‘সাংবাদিকরা, ক্যামেরা বন্ধ কর’, অতঃপর…

কামরুল হাসান জনি
Published : 15 Sept 2015, 03:09 AM
Updated : 15 Sept 2015, 03:09 AM

ক্যামেরা চালানোর অভ্যাস বেশ পুরোনো। তবে সংবাদকর্মী হিসেবে ক্যামেরা হাতে পেয়েছিলাম ২০০৫ সালে। এ যাবৎ কত কিছুইনা হলো ক্যামেরায় বন্দি! ভাবিনি কখনো এই ক্যামেরাই হবে লিখার বিষয়বস্তু। হুম, সম্প্রতিক একটি অনুষ্ঠানে অনাকাঙ্খিত ঘটনায় জনৈক ব্যক্তি সাংবাদিকদের দিকে ক্ষোভের স্বরে তেড়ে এসে বললেন – 'এই সাংবাদিকরা, ক্যামেরা বন্ধ কর।' পেছন পেছন আরো কয়েকজনও বললেন একই কথা। অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থাকা মাইটিভির আমিরাত প্রতিনিধি এ নিয়ে জনৈক ওই ব্যক্তির সাথে বাকবিতণ্ডায়ও জড়িয়ে গেলেন কিছুক্ষণ। আয়োজকদের হস্তক্ষেপে পরে পরিস্থিতি শান্ত হলেও, ক্যামেরা বন্ধের নির্দেশ ও তা মান্য করা আগত সাংবাদিকদের কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিলো ! যাক, সে দিকে যাবো না। প্রবাসে সাংবাদিকতার ধরণটা অন্যরকম। দেশের মতো এখানে নিজস্ব পরিধি নেই, তবুও যে যার মতো আছেন, থাকছেন, কাজ করছেন। কম বেশি দেশ আর দশের কথা ভাবছেন। বিপরীতে যারা নিত্যদিন সংবাদ হচ্ছেন টেলিভিশন বা পত্রিকায়, তাদের চিত্রও একই। তবে ফারাক হচ্ছে অবস্থান ভুলে যাওয়া। আমরা সত্যিই ভুলে যাই আমাদের অবস্থান, দায়িত্ব ও কি করতে চাই এবং আমরা কি করছি! এই ছোট ছোট ভুলে যাওয়াগুলোই ভরা মজলিসে সম্মানহানীর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিকার করতে হবে, সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানরা যেখানে সেখানে ক্যামেরা তাক করেন। কারণও আছে। এটি তাদের দায়িত্বের একাংশ। কিন্তু যেকেউ তাদের দায়িত্বের ক্ষেত্রে বাধা দেয়াটা কতটুকু সমিচিন! এটি আমার প্রশ্ন।

ঘটনা ১ : ৮ মার্চ ২০১৪ইং, শনিবার। সংযুক্ত আরব আমিরাত আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে সেদিন প্রধান অতিথি ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। ঘটনাস্থল দুবাইয়ে ল্যান্ডমার্ক হোটেল। মন্ত্রীকে প্রটোকল দিতে দুবাই কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল মাসুদুর রহমান ও কনস্যুলেটের কর্মকর্তা কিরিটী চাকমাও সম্মেলনস্থলে উপস্থিত ছিলেন। ঘোষণা মঞ্চ থেকে ঘোষণা এলো প্রধান অতিথিকে ফুল দিয়ে বরণ করা হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলন বলে কথা! তার উপর প্রধান অতিথি খাদ্যমন্ত্রী! বিভাগীয় ও আঞ্চলিক কমিটির উপস্থিত নেতারা মন্ত্রীকে ফুল দেবেন, সঙ্গে একখানা ছবিও তুলবেন। সেই ছবি ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশ করে নিজেকে মাপামাপির নেতা হিসেবে পরিচয় দেয়ার প্রতিযোগিতা তো হবেই বটে। এ নিয়ে কে আগে, কে পরে ; বেঁধে গেলো হট্টোগোল। চলে গেলো হাতাহাতির পর্যায়ে। উপস্থিত সাংবাদিকদের ক্যামেরা তাক করা হলো বিশৃঙ্খল ওই নেতাদের(!) দিকে। আর তখনই শুনতে হলো – 'ছবি তুলছেন কেন ? বন্ধ করুন, বন্ধ করুন ক্যামেরা!'

