আমার প্রথম স্কুল

sanjida_khatun
Published : 20 Dec 2013, 02:23 PM
Updated : 20 Dec 2013, 02:23 PM

লীলা নাগ (রায়)দের 'নারীশিক্ষামন্দির' আমার প্রথম স্কুল। আমার মা মনে করতেন ছেলেমেয়েদের যত উঁচু ক্লাসে ভর্তি করা যাবে ততই ভালো। তাই আমাকে একবারেই দেওয়া হলো ক্লাস টু-তে। অন্যদের চেয়ে ছোট যেমন, তেমনি বড়ই হাবাগোবা ছিলাম। একদিন দিদিমনি সবাইকে ডেকে বললেন 'এবারে ঘুমের ক্লাস হবে। সবাই পাঁচমিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে। চটপট শুয়ে পড়ো।' অন্যেরা হাসাহাসি করতে থাকলেও, আমি পরম নিষ্ঠার সঙ্গে চোখ বুঁজে থেকে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লাম। সে কী গভীর ঘুম!

দীর্ঘ সময় পরে ঘুম ভাঙলে দেখি অন্যেরা শোরগোল করে মহা আনন্দে খেলার ক্লাস করছে, ঘুমের ক্লাসের সময় শেষ হয়ে গেছে ততক্ষণে। অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসলাম। ক্লাসের মেয়েরা আমার কা- দেখে মুখ টিপে হাসতে লাগল। খেলার ক্লাসে আমাকে সঙ্গে নিল না ওরা।

নারী শিক্ষামন্দির স্কুলের দেয়ালে কী একটা লতায় হালকা গোলাপী রঙের ফুল ফুটত। নাম জানতে পারিনি কখনো। সামনের দিকের বাগানটার সাজসজ্জা ছিল না, কিন্তু ভারি সবুজ ছিল। একটা চওড়া কুয়ার ওপর জাল দেওয়া। আর তাতেও একটা লতাতে ঘন বেগুনি নানান রঙের ফুল ফুটত। কী তার গন্ধ! পরে জেনেছিলাম ওটাই ঝুমকো লতার ফুল। বড় হয়ে জেনেছি, ইংরেজিতে ওকে বলে প্যাশন ফ্লাওয়ার। এ ফুলের মোহ আমার আজও কাটেনি, কাটবে না কোনেদিন! একবার ছোট বোন লীনু (ফাহমিদা) ময়মনসিংহ থেকে আমাকে একটা চারা এনে দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্ল্যাটের ড্রেন ঘেঁষে লাগিয়েছিলাম। পাড়ার ছেলেরা রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে গিয়ে প্রায়ই ওটাকে উপড়ে ফেলত। আমি ছুটে গিয়ে আবার লাগিয়ে দিতাম। ছেলেদেরকে অনুরোধ করতাম– যেন ওটাকে বাঁচিয়ে ক্রিকেট খেলে। খেলার দলে পার্থ (আমার পুত্র)ও থাকত। ওকেও বলতাম সবাইকে সাবধান করতে। ওদের এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল, ওটা কি আঙুর গাছ? তা, পাতাগুলো দেখতে আঙুরের পাতার মতোই। আমার উদ্বেগ দেখে ওদের মনে হতো দামি ফলের গাছই হবে। না হলে, একটা ফুল গাছের জন্যে অত কেন? সুগন্ধী ফুলে আমার আকর্ষণ বরাবরের।

একবার আমার এক শিক্ষক পাশের বাড়ি থেকে একটি সাদা কাঁচের প্লেটে খবরের কাগজ জড়িয়ে আমাকে কোরবানির গোশ্ত পাঠিয়েছিলেন। প্লেটটি ধুইয়ে, তাতে গোল করে ঝুমকো ফুল সাজিয়ে পাঠিয়েছিলাম তাঁকে। উনি ফোন করে বলেছিলেন–'বা, বেশ তো!' যদিও তিনি একজন কট্টরপন্থি গোঁড়া মনের মানুষ। স্কুলের সামনের দিকটাতে ভিতর দিকের রাস্তার একধারে সরু লম্বা কাণ্ডের একরকম গাছের সারি ছিল। সবাই ওগুলোকে বিলেতি সুপারির গাছ বলত। সবুজ খোলসের ছোট ছোট ফল ঝরে পড়লে দাঁত দিয়ে খোসা কেটে খেয়ে দেখেছি কষ্টাটে স্বাদের একরকমের সুপারিই বটে।

