যুদ্ধাপরাধের বিচার: কী পেলাম কী হারালাম

আবু হানিফ ভুইয়া
Published : 18 Jan 2012, 02:22 AM
Updated : 18 Jan 2012, 02:22 AM

যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি গত নির্বাচনে একটি টনিক হিসেবে কাজ করে । অনেকেই মনে করেন মহাজোটের মহা সংখ্যাঘরিস্ঠ আসনে জয় লাভের পিছনে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটি মুখ্য ভূমিকা রেখেছে । বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মেকে সবচেয়ে বেশি আলোরিত করেছে । সরকার ইতিমধ্যে ট্রাইবুনাল গঠন করে বিচার কাজ শুরু করেছে । বেশ কয়েক জনকে আটক করা হয়েছে । সামনে হয়তো আরো অনেকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে । বর্তমান সরকার ৩ বছর পার করেছ । এই ৩ বছরে সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা উভয় রয়েছে । যেহেতু বর্তমান সরকারের ক্ষমতার সাথে যুদ্ধপরাধ ইস্যু জরিত সেহেতু সরকারের প্রতিটি কর্মকান্ডই যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর সাথে সম্পর্কিত । চলুন দেখি যুদ্ধপরাধ ইস্যুতে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে গত ৩ বছরে কি পেলাম আর কি হারালাম ।

কী পেলাম?
জঙ্গীবাদ দমনে বর্তমান সরকার বেশ সফল । শিক্ষা ও কৃষি ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নতি বিদ্যমান ছিল । বিদ্যুত খাতে নতুন নতুন কিছু প্লান্ট স্থাপন করার ফলে সামনের দিনে এর সুফল পাওয়া যাবে । বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকরকে কেউ কেউ জাতির কলঙ্ক মুক্তির সাথে তুলনা করছেন এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের হত্যা কান্ড না ঘটে তার জন্য একটি শিক্ষা হয়ে থাকবে বলে অনেকে মনে করেন । ইহা ছাড়া তেমন কিছু পেয়েছি বলে মনে হয় না ।

কী হারালাম?
আগেই বলেছি বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় আরোহনের সাথে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু জরিত থাকায় সরকারের প্রতিটি কর্মই যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর সাথে সর্ম্পকিত । সরকারের প্রতিটি অপকর্মই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বদৌলতে হয়েছে বলে গন্য করা যেতে পারে । কারণ যুদ্ধপরাধ ইস্যু না থাকলে এই সরকার ক্ষমতায় আসতে পারত না, আর ক্ষমতায় না আসলে এই অপকর্মগুলোও করতে পারত না ।

যুদ্ধপরাধীরের বিচারের জন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল মিডিয়া । সরকার ইতিমধ্যে চ্যানেলই ওয়ান একং জনপ্রিয় অনলাইন শীর্ষনিউজ বন্ধ করে দিয়েছে । চ্যানেল ওয়ানের একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল নির্বাচিত খবর যা রাত ১১ টায় লাইভ প্রচার করা হত । অনুস্ঠানের উপস্থাপক (সম্ববত নাজমুল) কারণে অকারণে যুদ্ধপরাধ ইস্যুটি আলোচনায় নিয়ে আসতেন । চ্যানেল ওয়ান ও শীর্ষ নিউজের সেই সাংবাদিকরা আজ কোথায় ? তারা কি কখনও ভাবেন আলীগ ক্ষমতায় না এলে তাদের মিডিয়া বন্ধ হত না ? তাদের কর্মই তাদেরকে আজকে এখানে নিয়ে এসেছে ।

