আসুন ভাষার মাস হিসেবে ‘ফাল্গুন’ এর রব তুলি

হাসান মাহামুদ
Published : 1 Feb 2017, 02:29 AM
Updated : 1 Feb 2017, 02:29 AM

ভাষা আন্দোলন নিয়ে কোনো নিবন্ধ চোখে পড়লেই আমাদের সর্বপ্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগে- এখন কী ফেব্রুয়ারি মাস? বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন, শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথা বলা যাবে, সম্পাদকীয় লেখা যাবে, কিংবা মতামত, ফিচার, নিবন্ধ এসব। ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রসঙ্গভাবনা বা অবতারণাকে আমরা এতটাই 'মৌসুমী বিষয়' বানিয়ে ফেলেছি। কথাটি ইংরেজিতে বললে খুব পরিচিত মনে হবে, তা হলো ভাষাকেন্দ্রিক লেখা বা ভাবনা যেন 'সিজনাল আইটেম'।  এই নিবন্ধটিও মৌসুমী লেখা হিসেবে দুষ্ট এক দৃষ্টিকোণে। তবে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, দুষ্ট হওয়ার সীমাটা কিছু হলেও কমবে বলে আশা করছি।

১৩৫৮ বাংলা সনটি আমাদের ক'জনের কাছে পরিচিত, তা জরিপ করেও বের করা যাবে কিনা সন্দেহ!  বাঙালি ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এবং স্মৃতিময় দিনটি হচ্ছে ১৩৫৮ বাংলা সনের ৮ ফাল্গুন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ১৯৫২ সাল বললে আমরা যে কেউ বলে দিতে পারি, এটি ভাষা আন্দোলনের বছর। বাংলার জন্য আন্দোলন করে, আমরা আঁকড়ে ধরেছি ইংরেজিকে। এটি সত্যি হাস্যকর।  বাস্তবতা হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের বড় ট্র্যাজেডি ফাল্গুনের পরাজয়।

ভাষা আন্দোলন বিষয়ক প্রথম চিরায়ত উপন্যাসটির নাম 'আরেক ফাল্গুন'। ৩৫ পৃষ্ঠার বইটিতে জহির রায়হান তুলে ধরেছিলেন ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকে। কিন্তু মোটামুটিভাবে অনেক ভেবেও ফাল্গুনকে জড়িয়ে ভাষা আন্দোলন সর্ম্পকিত অন্য কোনো ঘটনা গ্রন্থ বা সৃষ্টিকর্মের নাম পাওয়া যায় না। আমাদর ভাষা আন্দোলন আর বিজয়ের ঘটনাটি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, ইংরেজি দিয়ে মোড়ানো হয়ে গেছে।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম গান লিখেন আবদুল গাফফার চৌধুরী- 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।' গানটিতে প্রথমে সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ। পরে করাচী থেকে ঢাকা ফিরে ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ আবার নতুন করে সুরারোপ করেন। সেই থেকে গানটি একুশের প্রভাতফেরীর গান হয়ে যায়। বর্তমানে এই গানটিই ভাষা আন্দোলনের অন্যতম এবং প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। গানটি নিয়ে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বক্তব্য হচ্ছে- ফাল্গুন দিয়ে কী আমরা একটাও গান করতে পারতাম না? ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে 'ফাল্গুন' উল্লেখ করে ভাষা আন্দোলন নিয়ে দুয়েকটি গান হয়তো রয়েছে, কিন্তু ওসব গানেরও মূল উচ্চারণ কিন্তু 'একুশ'।  অর্থাৎ ইংরেজি মাস ফেব্রুয়ারিকেই নির্ণয় করে।

ভাষা আন্দোলনের কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। কিন্তু বাংলা একাডেমিও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ইংরেজি মাস ফেব্রুয়ারিকে বেছে নিয়েছে।

গত বছর (২০১৬ সাল)  ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, 'আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত যে ভাষা সেটাকেই পর্যায়ক্রমে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষার স্বকীয়তাও রক্ষা করতে হবে।'

প্রধানমন্ত্রীর কথার সাথে তাল রেখে বলা যায়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ভাষাই আমাদের আয়ত্বে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু তাই বলে, মাতৃভাষাকে অধঃপতনে ঠেলে দেওয়া যায় না। আমরা মাতৃভাষার কতটা স্বকীয়তা রাখছি, তা সত্যিই এখন ভাবনার বিষয়। একটি দেশের সংস্কৃতি যখন আক্রান্ত হয়, তখন ভাষাও কলুষিত হয়। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে আমাদের স্বতন্ত্রতা কতটা নিম্নগামী হয়েছে, তা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবো।

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। বাংলা ভাষাভাষীসহ সকল ভাষার জনগণকেই দিবসটি পালন করতে হয়। হোক সেটা নীরবে কিংবা ধূমধাম করে। ভাষা দিবস নিয়ে প্রত্যেক বছর ঢাকা-কলকাতা-দিল্লি সর্বত্র বিস্তর আলোচনা হয়। অনেক স্মৃতিচারণ, অনেক গবেষণা। এ সবই স্বাগত। রাজধানী দিল্লিতে সফদরজঙ্গের মাতৃমন্দির আয়োজন করা হয় ভাষা দিবস নিয়ে আলোচনা সভা। চিত্তরঞ্জন পার্কের শিবমন্দিরসহ বিভিন্ন জায়গাতে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ হাইকমিশনেও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।

যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকায় যে রকমভাবে বাংলাভাষাকে মর্যাদা দিয়েছে এখানকার মানুষ, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কোনও দিনই সেভাবে তার বাঙালি সত্ত্বাকে নিয়ে লড়াই চালায়নি। স্বাধীনতার পর বরং তামিল ভাষা নিয়ে চেন্নাইতে আন্দোলন হয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তামিল বিদ্রোহ সুবিদিত। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কার্যত হিন্দিকেই অনেক বেশি গ্রহণ করেছে। যাও বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক আয়োজন বা উচ্চারণ হয়, তার পুরোটাই ইংরেজি ঘিরে, বাংলা বরাবরই সেখানে অনুপস্থিত। আর এসবের মধ্যে বার বার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন কিন্তু নিছক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না।

ভাষা নিয়ে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে লড়াইয়ের অনেক ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে কালো রাজপথ রঙিন করেছে এমন নজির বিশ্বে এ বাঙালি ছাড়া আর কোনো জাতি আজ পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। ১৩৫৮ সনের ৮ ফাল্গুন বা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছিল সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা আরো অনেকে। ৮ ফাল্গুন বা একুশে ফেব্রুয়ারি তাই শুধু একটি তারিখ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। এই ইতিহাস তাই শুধু বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে সীমাবদ্ধ নয়। একদিনে এই রক্তঝরা ইতিহাসের সূত্রপাত হয়নি। শহীদের রক্তে সিক্ত একুশ ধারণ করে আছে সেই ইতিহাস। এখন বাংলা ভাষা অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ার গৌরবও।

বাঙালির ভাষা সংগ্রমের প্রতি নজর রেখে হারানো ভাষাগুলোও ফিরে পেতে শুরু করেছে তাদের আপন স্থান। একুশ আমাদের সংস্কৃতিতে, মননে গড়নে ক্রিয়াশীল। ধীরে-ধীরে বাংলা ভাষা বিশ্বের কাছে আরো গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে সুধীজনদের এমনটি প্রত্যাশা। অর্জনের এসব গল্পের পেছনে আছে সুদীর্ঘ ত্যাগের ইতিহাস। এ সবকিছুর পরেও বাংলা ভাষা আজও তার আপন ঠিকানা পায়নি, পায়নি সঠিক মর্যাদা।

প্রথমত ফেব্রুয়ারি মাস চলে গেলেই আমরা বাংলা ভাষার কথা ভুলে যাই। এটা আমাদের রুটিন কাজের মতো হয়ে গেছে। এরপর বাকি ১১ মাস বাংলা ঠিকমতো বলিও না। শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষা লিখতেও পারি না। সব স্তরে বাংলা ভাষা চালুর জন্য এখনো হাইকোর্ট থেকে রুলজারি করতে হয়। শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ এখনো নিশ্চিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসগুলো ইংরেজিতে। কোর্ট-কাচারিতে আজও ইংরেজিতে রায় লেখা হয়। জীবিকা ও কর্মক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সঠিক প্রয়োগ না করার কারণে ভূখন্ডের সর্বত্র বিভিন্ন ভাষার জয়-জয়কার। আমাদের উঠতি সমাজ ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দি জাদুতে আকৃষ্ট। ভাবখানা এমন যেন বাংলা গাঁও-গেরামের, চাষা-ভূষার এবং অশিক্ষিতের ভাষা। আমরা বাংলাকে সমৃদ্ধ করতে ইংরেজি শিখব। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করব।

আমরা আন্তর্জাতিক ভাষাগুলোকে ভালবাসবো, বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক বা যেকোনো উপলক্ষ্য ইংরেজি তারিখের ভিত্তিতে করতেই পারি, তাতেও সমস্যা নেই। কিন্তু অন্তত যেন বাংলা তারিখগুলোও মনে রাখি। একমাত্র বৈশাখ ছাড়া অন্য কোনো উপলক্ষ্য আমরা মনে রাখি না, এটি আমাদের জন্য অবশ্যই হতাশার।

আজ ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। ইংরেজি মাসের হিসেবে ভাষার মাসের প্রথম দিন। প্রতিবারের মতো আজ থেকে জাতীয় শহীদ দিবস সামনে রেখে প্রাণে প্রাণ মিলবে নানা কর্মসূচীতে। বেদনার সেই দিন হয়ে উঠবে বাঙালি জাতির প্রাণের মিলনমেলা। লাখ কণ্ঠে গাওয়া হবে অমর সেই সেই গানটি। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি…।' অমর একুশের চেতনার রঙে সাজতে শুরু করবে বাংলা। ভাষার মাস ঘিরে নতুন জাগরণের সৃষ্টি হবে।

এই জাগরণে আমরা সবাই শামিল হবো, পাশাপাশি একটি শপথও করতে পারি, তা হলো- অন্তত আমরা বাঙালিরা ফাল্গুনের শুরুর দিনেও ভাষার মাসের আবেদনটা মনে রাখবো। তাহলে একসময় এটিও নিয়মে দাঁড়াবে।

দ্বায় স্বীকার: নিবন্ধের প্রথমদিকে দুটো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি অনাকাঙ্খিত, তবে ইংরেজির আধিক্য বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে এটি। বিষয়টি মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।

লেখক: সাংবাদিক।