হাওরবাসীর এ দুর্দিনে আপনি পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং নিজে গিয়ে দুর্গত এলাকা পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে প্রথমেই আপনাকে অভিবাদন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা; আমি লেখার শুরুতে একটু পেছনের কথা বলবো আজ। পঞ্চান্ন বছরের ক্ষুদ্র জীবনে বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন ভূখন্ড ও একটি জাতির দীর্ঘ বঞ্চনা ঘুচিয়ে পৃথিবীতে স্থাপন করে গেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে ১২ নভেম্বর, ১৯৭০ সালের সেই দুর্যোগের কথ। সেদিন ৫ মাত্রার প্রলয়ংকারী ঘুর্ণিঝড়টি ৩ লক্ষ ৫০ হাজার উপকূলবাসীর প্রাণ সংহার করেছিল! বিধ্বস্ত করেছিল হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। এক ঘণ্টারও কম সময়ের সেই ঘূর্ণিঝড়ে সেদিন গৃহহীন হয়েছিলো লক্ষ লক্ষ মানুষ। ইতিহাসের সেই সময়টি আমাদের জন্য আসলেই বেদনাদায়ক। কারণ, ১৯৭০ সালে ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, ঘুর্ণিঝড়পীঁড়িত অসহায় মানুষের পাশে বঙ্গবন্ধুর আপোষহীন অবস্থানের কারণে সরকার ১৯৭০ সালের নির্বাচন পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল, যা পরে ঐ বছরের ১৭ ডিসেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের কারণে সংঘটিত প্রাণহানী এবং ক্ষয়-ক্ষতিকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু সেই সময়ের স্বাধীনতার আন্দোলনকে আরও বেশি তীব্রতর করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে দুর্যোগ প্রস্তুতি কর্মসূচী সিপিপি পরিচালনায় আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয়ায় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার নিশ্চয়তা প্রদান করেছিলেন। যুদ্ধবিধস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র ১ বছর ৬ মাসের মাথায় এই বিরল সাহসী উদ্যোগের দৃষ্টান্ত আজ ইতিহাস হয়ে আছে। গবাদিপশু, হাঁস-মুরগিসহ বিপদাপন্ন মানুষকে রক্ষার জন্য জাতিসংঘের আর্থিক সহায়তায় তাঁর উদ্যোগে উপকুলীয় এলাকায় শতাধীক বহুতল ঘুর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ ১৩৭ টি মাটির কিল্লা (যা মুজিব কিল্লা নামে স্থানীয়ভাবে অধিক পরিচিত) নির্মিত হয়েছিল, যেখানে দুর্যোগ প্রাক্কালে গবাদি পশুসহ মানুষ একসাথে আশ্রয় নিতে পারতো। বঙ্গবন্ধুর এই উদ্যোগের হাত ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশে রোপিত হয়েছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বীজ, যা কালের পরিক্রমায় এক বিরাট মহীরুহ হয়ে বর্তমানে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনুকরণীয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পরিগণিত হয়।
আজ হাওরে যখন আমাদের ভাত নেই, মাছ নেই; তখন আমরা ধরেই নিয়েছিলাম আপনি আসবেন। আমরা পাশে পাবো আপনাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি অবগত আছেন, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টির পানিতে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা আজ দিশেহারা। চলতি মাসের শুরুতে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে হাওর অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে বোরো ফসল; হাজার হাজার টন মাছ মরে ভেসে উঠেছে। সেসব বিষাক্ত মাছ খেয়ে মারা গেছে জলজ প্রাণী। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি কৃষকদের ঋণের টাকা আদায় না করতে স্থানীয় এনজিওগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আরো কিছু পদক্ষেপের কথা আমরা শুনেছি। সেকারণে আপনাকে ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
আমরা জানি, এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার সক্ষম। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের হিসাবে হাওরের বন্যায় ৪০ লাখ ৩০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ৫ লাখ ৭ হাজার পরিবার বা ২৫ লাখ মানুষ ফসল হারিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে। কিন্তু ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে মাত্র ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যদি পর্যাপ্ত থাকে, তাহলে সেটা আরো বাড়িয়ে দেয়া দরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আর সেই সাথে সেটা ঠিকঠাক দেওয়া হচ্ছে কিনা তাও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এ সহায়তার বাইরে অন্যদের জন্য ১৫ টাকা কেজি দরে খোলা বাজারে চাল বিক্রি এবং ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির ব্যাপারটিতে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে খালি হাতে ফিরছে বলে আমরা জেনেছি। মানুষ সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকেও চাল পাচ্ছে না। কী কষ্ট!