ঘটনা ২ : ২০১৫ বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়। ৯ মার্চ, সোমবার। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। সারাদেশের মতো দুবাই প্রবাসীরাও বেশ খুশী। ফোন এলো। এ বিজয়ের রাতে কনস্যুলেটে প্রীতিভোজ ও উৎসবের আয়োজন হয়েছে। প্রবাসী সাংবাদিকরা ছাড়াও এতে আমন্ত্রণ পেয়েছিলো স্থানীয় পত্রিকা খালিজ টাইমস ও গালফ নিউজের সংবাদকর্মীরা। সময় মতো প্রবাসীদের আগম। চারদিকে ফটোসেশন। বাংলাদেশের জয়ে একদিকে চলছে ভক্তদের উচ্ছ্বাস। অন্যদিক থেকে শোনা যাচ্ছে রাজনৈতিক স্লোগান। হঠাৎ করে পরিস্থিতি বদলে যায়। মূহুর্তেই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো দেশের নামকরা দুই রাজনৈতিক দলের নেতারা (!)। স্লোগানের ধাওয়া এক পর্যায়ে হাতাহাতিতে রূপ নিলো, শেষে মারামারি। যথারীতি, সাংবাদিকদের ক্যামেরার লাইট জ্বলছে। ছবি উঠছে। সে সময় কয়েকজন নেতা (!) তেড়ে এসে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বললেন- 'আমাদের ছবি তুলছেন কেন ? বন্ধ করুন ক্যামেরা।' কেউ কেউ ক্যামেরা কেড়ে নেয়ারও স্পর্ধা দেখিয়েছেন বটে। স্বয়ং কনস্যুলেট কর্মকর্তারাও বললেন – 'ক্যামেরা বন্ধ করুন'। ঘটনা শুনে ঘটনাস্থালে পৌঁছলেন দুবাই সফররত গাজীপুর ২ আসনের সাংসদ জাহিদ আহসান রাসেল। কনসাল জেনারেলের রুমেই হয় সেদিন সংর্ঘষের ঘটনায় মিমাংশা বৈঠক।

ঘটনা ৩ : ৮ সেপ্টম্বর ২০১৫ইং, মঙ্গলবার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ইউএই সফর উপলক্ষে কনস্যুলেটে চলছে মত বিনিময় সভা। ভরা মঞ্চে বসে আছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান পররাষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা: দীপু মনি এমপি, সাবেক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী লেঃ কর্ণেল (অবঃ) ফারুক খান এমপি, গোলাম ফারুক খন্দকার এমপি, মোঃ সোহরাব উদ্দিন এমপি, সেলিম উদ্দিন এমপি ও আবুধাবী দূতাবাসের রাষ্ট্রদুত ড. মোহাম্মদ ইমরান। গতানুগতিক রাজনৈতিক অনুষ্ঠানগুলোর মতো এখানেও প্রথম থেকে দেখা গেলো, কেউ মঞ্চের পেছনে কেউবা আবার বক্তব্যরত অতিথির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ছবি তুলছেন ও ছবি তোলাতে সাহায্য নিচ্ছেন। কয়েকবার এদের সরে যেতে বলাও হয়েছে। অবশ্য সেদিন মঞ্চের পেছনে ক'জন টিভি ক্যামেরাম্যানকেও বসার জায়গা না পেয়ে ( অনুষ্ঠানস্থলে সাংবাদিকদের বসার ব্যবস্থা ছিলো না) দাঁড়াতে দেখা গেছে। সভার একেবারে শেষের দিকের ঘটনা। কনস্যাল জেনারেল বক্তব্য রাখছেন। হুট করে ভিড় ঠেলে একজন এসে দাঁড়ালের মঞ্চের পেছনে। উদ্দেশ্য অতিথিদের সাথে ছবি তুলবেন। হয়তো তিনি ভুলে বসেছেন, এটি তার বা তাদের আয়োজিত রাজনৈতিক অনুষ্ঠান নয়! যেখানে বক্তারা বক্তব্য রাখেন আর হুমড়ি খেয়ে পড়েন ছবি পাগল কিছু নেতা-কর্মী (!)। এ ভুলে যাওয়াটাই কাল হলো ! অন্য আরেকজন তাকে ছবি তুলতে বাঁধা দেয়ায় শুরু হলো দু'জনের কথা কাটাকাটি। হল ভর্ত্তি এতো গুলো মানুষের সামনেই ঝগড়াটা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেলো। উপস্থিত যে ক'জন সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান উপস্থিত ছিলেন, তারা ক্যামেরা ঘুরালেন। তাক করলেন বিশৃঙ্খল ওই লোকদের দিকে। ক্যামেরার লাইট জ্বলতেই ক্ষেপেছেন অনেকেই। তেড়ে এসে জনৈক ব্যক্তি বললেন- 'এই সাংবাদিকরা ক্যামেরা বন্ধ কর।' তার সাথে আরো কয়েকজনেরও ছিলো কড়া নির্দেশ। বেস! কি আর করা, সব ক্যামেরার বন্ধ।

