ভাষানীতি: বাংলা একাডেমির ভূমিকা

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 19 Oct 2011, 06:36 PM
Updated : 14 Jan 2017, 12:52 PM

বাংলা ভাষা আজ অনেক পর্যায়ে অবহেলার শিকার হয়ে যেন কাতরাচ্ছে! এই ভাষার সহযোগী না হয়ে আগের চেয়ে রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারালয় ও ব্যক্তি দূরবর্তী অবস্থানে চলে যাচ্ছে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের ভাষার যে মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা বাঙালির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এখন আর মিলছে না। বাস্তবে বাংলা ভাষার জন্য সুখবর কমে যাচ্ছে; কখনও কখনও খানিকটা আশার ঝলকানি দেখা দেওয়ার পরও তা বেশি সময় ধরে আলো ছড়ায়নি!

বাংলাদেশের সংবিধানের মোট চারটি স্থানে ভাষা প্রসঙ্গটি উল্লেখিত হলেও ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:

"প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।"

আর ২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:

"রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।"

সংবিধানে বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার দিকনির্দেশনা থাকলেও চার দশক পার হওয়ার পরও বাংলা দাপ্তরিকসহ রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে আবশ্যিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে না! এই সময়ে এসেও দেখা যায় সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, নামফলক, দেওয়াল লিখন হচ্ছে ইংরেজিতে। সরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন বিলের ভাষা বাংলা নয়, ইংরেজি। গণমাধ্যমের বিভিন্ন পর্যায়েও বাংলা ভাষার করুণ পরিস্থিতি। ঘরে ও বাইরে অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে বাংলা ভাষার আলোটুকু গ্রাস করার জন্য!

আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে গিয়ে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করার জন্য বলেছেন, অথচ তাঁর সরকারের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা এখন কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে, তা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। শুধু দাপ্তরিক কাজে নয়, আইন-আদালতসহ প্রায় সর্বস্তরে আজ বাংলা ভাষার ব্যবহার কমছে, ইংরেজির ব্যবহার বাড়ছে।

আমরা ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবে নিজেদের অহং প্রকাশে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎপর হলেও বাংলা ভাষার বিকাশে তৎপর কতটুকু, তা বিবেচনায় আনা উচিত। ভাষা ব্যবহারের জন্য হঠাৎ হঠাৎ নেওয়া কিছু পদক্ষেপ ও ঘোষণা এসেছে, কিন্তু একটি 'জাতীয় ভাষানীতি' আমরা ভাষা আন্দোলনের ৬১ বছর পার হওয়ার পরও প্রণয়ন করতে পারিনি! এর ফলে বাংলা ভাষা নিয়ে বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে; বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অরাজক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আমাদের দেশে শিক্ষানীতি, কৃষিনীতি, খাদ্যনীতি, ক্রীড়ানীতি এবং আরও কত নীতি আছে, কিন্তু ভাষানীতি নেই! একটি ভাষানীতি থাকলে শিক্ষার মাধ্যম কী হবে, প্রশাসনের ভাষা কী হবে, বানানরীতি কী হবে, আদিবাসীদের ভাষা কী পর্যায়ে থাকবে, ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষার অবস্থান কী হবে, কম্পিউটারে ভাষার পরিস্থিতি কী হবে, পরিভাষা কী হবে, রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা কী হবে– এগুলো নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনা থাকত। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই সংশ্লিষ্ট কারোর!

ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর ভাষানীতি আমারা বিবেচনায় নিতে পারি। তারা তো জাতীয় ভাষা ত্যাগ করে ইংরেজি গ্রহণ করছে না। আমরা এসব দেশের কথা বাদই দিলাম, পাশের দেশ নেপালের কথাই বলি। সে দেশেও একটি 'ভাষানীতি' আছে, তারা উচ্চ আদালতে মাতৃভাষা ব্যবহারে সক্ষম হয়েছে, অথচ আমরা এখনও আমাদের উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছি না।

সরকারের দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, একটি হল 'বাংলা একাডেমি', আরেকটি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট'। এ দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা প্রচলনে কতটুকু জোরালো ভূমিকা পালন করছে, তা মূল্যায়ন করা জরুরি। এদের ওপর যে অর্পিত দায়িত্ব রয়েছে, সে বিষয়ে তারা কতটুকু ভূমিকা পালন করছে? বাংলা একাডেমির কথাই ধরি– তারা কি ভাষানীতি প্রণয়নে কোনো ভূমিকা গ্রহণ করেছে? কিংবা বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে? বা সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছে? না, এ রকম কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না!

