সম্পাদক পদের অপব্যবহার, অবমাননা, অসম্মান

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 13 June 2011, 02:58 PM
Updated : 21 Oct 2014, 08:09 PM

'বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম'এ গত ২৩ সেপ্টেম্বর "'মাফকিলাব'এর সাম্প্রদায়িক সাংবাদিকতা অব্যাহত আছে, অব্যাহত আছে মাফপ্রার্থনাও" শিরোনামের লেখাটিতে ইনকিলাব, বাস্তবে 'মাফকিলাব' নামের বাংলাদেশের তাবৎ মৌলবাদী এবং জঙ্গীদের সবচাইতে ভয়ঙ্কর প্রচারযন্ত্রটি ১৯৮৫তে তার অপজন্মের পর থেকে কতবার ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে তার একটি অসম্পূর্ণ তালিকা দিয়েছিলাম। এই সিরিজে ইনকিলাবী দুর্বৃত্তদের সরদার-ইন-চিফ বাহাউদ্দিনের গত ২৪ আগস্ট 'মাফকিলাব'এর প্রথম পৃষ্ঠায় 'দুঃখ প্রকাশ ও ১৮ আগস্ট ইনকিলাবে প্রকাশিত সংবাদটি প্রত্যাহার' শিরোনামের আবর্জনাটির কথাও উল্লেখ করেছিলাম এবং বলেছিলাম, এটি এই সরদারের সর্বসাম্প্রতিক মাফপ্রার্থনা, তবে সর্বশেষ মাফপ্রার্থনা নয়। লক্ষ্য করছি, 'মাফকিলাব' তারপর থেকে এখনও লালকার্ড পাওয়ার মতো আর কোনো 'ফাউল' করেনি।

তবে সাংঘাতিক ফাউল করেছে 'সম্পাদক' নামের বাস্তবে এক সন্ত্রাসী। এই সন্ত্রাসী সরদারের পক্ষে ক্ষমাপ্রার্থনা করছে আজ বৃহষ্পতিবার দৈনিক 'বাংলাদেশ প্রতিদিন' পত্রিকাটির তৃতীয় পৃষ্ঠায় ঢাউস সাইজের এক বিজ্ঞাপনে "দৈনিক বর্তমানের সাংবাদিক কর্মকর্তা ও কর্মচারিবৃন্দ।" এই সন্ত্রাসী সরদারের নাম আলহাজ্ব মিজানুর রহমান। আধা পৃষ্ঠার এই বিজ্ঞাপনটির শিরোনাম হচ্ছে, "মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা, আলহাজ্ব মিজানুর রহমানের মুক্তির আকুল আবেদন।"

চৌদ্দ-পনের অনুচ্ছেদের এই বিজ্ঞাপনটির শেষ প্যারাগ্রাফটি এমন:

মহানুভব মহামান্য রাষ্ট্রপতি,

প্রায় পাঁচশত সাংবাদিক-কর্মচারি, ডেভেলপার কোম্পানি এবং সরকারি প্রথম শ্রেণির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারির চাকরির নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে দৈনিক বর্তমানের সম্পাদক ও প্রকাশক, ডেভেলপার কোম্পানি এম আর ট্রেডিংএর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান এবং মদিনা প্রপার্টিজ রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব মিজানুর রহমানের নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মুক্তি দেওয়ার আকুল আবেদন জানাচ্ছি।

লক্ষ্য করুন, এই আলহাজ্ব মিজানুর রহমানের একই অঙ্গে কত রূপ! তিনি–

১. সম্পাদক;

২. প্রকাশক;

৩. ডেভলপার কোম্পানি এমআর ট্রেডিংএর চেয়ারম্যান;

৪. এই ডেভলপার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক;

৫. সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কর্মাস ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান;

৬. মদিনা প্রপার্টির রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান

এবং

৭. এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার একটি মেডিকেল কলেজও আছে। তিনি একজন ঠিকাদারও।

তার এত কিছু আছে; তবে নেই একটি টিভি চ্যানেল এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়। তাহলে একজন লুটেরার সংজ্ঞা সম্পূর্ণ হত।

আমার কাছে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখের 'দৈনিক বর্তমান'এর সে কপিটি আছে যেটিতে পত্রিকাটির তখনকার সম্পাদক এবং সাবেক ইত্তেফাক সম্পাদক রাহাত খানকে আলহাজ্ব সন্ত্রাসী সরদারকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানানোর ছবিটি প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে; তাতে মনে হয় আলহাজ্ব মিজানুর রহমানের বয়স চল্লিশের আশেপাশেই হবে। এই বয়সেই তার এতসব অর্জন, সাফল্য!!

