যুদ্ধাপরাধের বিচার ও আজকের বাংলাদেশ

আবু হানিফ ভুইয়া
Published : 24 May 2014, 03:15 PM
Updated : 24 May 2014, 03:15 PM

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সবাই কম বেশি উদ্বিঘ্ন ও আতঙ্কিত । প্রতিদিন গুম-খুন হচ্ছে মানুষ । নিরাপত্বাহীনতা আজ সবার মাঝে । কিন্তু কেন এই অবস্থার সৃষ্টি হল? বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করছে । আমি মনে করি দেশের এই সমস্যার মুলে রয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যু । যার শুরু ২০০৮ এর নির্বাচনের আগে থেকে । সেই নির্বাচন হয়েছিল পুর্ববর্তী নির্বাচন থেকে ৭ বছর পর । ফলে নতুন তরুণ ভোটারের সংখ্যা ছিল এক কোটির উপরে । যারা সেই নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে ভুমিকা রেখেছে । এই তরুণদের বেশিরভাগই ছিল কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা সদ্য পাশ করা ।যারা তাদের শিক্ষাজীবনে পড়াশোনার ফাকে যে সময়টুকু পায় তা খেলাদুলা করে, সিনেমা দেখে, তাস খেলে, বন্ধুদের সাথে গল্প করে পার করে দেয় ।বেশির ভাগ মেসে সাধারণত বিশেষ একটি জাতীয় পত্রিকা রাখা হয় । প্রতিদিন টেলিভিশনে খবর দেখার প্রবনতা খুব একটা দেখা যায় না । ফলে ইতিহাস বা দেশ-বিদেশের চলমান ঘটনা সম্পর্কে তারা খুব একটা সচেতন থাকে না । তাদের রাজনৈতিক জ্ঞানের মুল উৎস সেই বিশেষ পত্রিকাটি এবং পছন্দের দল ও দলীয় নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি । পত্রিকাটির লেখাকে তারা বেদ বাক্য বলে মনে করে কোন প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহন করে । যেহেতু তারা প্রাপ্ত তথ্যকে অন্য কোন মিডিয়ার সাথে ক্রস চেক করে না, সেহেতু তারা অনেক ভুল তথ্য ধারণ করে এবং তাদের চিন্তা-চেতনা সেই ভাবেই গড়ে্ উঠে । এই তরুণদেরকে একটি মহল নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ব্যবহার করেছিল ২০০৮ এর নির্বাচনে । এই কাজে তারা নিয়োজিত করেছিল বিভিন্ন কারনে তরুণদের মাঝে গ্রহনযোগ্যতা আছে এমন কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে । তারা তরুণদেরকে প্রভাবিত হরেছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে । সবাই আহ্ববান জানিয়েছিল একটি বিশেষ দলকে ভোট দিতে । এর মাধ্যমে তরুণ ভোটাররা তাদের জীবনের প্রথম ভোটটি ভুল পথে খরচ করেছিল । কারণ, নির্বাচনে কাকে ভোট দিতে হবে তা কেবল একটি বা দুইটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে না । কোন দল ক্ষমতায় গেলে দেশের পররাষ্ট্র নীতি কেমন হবে, অর্থনীতি কেমন হবে, আইনের শাসন কেমন হবে, বিচার বিভাগ কেমন হবে, শিক্ষা নীতি কেমন হবে ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে । কিন্তু তরুণ ভোটাররা এই মূল বিষয়গুলো চিন্তা না করে কিছু মানুষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শুধু মাত্র যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য একটি দলকে ভোট দিয়েছিল । সেই সাথে দেশি-বিদেশী আরো কিছু প্রচেষ্টা অবশ্যই ছিল । ফলে দলটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে সরকার ঘটন করে । শুরু হয় এক নতুন অধ্যায় । তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার । সেই লক্ষ্যে তারা কাজও শুরু করে । প্রথমত প্রতিবেশী একটি দেশের সমর্থন লাভের জন্য তাদের স্বার্থে একের পর এক দেশ বিরোধী সিদ্বান্ত নিতে থাকে । ফলে সেই দেশটি দলটিকে দীর্ঘদিন ক্ষতায় রাখার জন্য সব রকম সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয় । দ্বিতীয়ত তারা প্রতিপক্ষ দল-মতকে দমন করার জন্য উঠে পড়ে লাগে । বিরোধী দলের সব রকম রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে । তাদের মিটিং-মিছিল এমনকি মানব বন্ধনেও বাধা দেয় । কোন শ্রেণী-পেশার মানুষ যখনই কোন অধিকারের জন্য বা সরকারের কোন সিদ্বান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে তখনই তাদের কণ্ঠরোধ করার জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যটি তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে । যেমন, চট্রগ্রামে সিএনজি ধর্মঘট, সদরঘাটে লঞ্চ ধর্মঘট, রুপগঞ্জে সেনা আবাসনের বিরুদ্দে এলাকাবাসীর বিক্ষোভের সময় সরকার অভিযোগ করেছিল যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্থ করার জন্য এসব করা হচ্ছে । এভাবে সরকার এই ইস্যুটিকে কাছে লাগিয়ে প্রতিবাদী মানুষকে দমন করেছে দিনের পর দিন । বিক্ষুব্ধ মানুষকে দমন করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে । ফলে এই বাহিনীটি দিন দিন বেপরোয়া থেকে বেপরোয়া হয়েছে । রাজপথে গুলি করে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে । গুম করেছে অসংখ্য মানুষকে । জেলে আটক আছে হাজার হাজার বিরোধী দলীয় নেতা কর্মী । দলীয় অনুগত কর্মকর্তাদের বসানো হয়েছে গুরুত্বপুর্ন পদে । দলীয় ছাত্র সংগঠন থেকে শত শত কর্মীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বাহিনীতে । ফলে এই বাহিনীগুলো আজ ঘাতক বাহিনীতে পরিনত হয়েছে ।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিল শাহাবাগের তথাকথিত গনজাগরণ মঞ্ঝ । যেখানে ঢাকা শহরের মাদকাসক্ত, নারী খাদক, ভারতীয় দালাল, নাস্তিক, চাদাবাজ ও রাজনৈতিক জ্ঞানহীন কিছু তরুণ দেশের আইনকানুনের মুলে কালিমা লেপন করে সরকারকে প্রভাবিত করেছিল প্রহসনের বিচারকে আরো প্রহসনে পরিনত করতে । এই কাজের জন্য সরকার বিচার বিভাগে দলীয় অন্ধ লোকদের নিয়োগ দিয়ে দেশের বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছে ।যার খেসারত দিতে হবে জাতিকে আরো অনেক বছর । এদিকে শাহাবাগে নাস্তিকদের আস্ফালনের প্রতিবাদে গড়ে উঠে হেফাজতে ইসলাম । শাপলা চত্বরে রাতের আধারে তাদের উপর চালানো হয় ভয়াবহ গনহত্যা । ফলে দেশের লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে জমে আছে সরকারের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা ও ক্ষোভ ।

