নাসের। ১৩ জানুয়ারি ২০২১ সালে খুলনা প্রেসক্লাবের নির্বাহী সদস্যরা এক সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে খুলনা দুই আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য সেখ সালাউদ্দীন জুয়েল তাদের এ কথা জানিয়েছিলেন।

জেনারেল এম এ জি ওসমানী ওয়্যারলেস মেসেজে হুমায়ূন কবীর বালুর সন্ধান পেতে বার্তা দেন। এ ঘটনার পর দীর্ঘদিন খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি থেকে তাকে চিকিৎসা নিতে হয়। তদানীন্তন কর্নেল আবুল মঞ্জুর ও মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া খুলনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে দেখতে আসেন।

১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পরিবর্তিত বাস্তবতায় এ ঘটনাটির রাজনীতিকীকরণের চেষ্টা হয়েছে। যথারীতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করা হয়েছে। এ দুর্লভ পুলিশি নথিটি হাতে পাওয়ার পর তৃতীয় একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। 

২০০৫ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলনের সময় সাউথ এশিয়ান ফ্রি মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন (​সাফমা) এর সদস্য দক্ষিণ এশীয় অনেক সাংবাদিক বাংলাদেশে আসেন। তাদের একটি দল খুলনায় আসেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খুব কাছাকাছি সংঘটিত সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান করতে। তাদের প্রশ্ন থেকে জানতে পারি তদানীন্তন জোট সরকারের পক্ষ থেকে (তাদের) বলা হয়েছে, ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন এ অঞ্চলে সাংবাদিকরা চোরাচালানে জড়িত ও তারই অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হচ্ছেন। এমন ডাহা মিথ্যা কথা খুব মর্মাহত করেছিল। এর অল্পদিন পরে একই বছরে ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় কনভেনশনে এর প্রতিবাদ জানানো হয়।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের ২৮ জুন হুমায়ূন কবীর বালু হত্যাকাণ্ডের পরদিনই বিশেষ প্রোগ্রামে খুলনায় আসেন। তখন তিনি বিরোধী দলের নেতা। তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন প্রায় ছয় মাস পূর্বে যখন তিনি সাংবাদিক মানিক সাহা নিহত হলে একইভাবে এসেছিলেন ও খুলনা প্রেসক্লাবে প্রতিবাদ সভায় যোগ দিয়েছিলেন তখন (সভার সভাপতি) হুমায়ূন কবীর বালু তার নিজের জীবননাশের আশঙ্কা প্রকাশ করে শেষবার দেখতে আসার অনুরোধ করেছিলেন। হায়! দেখা যায় প্রফেটিক কথার মত তা ফলে গেল। সেই অনুরোধ রক্ষার জন্যই বিরোধী দলের নেতার পক্ষ থেকে বার্তা পাঠিয়ে রাখা হয়, তার খুলনায় উপস্থিতির পরই যেন দাফন কার্যক্রম করা হয়। তিনি তখন এই হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। 

শেখ হাসিনা বলেছিলেন, রাজনৈতিক কারণে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়েই তালিকা করে সেসময়ে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী, সমর্থক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুবর্তী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হচ্ছে, আরও হবে। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ তেমনই ঘটেছিল। বালু হত্যাকাণ্ডটি যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড তারও প্রমাণ স্পষ্ট হতে থাকে। 

এ আকস্মিক হত্যাকাণ্ডে আমাদের পরিবারকে অসীম মানবিক সংকটে পড়তে হয়। জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে সুকঠিন বাস্তবতা মোকাবেলা করতে হয় আমাকে। যা মনে পড়লে এখন ভাবি তখন অতিক্রম করলেও দ্বিতীয়বার এ বৈতরণী পেরোতে দিলে একই ব্যক্তি হয়েও আমি আর কোনদিনই তা মোকাবেলা করতে পারবো না।