এমনিতে বাংলা ভাষা বিভিন্ন চাপ ও প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে, সেখানে বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানকে সবসময় সচেতন থাকতেই হবে। বাংলা একাডেমির অন্যতম দায়িত্ব যা তাদেরই দলিলে উল্লেখ করা আছে:

ক. জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও প্রসার ঘটানো এবং

খ. জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও সকল স্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করার উদেশ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ।

বাংলা একাডেমি আয়তনে বেড়েছে, পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে তারা আদর্শ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে! মনে হয়, বাংলা একাডেমি পরিণত হয়েছে 'ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট' প্রতিষ্ঠানে; নিত্যনৈমিত্যিক নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনে ব্যতিব্যস্ত! এর বেশিরভাগ বিভিন্ন ক্ষমতাধর ব্যক্তির তুষ্টির জন্য হয়ে থাকে! অন্যদিকে যেসব কাজ 'শিল্পকলা একাডেমী' বা 'জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র' করতে পারে, সেগুলোও বাংলা একাডেমি করছে।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেক বিশিষ্টজন যেভাবে বাংলা একাডেমি চেয়েছিলেন, সেভাবে গড়ে ওঠেনি। স্বাধীন ও শক্তিশালী বাংলা একাডেমি হিসেবে তার পথচলা সুসংহত না করে ক্ষমতাধর ও কিছু ব্যক্তির উদ্দেশ্য পূরণে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কোনোক্রমে মানা যায় না। এ কালে আগের চেয়ে সংগঠন-সংস্থা সংকীর্ণভাবে ব্যক্তির ইচ্ছে বা স্বার্থ পূরণে ব্যবহার হয়ে থাকে বেশি!

বাংলা একাডেমিতে একেবারে কিছুই হয় না, তা হয়তো বলা যাবে না। তবে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে তাদের আদর্শের জায়গা থেকে দূরে সরে গিয়ে অনেকাংশে ব্যর্থ হচ্ছে। এ জন্য বাংলা একাডেমির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে সমতা রেখে কতটুকু কাজ করা হচ্ছে তার মূল্যায়নের জন্য উচ্চতর মূল্যায়ন কমিটি বা কমিশন গঠন করা হোক। শুধু অর্থ-নিরীক্ষা করে লাভ নেই, সামগ্রিক কাজের মূল্যায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা চাই না কিছু লোকের স্বার্থ পূরণের 'লীলাভূমি'-তে পরিণত হোক বাংলা একাডেমি। অন্যান্য দেশের মতো সর্বস্তরে আপন ভাষা প্রচলনে বাংলা একাডেমি প্রধান ও একনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করুক– আমাদের এই চাওয়া স্বাভাবিক।

ভাষা ও শিক্ষা একে অপরের পরিপূরক শুধু নয়, একটি জাতির বিকাশে সজীব পথ নির্মাণে ভূমিকা রাখে। আমরা লক্ষ করছি, শিক্ষাকে আজ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে লাগামহীন ঘোড়ায় পরিণত করে। আর এ ঘোড়ায় চড়ে শিশুরা কোথায় যাচ্ছে? মুনাফালোভী কায়েমী স্বার্থবাদীদের আওতায় নানামুখী ও ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা-পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন পরিধিতে, বিভিন্নভাবে। প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষাকে গুরুত্বহীন করে কোথাও কোথাও ইংরেজি ও আরবি ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। নানা রকমের প্রাথমিক শিক্ষাকে বাণিজ্য ভেবে বাজারজাত করা হচ্ছে।

'ইংরেজি মাধ্যম', 'কিন্ডার গার্টেন', 'প্রি-ক্যাডেট মাদ্রাসা' নামের তথাকথিত প্রাথমিক শিক্ষালয় নগরে-শহরে-বন্দরে ব্যবসায়ী মনোবৃত্তিতে গড়ে উঠেছে, যার বেশির ভাগই প্রাথমিক শিক্ষার মূল দর্শন থেকে বহু দূরবর্তী অবস্থানে রয়েছে। এসব শিক্ষালয়ের পাঠ্যসূচির কোনো সামঞ্জস্য নেই, নেই শিশু মনস্তত্ত্বের প্রতি লক্ষ রেখে শিক্ষা কার্যক্রম। এসব তথাকথিত শিক্ষালয়ে বাংলা ভাষাকে অনেকাংশে অবজ্ঞা আর অবহেলায় টেনে নিয়ে এক কোণায় রাখা হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এক উদ্ভট পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর জন্য দায়ী আমাদের অবৈজ্ঞানিক এবং অযৌক্তিক মন-মানসিকতা।

প্রাথমিক স্তরে একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। প্রায় সব দেশে প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় বা একমাত্র ভাষার মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত, বিশেষত ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানিতে প্রাথমিক স্তরে প্রথম ভাষা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় না। অথচ আমাদের দেশে ভাষা বিষয়ে বিভিন্নমুখী বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বাংলা ভাষাকে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত না করার মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি।

শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভাষা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি বারবার পরিবর্তনের ফলে জনসাধারণের মধ্যেও এ বিষয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষাকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। এ এক বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতি; এ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা।

বাংলা ভাষার শক্তি অনেক উন্নত ভাষার চেয়েও বেশি। কিন্তু তা আমরা ভুলে যাই! আরও ভুলে যাই যে বাংলা ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের বাঙালিত্ব, জাতীয় সত্তা, মুক্তিযুদ্ধের দর্শনগত অবস্থান ও ভাষা আন্দোলনের অঙ্গীকার। আমরা শুধু আমাদের অতীত গৌরবের স্মৃতি কাতরতায় চঞ্চল না হয়ে বর্তমান সময়ের নিরিখে বাংলা ভাষার কী অবস্থা, তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী, তা-ও ভাবা উচিত।

আমাদের একটি ভাষানীতি এবং বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলন করার জন্য আরও একটি জোরালো আন্দোলন কি জরুরি হয়ে ওঠেনি?