তাকে রাহাত খানের ফুল দেওয়ার উপলক্ষটা ছিল আলহাজ্ব মিজানের বাংলাদেশের ৬৪ জেলার একটি ছোট জেলা, বরগুনার সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া। এখানে প্রাসঙ্গিকভাাবে আরও উল্লেখ্য যে, 'বাংলাদেশ প্রতিদিন'এ আজ প্রকাশিত বিশাল বিজ্ঞাপনটিতেও এই আলহাজ্বের বরগুনা জেলায় পর পর ৫ বার সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার 'কৃতিত্ব'ও কালো 'বোল্ড' হরফেই উল্লেখ করা হয়েছে।

ইনকিলাবীদের সঙ্গে এই আলহাজ্ব মিজানুর রহমানের সন্ত্রাসীদের মিল শুধু যে তারা মাফ চায়, তা নয়। তাদের মধ্যে আরও বড় একটি মিল হচ্ছে– ইনকিলাবীরা তাদের অপতৎপরতা চালাচ্ছে বঙ্গভবনের দক্ষিণ পাশে অফিস স্থাপন করে। আর এই আলহাজ্ব তার সব সন্ত্রাস চালাতেন বঙ্গভবনের উত্তর পাশে দিলখুশায়, বেআইনি এবং অবৈধভাবে নির্মিত সানমুন স্টার টাওয়ার থেকে। এই সন্ত্রাসী সরদার বঙ্গভবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে ২৩ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিয়ে ৩০ তলা টাওয়ার নির্মাণ করে ফেলেছিল!!

২.

সরদার আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মাস চারেক হল কারাগারে আছেন। আইন লঙ্ঘন করে টাওয়ার নির্মাণ করেছেন, সেজন্যই কিন্তু তিনি জেল খাটছেন না, অস্ত্র আইনেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তার কাছে কিছু বেআইনি, অবৈধ অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল বলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল, এই মর্মে তখন খবর পড়েছিলাম।

এই পর্যায়ে গত ২৪ সেপ্টেম্বর 'দৈনিক প্রথম আলো' প্রথম পৃষ্ঠায় তিন কলামের যে খবরটি ছাপে তার শিরোনাম ছিল, ''দুর্নীতির প্রতীক সানমুন টাওয়ার, পাঁচটি ফ্লোর নিয়ন্ত্রণে নিতে সিটি কর্পোরেশনের অভিযান।'' চারদিন পর, গত ২৮ সেপ্টেম্বর এই একই 'দৈনিক প্রথম আলো' এই আলহাজ্ব সন্ত্রাসী সরদারের উপর দুই কলামের আর একটি 'ফলো-আপ' স্টোরিও করে; শিরোনাম, ''মুন গ্রুপকে উদার হস্তে ঋণ দিয়েছে ব্যাংক, অনুমোদনহীন ভবনে সহযোগিতা দিতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ ব্যাংকও''।

আমার প্রবল ইচ্ছে হচ্ছে, 'প্রথম আলো'র দুটো রিপোর্টই পুরো তুলে দিই। তা তো আর সম্ভব নয়। কিন্তু মূল কথা হল, দিলখুশায় যে জায়গাটিতে এই লোক এত উঁচু একটি ভবন বানিয়ে ফেলল, এই জমিটি কিন্তু তার নয়। এই জমির মূল মালিক ছিল বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন। খালি এই জমিটি পাট মন্ত্রণালয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তর করেছিল। সাদেক হোসেন খোকা যখন ঢাকার মেয়র, তখন এই মিজানুর রহমান মেয়র খোকাকে ম্যানেজ করে জয়েন্ট পার্টনারশিপ ভিত্তিতে ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর সিটি কর্পোরেশন নিজ খরচে ভবনটির পাঁচটি তলাও নির্মাণ করে। কিন্তু এই দখলদার মিজানুর রহমান এই পাঁচ তলার মালিকানাও নিজের দাবি করে এখানে বছর দেড়েক আগে 'বর্তমান' নামের একটি দৈনিক পত্রিকা চালু করে।