শেয়ারবাজারে আজ কয়েক লাখ লাখ বিনেয়োগকারী পুজি হারিয়ে পথে বসেছেন । দেশর ইতিহাসে দুইবার শেয়ারবাজারে ভয়াবহ পতন হল যার দুটিই আলীগের শাসনামলে । যারা শেয়ারবাজারে স্বর্বশান্ত হয়েছেন তারা কোন একটি দলের বা মতের লোক নন । এখানে সব দলের , সকল শ্রেণী পেশার মানুষ রয়েছেন যাদের অনেকেই যুদ্ধপরাধ ইস্যু বা অন্য কারণে এই সরকারকে ভোট দিয়ে ক্ষমাতায় এনেছেন । তাদের সেই ভূলের খেসারত দিতে দিতে আজ তারা দিশেহারা । তাদের বুক ফাটা আর্তনাত আমরা আজ শুনতে পাই । ইতিমধ্যে ২/৩ জন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা করেছেন ।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশী শ্রমিক নেওয়া হ্রাস পেতে থাকে । বর্তমানে মুললিম দেশগুলোতে বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ বললেই চলে । ফলে দেশে বেকারত্বের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে, বেড়েছে অপরাধ, কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ, বেড়েছে মুল্যস্ফিতি । ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের লাখ লাখ সাধারণ মানুষ । উপরন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকে দেশে ফিরে এসেছেন খালী হাতে । এই মানুষগুলো অনেক আশা নিয়ে, জায়গা-জমি বিক্রি করে বিদেশে গিয়েছিল জীবনের চাকা ঘুরাতে । যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে ব্যাবহার করে যদি আলীগ ক্ষমতায় না আসত তাহলে লাখ লাখ শ্রমিক বিদেশে যেতে পারত। হাসি ফুটত কোটি কোটি মানুষের মূখে, সচল থাকত দেশের অর্থনীতি।

রেমিটেন্স প্রবাহ কমতে থাকায় দেশের অর্থনীতি আজ অচল প্রায় । সরকারের ভারত তোষণ পররাষ্ট্র নীতির ফলে দাতা দেশগুলো আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে । ডলারের দাম ৮৮ টাকায় পৌছেছে । প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে আজ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে । মূল্যস্ফিতিতে মানুষ আজ দিশেহারা । অর্থের অভাবে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে । বেহাল দশা হয়েছে দেশের রাস্তা-ঘাটের । বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় মূত্যুর সংখ্যা । অনেকেই বলবেন এসবের সাথে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের সম্পর্ক কি? সম্পর্ক হচ্ছে সরকারের সাথে । আর সরকারের ক্ষমতা লাভের সাথে সম্পর্ক হচ্ছে যুদ্ধপরাধ ইস্যুর । যদি আলীগ ক্ষমাতায় না আসত তাহলে দাতা গোষ্টি সহ বহি:বিশ্ব আজ মূখ ফিরিয়ে নিত না । দেশে আজ ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটও দেখা দিত না ।

অনেকে বলেন জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য দেশ বিদেশে লবিং করছে । কথাটা মিথ্যে নয় । নিজকে বাচাতে কে না চেস্টা করে । লবিং করতে জামায়াত শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছে যা এই দেশের টাকা, আমাদের টাকা । অর্থাৎ শত শত কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে । যুদ্ধপরাধীদের বিচার না হলে এই দেশেই থাকত । দেশের কোন প্রতিষ্ঠানে যেমন ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইবনে সিনা , ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, স্কুল, কলেজ ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করত । একথা কেউই বলবে না যে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান থেকে শুধুমাত্র জামায়াত শিবিরের লোকজনই সেবা নিয়ে থাকেন । দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষই এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা পেয়ে থাকেন । এসব খাতে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হলে আমরা আরো উন্নত সেবা পেতে পারতাম। যেই সেবা থেকে আমরাই আমাদেরকে বঞ্চিত করেছি ।

কেউ কেউ বলেন এর ফলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, জাতি কলংক মুক্ত হবে । বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের সময়ও একই কথা বলা হয়েছিল । শেষ পর্যন্ত সেই বিচার হল, রায় কার্যকর হল । কিন্তু দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি ? নাটোরের একটি হত্যা মামলায় ফাসির আদেশ পাওয়া ২২ জনকে রাষ্ট্রপতি মাফ করে দিলেন । উপজেলা চেয়ারম্যান বালু হত্যা মামলায় কারো কিছু হলো না । জয়নাল হাজারী ২২ টি মামলায় খালাস পেলেন । এগুলো কি আইনের শাসনের উদাহরণ ? লিমনের ঘটনা, সাভারে ৬ ছাত্রের নির্মম হত্যাকান্ড, ঢাবি ছাত্রকে থানার ওসি কর্তিক চাপাতি দিয়ে কোপানো ইত্যাদিতে কি জাতির গায়ে কলংক লাগেনি ? তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে কোন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে ? কোন কলংক লাগব হবে ?