নারী শিক্ষামন্দিরে আমার আর এক আকর্ষণ ছিল পিছনদিককার বড় বড় গাছ, রহস্যে ঘেরা। সামনের একটা আমগাছে দোলনা বাঁধা ছিল। টিফিনের সময় ঘন্টা পড়লেই ছুট লাগিয়ে দোলনা দখল করা হতো। ভাগ্যক্রমে একবার আমিই ছুট্টে গিয়ে দোলনা ধরেছিলাম। তা হলে কি হবে, বড় মেয়েরা আমাকে ঠেলে সরিয়ে দোলনায় উঠে দুলতে লাগল। চোখ ফেটে জল এলেই বা কার কী।

স্কুলের ঘোড়ার গাড়িতে আমার সেকেন্ড ট্রিপে ফিরবার কথা সেবার। ভাবলাম এখন তো কেউ নেই, দোলনায় চড়ি গিয়ে। গাছপালার ছায়ায় আবছা অন্ধকার হয়ে আছে। দোল দেবার কেউ নেই, পা দিয়ে মাটিতে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে দোল খাওয়া শুরু হলো। তারপর দোলনায় দাঁড়িয়ে উঠে পায়ের কায়দায় দুলেদুলে বেশ ওপর পর্যন্ত উঠে দুলতে গিয়ে দেখি–নারিন্দার বাঁদরগুলো এসে আমাকে একা দেখে বেশ ঘেঁষে আসছে। ভয়ে ভেতরটা ছমছম করতে লাগল। এমন সময়ে শুনি ফার্স্ট ট্রিপে নামিয়ে দিয়ে এসে স্কুলের দাই আমাকে ডাকছে জোরে জোরে। দোলনার গতি রোধ করা কঠিন। খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে দাই অবাক হয়ে বলে– 'আঁয় হাঁয়, কী সহৎ (সাহস) মাইয়ার।' দোলনা ধরে ফেলে আমাকে নামিয়ে বকতে বকতে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলল।

নারীশিক্ষামন্দিরের মন উচাটন করা এক ব্যাপার ছিল সেসব দিনে। সেলাইয়ের গিরিবালাদির তত্ত্বাবধানে দুপুরের টিফিন তৈরি হতো। কখনো তেকোনা নিমকি, কখনো চিনির রসে ডুবানো জিভেগজা কিংবা আউলাঝাউলা। আঃ কী তার ঘ্রাণ ছুটত! লোভী চোখে তাকিয়ে অপেক্ষা করতাম কখন আমার পালা আসবে। রোল নম্বর ডেকে ডেকে খাবার দেওয়া হতো একে একে। খাবার আনবার জন্যে ঝকঝকে করে মাজা বড় সসপ্যান চোখে ভাসে এখনো।

সরস্বতী পূজার পরের দিন স্কুলের ভিতরেই পিকনিক হয়েছিল একবার। রান্নার ধারে কাছে যাব কী! মুসলমান মেয়ের ছোঁয়া নিয়ে ভয় আছে না! সে সময়ে ক্লাসে আর কোনো মুসলমান ছিল না। কিন্তু কী আশ্চর্য, শিক্ষকরা আমাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকলেন। 'এসো এদিকে, বেগুন ভাজা করো।' ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। বেশ বড়ো গোল করে কাটা বেগুন ভাজা হচ্ছিল চাটুতে। আমার হাতে খুন্তি ধরিয়ে দিয়ে দিদিমনি বললেন–'নাও, সাবধানে বেগুন উলটে দাও।' আমি অ্যাটেনশান হয়ে দাঁড়িয়ে একটা টুকরো কোনো মতে উলটে দিলাম। দিদিরা হেসে কুটিকুটি –'দ্যাখো দ্যাখো, কী রকম হাঁটু না–ভেঙে খাড়া দাঁড়িয়ে বেগুন উলটাচ্ছে।' অবাক হয়েছিলাম– কই, আমার ছোঁয়াতে তো কোনো অসুবিধা হেলো না! মনটা বড়ো হলো।