সংবাদ মাধ্যমের তরফ থেকে আমরা জেনেছি, হাওরাঞ্চলের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ খাদ্যসংকটের ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এর মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ তীব্র এবং ৪০ লাখ হাওরবাসী মাঝারি ধরনের ঝুঁকির মুখে আছে। তবে বিভিন্ন সরকারি আমলা আর বিভাগ সঠিক তথ্য স্বীকার করছে না। আবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, ত্রাণ চাইলে পাওয়া যাবে। হাওরে আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি মানুষ ঠিকমতো ত্রাণ পাচ্ছে না, তাহলে ত্রাণ চাওয়া হচ্ছে না কেনো? আবার ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. মহসীন বলেছেন, হাওরে কোনো খাদ্যসংকট নেই! ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর বেশির ভাগেরই নাকি অন্য আয় আছে। উনি আসলে হাওরের প্রকৃত অবস্থার কিছুই জানেন না। হাওর এলাকায় এখন কাজের কোনো সুযোগই নেই। আর যদি খাদ্যের অভাব না থাকতো তাহলে দলে দলে মানুষ গ্রাম ছাড়ছে কেনো? আসলে সরকার ত্রাণ সহায়তা দিলেও তা কাগুজে হিসাবে বিলি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে কতোজন পাচ্ছে সেটা দেখার বিষয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যে দুর্নীতির কারণে হাওরের বাঁধ ভেঙ্গেছে, সেই বিষের ছোঁয়ায় আজ ত্রাণ পাচ্ছে না আপনার সাধারণ জনগণ। আপনার আশেপাশের সবাই আপনাকে যা বোঝাচ্ছে, তার অধিকাংশই ঠিক নয়। আর সরেজমিনে হাওর এলাকা ঘুরে জানা গেছে, অনেক হাওর এলাকায় এখনও সরকারি ত্রাণ পৌঁছায় নি। আবার পৌঁছালেও এর পরিমাণ খুবই কম। হাওর বিষয়ক বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো হাওর এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণে ত্রাণ সহায়তা যাচ্ছে না বলে যে অভিযোগ করেছে, তা সঠিক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
আজ হাওর এলাকার কৃষকের চোখে শুধুই কান্না। দুর্নীতিবাজ পাউবো কর্মকর্তা আর ঠিকাদারদের দুর্নীতির কারণে তাদের চোখের সামনেই তলিয়ে গেছে ফসল। অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না কৃষকদের। আর এখন দুর্নীতিবাজদের আরেকটি দলের অনিয়ম আর অব্যস্থাপনার কারণে সরকারি সহায়তার সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। এখনও জনগণ তাকিয়ে থাকা ছাড়া, দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারছে না। এ কারণে এরা এখন তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। আপনি এ জাতির অভিভাবক। আপনিই কেবল পারেন হাওরপাড়ের মানুষের জন্য কিছু করতে। আর বিকল্প কর্মসংস্থান ওই এলাকায় করা না গেলে শহরের উপর মানুষের চাপ বাড়বে তা স্বাভাবিক। আর এ দুর্যোগের পর সবচেয়ে বেশি দরকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কিন্তু হাওর অঞ্চলে এখন মাছ ছাড়া কর্মসংস্থানের তেমন কিছু নেই। এসব বিবেচনায় হাওরের সম্ভাব্য জলমহালের লিজ বাতিল করে উন্মুক্ত জলাশয়ে সবার মাছ ধরার অধিকার নিশ্চিত করতে আপনাকে অনুরোধ করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তাহলে অন্তত ঘর ছাড়া মানুষগুলো খেয়েপরে বাঁচতে পারবে। আপনি হাওরে যে পানি দেখবেন, তা কেবল বৃষ্টি আর ঢলের পানি নয়, সেই পানিতে মানুষের অশ্রু মিশে জীবন যে ভেসে যাচ্ছে তাও আপনি দেখতে পাবেন।