হেফাজত, জামাত, বিএনপি সহ সাধারন মানুষের এই বিক্ষুব্দ মনোভাবের কারনে সরকার বুঝতে পেরেছিল নির্বাচনে তাদের ভয়াবহ পরাজয় হবে । পরাজয়ের পর তাদের উপর নেমে আসবে করুন প্রতিশোধ । সেই প্রতিশোধের ভয়ে তারা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য একতরফা নির্বাচন করে পুনরায় সরকার গঠন করে । নির্বাচনের পর প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য শুরু হয় নতুন ফর্মুলা, গুম । শত শত মানুষকে গুম করে খুন করা হয় । এভাবে হয়তো চলবে আরো অনেক দিন । কেউ জানে না এর শেষ কোথায় । ক্ষমতা হারালে তাদের কঠিন প্রতিশোধের মুখোমুখী হতে হবে সেটা তার ভাল করেই জানে । তাই যেভাবেই হোক তারা ক্ষমতা আকড়ে থাকার চেষ্টা করবে শেষ বিন্দু পর্যন্ত । দেশের বুকে বইবে আরো অনেক রক্ত, নদীতে মিলবে আরো অনেক লাশ, খালি হবে আরো হাজারো মায়ের বুক, মজলুমের কান্নায় ভারি হবে আকাশ-বাতাস ।