এদিকে বাড়ি থেকেও বারবার সাবধান করে দেওয়া হতো– ওদের কোনো কিছু ছোঁবে না, আর খবরদার পূজার নৈবেদ্য খাবে না। বাধাঁবাঁধি ছিল উভয়পক্ষে।

শিক্ষামন্দিরের আর একটি অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে সকলে মিলিত হয়ে শোক প্রকাশ। উঁচু ক্লাশের এক দিদি কাঁদতে কাঁদতে গেয়েছিলেন–'মরণের সুখে রেখে দূরে যাও, দূরে যাও চলে'। কান্নাকাটি কিসের তা বুঝতে পারিনি, বরং তারপরে ছুটি হয়ে যাওয়াতে খুশিই হয়েছিলাম। নিতান্তই বালিকা তো তখন!

ওই সমাবেশ যে লম্বা শেডটিতে হয়েছিল সেখানেই আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্লাস হতো। সে-ক্লাসে একবার এক আশ্চর্য দিদিমনি এসেছিলেন। সুন্দর করে সুকুমার রায়ের 'সৎপাত্র' পড়ে শুনিয়েছিলেন। শুনেই প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল সে-কবিতা। তার পরে কত অপেক্ষা করে থেকেছি। তিনি আর আসেননি কখনো।

নারী শিক্ষামন্দিরে গান শেখাতেন মনোরঞ্জন স্যার। 'ফাগুনের রঙে রঙে' ছাড়া আরো কিছু গান শিখেছিলাম। সত্যেন দত্তের 'মধুর চেয়ে আছে মধুর, সে এই আমার দেশের মাটি' গানের খানিকটাও শেখা হয়েছিল। বছর শেষে পরীক্ষার পরে ক্লাস ফ্লাস বন্ধ থাকতো। বার্ষিক অনুষ্ঠানের মহড়াতেই মন দিতেন সকল শিক্ষক। আমি আর আমার দুবছরের বড়ো বোন রীণা মগ্ন হয়ে মহড়া দেখতাম। মনোরঞ্জন স্যার ভালো সেতারও বাজাতেন, ছাত্রীদের সেতারও শেখাতেন। কলকাতা রেডিওতে সেতার বাজাতেন বলেও শুনেছি। স্কুলের অনুষ্ঠানের জন্যে কয়েকটি মেয়েকে সেতারের একটি গৎ তুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই গৎ-এর সঙ্গে নাচের মহড়া হলো যেদিন, সেদিন আমরা একেবারে মোহিত হয়ে গেলাম। কয়েকটি সেতার একসঙ্গে বাজলে যে মধুর ঝংকার সৃষ্টি হয়, তার সঙ্গে আবার নাচ! অমরাপুরীর দুয়ার খুলে গেল আমাদের সামনে!

আমার শৈশবের এই বিদ্যাপীঠের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মান বেশ উঁচু ছিল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে পরে (১৯৪৯) ওই স্কুলে রবীন্দ্রনাথের 'মালিনী' হবে শুনে সেজদি আর আমি গিয়েছিলাম দেখতে। স্কুলে ঢুকবার পরেই সেই যে বাগান-মতো সবুজ জায়গাটা ছিল, সেইখানে দক্ষিণ দিকের দেয়াল ঘেঁষে উত্তরমুখী মঞ্চ তৈরি হয়েছিল। তার এপাশে চেয়ার পেতে দর্শকদের বসবার ব্যবস্থা। মুগ্ধ হয়ে সুপ্রিয়, মালিনী আর দৃপ্ত ক্ষেমংকরের কাব্যনাট্য দেখলাম। শুনলাম। ফিরবার পথে সেজদি আর আমি প্রায় স্তব্ধ ছিলাম। অন্তরে এতই আলোড়িত হয়েছি। এ স্কুলের স্মৃতি ভুলতে পারি না।
(চলবে)