এই লোকের বোধহয় এই হিসাব ছিল, মসজিদ যেমন সাধারণত উচ্ছেদ করা যায় না, তেমনি পত্রিকা অফিস খুললে, সেখান থেকে তাকেও উচ্ছেদ করা যাবে না। সঙ্গে যদি রাহাত খানের মতো লোককে সম্পাদক বা উপদেষ্টা সম্পাদক বানানো যায়, তাহলে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের টাকায় নির্মিত ঐ পাঁচতলাও তার হয়ে যাবে।

'বাংলাদেশ প্রতিদিন'এর এই বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে '''দৈনিক বর্তমান'এর সাংবাদিক কর্মকর্তা ও কর্মচারিবৃন্দ" এর নামে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আলহাজ্ব জেলে আছেন বলে সাংবাদিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করা যাচ্ছে না, তাদের ঈদ বোনাসও দেওয়া যায়নি। তাহলে প্রশ্ন করতেই হয়, আলহাজ্ব যখন জেলের বাইরে ছিলেন, তিনি যখন মাসের পর মাস যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে পালিয়ে থেকেছেন, তখন কি সাংবাদিকরা বেতন ভাতা বোনাস নিয়মিত পেয়েছেন?

শুরুতে রাহাত খানকে মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকা বেতনে ভাড়া করা হল কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মাথায় তা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হল কেন? তারপর ৮ মাসের মাথায় 'দৈনিক বর্তমান' থেকে তাঁকে বেরও করে দেওয়া হল কেন? তখন যে সাংবাদিকদের নিয়ে পত্রিকাটি শুরু হয়েছিল, তাদের কয়জন এখন সেখানে আছেন? আলহাজ্ব মিজানুর রহমান যখন জেলে যান, তখন কয়জন সাংবাদিক কর্মরত ছিলেন? কতজনকে তিনি জেলে যাওয়ার আগে বরখাস্ত করেছিলেন, তাড়িয়েছিলেন? তোশারফ আলী, সন্তোষ শর্মা, দুলাল আচার্য, কবি নাসির আহমেদ, আহমেদ দীপু এবং এহ্সানুর কবীর এরা কি এখন 'দৈনিক বর্তমান'এ আছেন?

সম্পাদক হওয়ার জন্য পনের বছরের ওয়ার্কিং জানালিস্টের অভিজ্ঞতার কিছুই তো মিজানুর রহমানের ছিল না। তারপরও মালিকসূত্রে সম্পাদকের পদ দখল করে এই বান্দা এইসব দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ সাংবাদিকের চাকরি খায়।

আলহাজ্ব মিজানুর রহমান অগ্রণী ব্যাংক থেকে অসততা করে ২৩৮ কোটি টাকা লোন নিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে কি সাংবাদিকদের বেতন ভাতা দেওয়া যেত না?

৩.

এই পর্যায়ে এই লুণ্ঠনকারী আলহাজ্ব মিজানুর রহমানের আরও কিছু ঔদ্ধত্যের বর্ণনা নিচের উদ্ধৃতিতে দেখতে পাঠকদের অনুরোধ করি। এটি 'দৈনিক প্রথম আলো'এর ২৮ সেপ্টেম্বরের ''মুন গ্রুপকে উদার হস্তে ঋণ দিয়েছে ব্যাংক'' শিরোনামের খবরটি থেকে নিয়েছি।

''অভিনব আবদার:

বিপুল পরিমাণ ঋণ পাওয়ার পর মুন গ্রুপ অগ্রণী ব্যাংকের কাছে অভিনব এক আবেদনপত্র পাঠিয়ে বলেছে, ২০২১ সালের আগে তারা কোনো টাকা পরিশোধ করতে পারবে না। তবে ২০২১ সালের পর ১২ বছরে ত্রৈমাসিক কিস্তিতে সুদাসলে সব টাকা পরিশোধ করতে পারবে। এ জন্য সময় দিতে হবে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত। অগ্রণী ব্যাংক ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময় দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিন বছর সময় দিলে অগ্রণী ব্যাংক তা পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কল্যাণপুরের ভবন তৈরির জন্য ঋণ নিতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে মুন গ্রুপ। ভবনটির ভূমির পরিমাণ ৫২ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২২,৬৭২ বর্গফুট। কিন্তু ঋণ প্রস্তাবে ২২,৫০০ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এটি অবাস্তব প্রস্তাব। এছাড়া টাকা বের করে নেওয়ার কৌশল হিসেবে ভবনটির নির্মাণব্যয় ২৭০ কোটি টাকা এবং কয়েকটি ফ্লোরের প্রাক্কলিত বিক্রয়মূল্য প্রতি বর্গফুট ১৫ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।