উপরের তিনটি ঘটনাই সত্যি। যদিও কোনো পত্র-পত্রিকা বা টেলিভিশনের এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। যার কারণ, কমিউনিটির প্রতি সাংবাদিকদের অগাত বিশ্বাস। একটা সুযোগ দিলে হয়তো, বিশৃঙ্খলাকারীরা সুধরে যাবেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা! সুযোগ পেয়ে অনেকে মাথায় উঠে বসেন। সর্বশেষ ঘটনায় কেউ কেউ সাংবাদিকদের জড়িয়ে বাজে মন্তব্য করতেও শুনেছি। যার কারণেই হয়তো ক্যামেরাকে বিষয়বস্তু করে লিখতে বসা। হুম, সত্য তো এই, ওই উল্লেখযোগ্য তিনটি ঘটনা ছাড়াও প্রবাসে প্রতিনিয়ত এধরেণ বিশৃঙ্খল ঘটনার জন্ম দিয়েই যাচ্ছে নামধারী কিছু নেতা-কর্মী। সচেতন যদি হয়ে থাকেন, তবে উত্তর দেবেন কি ! সাংবাদিকরা ক্যামেরা বন্ধ রাখার পরও সেই তারা কি সু-শৃঙ্খল জাতির পরিচয় দিতে পেরেছে?

ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। প্রবাসে বেশির ভাগ ব্যক্তিবর্গ নিজের মন মতো খবর আশা করেন। তাই হয়তো একটু জোর খাটানোর চেষ্টা থাকে। অথচ এসবের অনেক কিছুই সাংবাদিকদের ইখতেয়ারে পড়ে না। সেজন্য অনেক সময় মন মতো খবর দেখতে পান না কেউ কেউ। এই তো! আপনাদের চাওয়া পাওয়া হচ্ছে, প্রিন্ট বা অনলাইন পত্রিকায় বস্তা মারা নাম ছাপা হোক, টেলিভিশনে দেখানো হোক সবার ছবি। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, একটি অনুষ্ঠানে যত জন না উপস্থিত দর্শক থাকেন তার চেয়ে বেশি থাকেন বক্তা! এদের সবার ক্ষেত্রে আবার বক্তা সম্ভোধনটাও সাজে না। কারণ, অনুষ্ঠান পরিচালক এমন একজনের নাম ঘোষণা করে বসেন, যিনি মাইক্রোফোনের সামনে এসে কি বলবেন তাও বুঝতে পারেন না। বক্তা হিসেবে তাদের সম্ভোধন করা না সাজলেও পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে তাকেই কিন্তু নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। বলতে গেলে, এই ক্যামেরাই অনেকের নেতা হবার পেছনের ইতিহাস ধারণ করে রেখেছে এবং তথাকথিত প্রবাসী নেতাদের পরিচয়ের একমাত্র মাধ্যম এই ক্যামেরা। তবে একমাত্র মাধ্যম বললে ভুল হতে পারে। এখন অনেকেই আবার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে নেতা হবার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। যার জন্য মোবাইল ক্যামেরা যথেষ্ট। সময় মতো নেতার সাথে সেলফি কিংবা একখানা ছবি হলেই সারে। আর এজন্যেই এতো কথা, এতো উদাহরণ আর শত বিশৃঙ্খলা। এবার বলুন, ক্যামেরা বন্ধ করলে কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে! আপনারা শুদ্ধ হয়ে যাবেন ? হয়তো আজকের পর আত্ম পরিশুদ্ধির চেষ্টা করবেন।

জানি, এ লিখা পড়ে কেউ কেউ কষ্ট পাবেন। তবুও বলছি, প্রবাসী সাংবাদিকরা চায় সব সময় ভাল খবরগুলোই প্রকাশ করতে তেমনি মন্দ দিক গোপন রাখতে। এতে আত্ম পরিশুদ্ধির সুযোগ বাড়ে। তাই ক্যামেরার প্রতি ক্ষোভ নয়, ভালবাসার উপাখ্যান তৈরী করুন। আমরা ভাল আছি, আমাদের ভাল থাকতে দিন। শেষ করার আগে ঘটনা ৩ এর দিনে ডা. দীপু মনির দেয়া বক্তব্যের কিছু অংশ যোগ করছি – 'দেখছি প্রবাসে অনেক নেতা আছেন, অনেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আপনারা চাইলে পারেন, নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে। চলনে – বলনে যদি ভাল কিছু দেখাতে পারেন, তবে অন্যরা আপনাদের অনুসরণ করবে। ভাবুন, আমরা কি বলছি, কি করছি! প্রবাসের অপরাধ প্রবণতা কমাতে আমাদেরকেই সচেতন হতে হবে।'

লেখক : সংবাদকর্মী।