আলীগ সরকার বরাবরের মত এবারও রাজনীতিতে কিছু নতুন মাত্রা যোগ করেছে । যেমন বিরোধী দলকে মাঠে নামতে না দেওয়া, হরতালে ভ্রাম্যমান আদালতের ব্যবহার, রাজনীতিবিদদের ডান্ডাবেড়ি পরানো ইত্যাদি । সরকারের এসব কর্মে সরকার সমর্থক কেউ কেউ খুশি হলেও ভবিষ্যতে তাদের উপরই এগুলো প্রয়োগ করা হতে পারে । সুস্থ রাজনীতির যে দাবি আমরা করি তাকে আরো দুরহ করে তুলেছে সরকারের নতুন যোগ করা এসব অপকৌশল । ভ্রাম্যমান আদালত এবং ডান্ডাবেড়ি থিউরি যেটা সরকার চালু করেছে সেটা সহজে বন্ধ হবে বলে মনে হয় না ।

প্রতিহিংসার রাজনীতির ষোলকলা পূর্ণ করেছে বর্তমান সরকার গত ৩ বছরে । প্রথম কাজটি করেছে খালেদা জিয়াকে ৪০ বছর ধরে বাস করে আসা বাড়ি থেকে বিতারিত করে । ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি যে ঘটবে না সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না । যুদ্ধপরাধ ইস্যুটিও এক প্রকার প্রতিহিংসার বহি:প্রকাশ । জামায়াতের যেসব নেতাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে তারা আজকে জাতীয় নেতা হলেও ১৯৭১ সালে একমাত্র গোলাম আজম ছাড়া কেউই জাতীয় নেতা ছিলেন না । উদাহরণ সরূপ মাওলানা সাঈদীর কথা বলা যেতে পারে । তিনি সরকারের কোন সদস্য ছিলেন না, কোন নেতাও ছিলেন না । প্রসিকিউশন তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছে তাতে বলা হয়েছে যুদ্ধের পূর্বে তিনি দোকনদারী করতেন । একজন দোকানদার সাধারন অপরাধী হতে পারে কিন্তু কখনও যুদ্ধাপরাধী হয় না । যেই ৯৩ হাজার পাকি সেনা অস্র হাতে যুদ্ধ করেছে তাদের সবাইকে কি যুদ্ধপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল ? ৯৩ হাজাররে মধ্যে কেবল মাত্র ১৯৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল । অপরাধ আর যুদ্ধাপরাধ এক জিনিস নয় । স্বধীনতার পর বিচারের জন্য ২ টি আইন করা হয়েছিল । একটি দালাল আইন অপরটি যুদ্ধপরাধ আইন । দালাল আইন করা হয়েছিল এদেশীয় রাজাকার, আলবদর যারা পাকিদের সাহায্য করেছে তাদের বিচারের জন্য । এই আইনের আওতায় ১১ হাজার জনের বিচারও করা হয়েছিল । ১৯৫ জন পাকি যুদ্ধপরাধীর বিচারের জন্য করা হয়েছিল যুদ্ধপরাধ আইন । যা দিয়ে বর্তমানে জামায়াত নেতাদের বিচার করা হচ্ছে । অর্থৎ আপনি একটি বড় ছুরি বানালেন গরু জবাই করার জন্য আর একটি ছোট চাকু মুরগীর জন্য । এখন গরু না পেয়ে গরু জবাইয়ের বড় ছুরি দিয়ে মুরগী জবাই করতে যাচ্ছেন । এই অবিচারের মাধ্যমে যদি জামায়াত নেতাদেরকে সাজা দেওয়া হয় তাহলে দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে । সামনে বিএনপি জোট ক্ষমাতায় গেলে আলীগের যেসব নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যেমন খন্দকার মোশারফ হোসেন, কাজী জাফর উল্লাহ, আশিকুর রহমান তাদেরও একই ভাগ্য বরন করতে হবে । ফলে সুস্থ রাজনীতির পরিবর্তে আইন দিয়ে বিরোধী দলকে দমনের রাজনীতি দেশে শুরু হবে । যা দেশকে সামনে নয় পিছনে নিয়ে যাবে ।