গতকাল শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাঠামো তৈরি হওয়া ২০ তলা ভবনটির গায়ে 'মিজানুর রহমান মেডিকেল কলেজ' (প্রস্তাবিত) নামে একটি সাইনবোর্ড। পাশেই একই গ্রুপের 'রাজিয়া টাওয়ার' নামে আরেকটি ২০ তলা ভবন। এতে ফ্ল্যাট রয়েছে ১৬০টি। স্থানীয়রা জানান, ভবনের সামনের গলির নাম 'রাজিয়া সড়ক' রেখেছেন মিজানুর রহমান নিজেই। অগ্রণী ব্যাংকের কাছে এটিও বন্ধক রাখা হয়েছে। মিরপুর ভূমি কার্যালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে, 'রাজিয়া টাওয়ার' সরকারি জমিতে তৈরি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সানমুন স্টার ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধে ২০১১ সালেই নোটিশ দিয়েছিল রাজউক। তারপরও গ্রুপটিকে ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। এছাড়া গ্রুপের অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে গ্রুপের মালিক মিজানুর রহমান বিধিবহির্ভূতভাবে তার ব্যক্তিগত হিসাবে সরিয়েছেন।

এদিকে, পুলিশের কাছে মিজানুর রহমান ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, নামে-বেনামে মিলিয়ে তার নেওয়া ঋণ ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।''

এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গত ২৯ সেপ্টেম্বরও এই একই দৈনিক 'বাংলাদেশ প্রতিদিন'এ এই লুটেরাদের প্রথম বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই বিজ্ঞাপনটির শিরোনাম ছিল, "সানমুন স্টার টাওয়ারের ৩০ তলা ভবনের অনুমোদিত নকশা থাকা সত্ত্বেও ২৩ তলা বলে সম্প্রচার চালানোর প্রতিবাদ।" এটি দেওয়া হয়েছিল এম আর ট্রেডিং কোংএর পক্ষে। আবারও বলি, যেমনটি বলেছি এই লেখার শুরুতে, এমআর ট্রেডিং কোম্পানিরও চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডাইরেক্টর একই ব্যক্তি– একই লুটেরা, সন্ত্রাসী মিজানুর রহমান! মাত্র ১৮ দিন আগে এমন কঠোর ভাষার প্রতিবাদ, আর আজ বৃহষ্পতিবার আলহাজ্ব লুণ্ঠনকারীর লোকদের এমন আত্মসমর্পণ!!

এই টেকনিকটা বোধহয় এরা শিখেছে ইনকিলাবীদের কাছ থেকে। ইনকিলাবীদের সরদার বাহাউদ্দিনও ২১ আগস্ট "কেন এই প্রলয়কাণ্ড" শিরোনামে পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রলয় জোয়ারদারের বিরুদ্ধে হুমকি হুঙ্কার দিয়ে, মাত্র তিন দিন পর প্রলয় জোয়ারদারের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে, 'মাফকিলাব' তখন মাফ চায়, খবরটি প্রত্যাহারও করে নেয়।

২৪ সেপ্টেম্বর 'দৈনিক প্রথম আলো'এর ''দুর্নীতির প্রতীক সানমুন টাওয়ার" শিরোনামের খবরটির শেষ দুটি প্যারাগ্রাফ সন্ত্রাসী মিজানুর রহমানের যথাযথ, প্রকৃত চরিত্র বর্ণনায় এখানে উদ্ধৃত করতেই হয়:

''ভবনটির দোতলায় মিজানুর রহমানের মালিকানাধীন একটি দৈনিক পত্রিকার কার্যালয়। গতকাল এই কার্যালয়টি ১৭ তলায় সরিয়ে নেওয়া হয়। কয়েকটি ফ্লোর ভাড়া হয়ে গেছে।

নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান পুলিশি হেফাজতে থাকায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান 'প্রথম আলো'কে বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সহিংস ঘটনায় হওয়া দুই মামলায় মিজানুর রহমানকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এই দুই মামলায় তাঁকে সাত দিন ও ছয় দিন করে দুই দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়। এখন তৃতীয় দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। দুটি মামলার তদন্ত করছে ডিবি।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিজানুর রহমান তাঁর নির্মাণাধীন ভবনের একটি ফ্লোর হেফাজতে ইসলামকে লাঠিসোটা রাখার জন্য ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। তিনি হেফাজতের ৩০ হাজার কর্মীকে ওই ফ্লোরে রেখে তাদের নাশতা করিয়েছেন।''

হেফাজতে ইসলামীর হেফাজত করেছেন আলহাজ্জ্ব মিজানুর রহমান। তারপরও তার মুক্তি প্রার্থনা করে বিজ্ঞাপন! তাহলে সব সম্ভবের বাংলাদেশে সবই সম্ভব!

৪.

'বাংলাদেশ প্রতিদিন'এ প্রকাশিত বিজ্ঞাপন দুটি কয়েকবার পড়ে দেখলাম, হেফাজতে ইসলামের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে, সন্ত্রাসী মিজানুর রহমানের জড়িত থাকার পুলিশী অভিযোগ সম্পর্কে কোনো প্রতিবাদ বা বক্তব্য নেই।

তারপর, এই সানমুন টাওয়ারের জমিটা এই ভূমিদস্যু কীভাবে দখল করলেন, কী তরিকা তিনি সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে অনুসরণ করলেন, তার কোনো বয়ানও আলহাজ্বের পক্ষে দেওয়া বিজ্ঞাপন দুটির কোথাও নেই।!! ধাপ্পাবাজ, ধোঁকাবাজ, প্রতারক আর কারে কয়!!

বরং গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, এই আলহাজ্বের সঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগে সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগপত্র অনুমোদন করেছে। তো, এহেন সন্ত্রাসী, লুণ্ঠনকারী, ভূমিদস্যু দুর্নীতিবাজকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কি মাফ করে ছেড়ে দেবেন? সাংবাদিকরা আবেদন করেছেন বলেই মাফ করে দিতে হবে? তারপর, এরা কোন ধরনের সাংবাদিক? নাকি মালিক মিজানুর রহমানের লাঠিয়াল?

তবে আলহামদুলিল্লাহ, 'দৈনিক সমকাল'এর সম্পাদক জনাব গোলাম সরোয়ার 'সম্পাদক পরিষদের সভাপতি' হিসেবে এখনও আলহাজ্ব মিজানুর রহমানের মুক্তি দাবি করেননি; যেমনটি তিনি/তারা করেছিলেন গত বছর, 'দৈনিক আমার দেশ'এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং গত মাসে 'মাফকিলাব'এর বার্তা সম্পদাক রবিউল্লাহ রবির পক্ষে। প্রথম দুজন এখনও জেলে আছেন। আলহাজ্জ্বের জন্যও জেল হচ্ছে যথার্থ জায়গা।

জনাব গোলাম সরোয়ারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, সম্পাদক পদটির যেমন অপব্যবহার, অবমাননা চলছে এই বাংলাদেশে, দয়া করে তা লক্ষ্য করুন। এমন অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দয়া করে কিছু বিহিত করুন। টাকা থাকলে, বাংলাদেশ কি যে কেউ পত্রিকা খুলে সম্পাদক হয়ে যাবে আর এই পদটির অবমাননা করতে থাকবে? দয়া করে মনে রাখুন, মাহমুদুর রহমান, বাহাউদ্দিন, মিজানুর রহমান, এরা সকলেই একই গোত্রভুক্ত, মিথ্যার ব্যবসা করে সম্পাদক পদবিটির অপব্যবহার, অবমাননা করছেন।

দয়া করে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এই অপব্যবহার বন্ধ করুন। দুনিয়ার আর কোনো দেশে এমন অপব্যবহার নেই।

'শিউলীতলা', উত্তরা; বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৪


মহিউদ্দিন আহমদ:
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক; শৌখিন মিডিয়া মনিটর।