ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন,আমাদের দেশ বা ভাষাপ্রেমের ভন্ডামী এবং জনমানসিকতা…

হাসান তারিক
Published : 18 Feb 2012, 05:08 PM
Updated : 18 Feb 2012, 05:08 PM

১.
নিজের ঘর থেকেই আগে শুরু করি…
আমার আট বছর বয়সি গ্রাম্য ছোটো খালাত ভাই,যে কিনা শুদ্ধ করে বাংলা বলতে পারেনা,তার মুখে যখন "কাল মিলুঙ্গি" জাতিয় হিন্দি মিক্সচার ভাষা শুনি,আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে।অনেক আধুনিক মা-বাবা হয়ত তাদের বাচ্চাদের মুখে এমন কথা শুনে পুলকিত হন,গর্বিত হন…
আমি এও জ়ানি আমাদের অনেক বাসায় মা-বোনদের একমাত্র বিনোদন হিন্দি চ্যানেলের বাস্তবতাহীন রঙ্গিন সিরিয়াল।অনেক মহিলা আছেন,সব কাজ বাদ রেখে সারাদিন হিন্দি চ্যানেল নিয়ে পড়ে থাকা…আমাদের উঠতি তরুন-তরুনিরা বলিউডের ছবি নিয়ে অজ্ঞান…
এসব আসলে বাস্তবতা…করুণ বাস্তবতা।
করুন বাস্তবতা বলেই ঠিক ৬০ বছর আগে ভাষার জন্য জীবন দেয়া কতগুলো তরুন প্রানের প্রিয় মায়ের ভাষার দেশে শিশুরা ডরেমন নামের নিদোর্ষ কা্র্টুনের আড়ালে নিরব ঘাতক হিসেবে হিন্দির প্রকট উপ্সথিতি,মা-বোনদের হিন্দি চ্যানেল আর তরুন-তরুনিরা বলিউডের ছবি নিয়ে পড়ে থাকা,এসব দেখতে হচ্ছে।
এমন কোন দেশ আছে যে দেশের সন্তান-রা মায়ের ভাষা বাংলার জন্য জীবন দিয়েছে?অথচ,আমরা এতটাই অকৃতজ্ঞ জাতি,যে আমরা সব ভুলে গিয়ে প্রতিদিন,প্রতিনিয়ত ভাষা শহিদ্-দের অপমান করে যাচ্ছি।
তবে কি আমরা কি আমাদের বিবেকবোধটুকুও হারিয়ে ফেলেছি?

…হয়ত,তা না হলে এমন কেন হবে?এমন ত কথা ছিলনা…

ঠিক ৪০ বছর আগে যে দেশপ্রেমি বাঙ্গালি যোদ্ধা নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল,৩০ লাখ শহিদ আর লাখো মায়ের সম্ভ্রম এর বিনিময়ে দেশের জন্য স্বাধীনতা এনেছিল,সবুজ-লালের একটা নতুন পতাকা এনে দিয়েছিল,সে দেশের আজ কি হাল?গনত্রন্ত্র কোথায়,সাব্র্ভৌমত্ব কোথায়??আমার বোন ফেলানি গুলি খেয়ে কাটাতারে ঝুলে মরে,ভাই হাবিবুর নি্র্যাতিত হয়,ভারত নামের "বন্ধু"র শক্ত লাঠির আঘাতে…
আর আমরা বিড়ালের মত মিউ মিউ করে প্রতিবাদ করি…
হায়রে প্রিয় স্বদেশ!!

আমরা কি ৩০ লাখ শহিদ আর লাখো মা কে অপমান করছিনা??আমার মুক্তিযদ্ধা বাবাকে অপমান করছিনা?
আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে…রাগে,ক্ষোভে এই মুহুরতে আমার দু'চোখ দিয়ে জল নামছে…
বাবা,আমার স্বপ্নবান মুক্তিযুদ্ধা বাবা,আমাকে ক্ষমা করো…

২.
আমি যে এলাকায় থাকি,তার ঠিক পাশেই একটা পিকনিক স্পট আছে।প্রায়-ই ঢাকা থেকে বড় বড় প্রতিশ্ঠান ১০০-১৫০ গাড়ি করে পিকনিক করতে আসে।এই মুহু্র্তে যখন লেখাটা লিখছি,তখন পিকনিক এর লোকেশন থেকে শিলা কি জওয়ানি গানটা বাজছে…সারাদিন অনেক গানের সাথে হিন্দি গানের ছিল ব্যাপক বাজনা…এমনটা সব পিকনিক বহরেই হচ্ছে।
বিজয়ের মাসে, ভাষার মাসে নানা ছল-ছুতোয় হিন্দি গানের নামে অশ্লীল জলসা বসে বাক্তিগত,করপোরেট কিংবা রাষ্ট্রীয় উ্যদোগে।
তবে কি আমাদের বিনোদন মানেই হিন্দি গান,মুভি?আমাদের বাংলাগান কি হারিয়ে গেছে??
উত্তর-টা না হলেও, সত্যিটা হল, আমরা সর্বগ্রাসি ভারতীয় সংস্কতির শিকার।আমরা প্রতিদিন এক্টু এক্টু করে নিজ ভাষা-সংস্কতি ভুলে মাতালের মত হিন্দির নেশায় ডুবে যাচ্ছি…
অথচ,এর পরিনাম কি ভয়াবহ,তা আমরা এক্টুও অনুধাবন করতে পারছিনা…
মায়ের ভাষার জন্য জীবন দেয়া এদেশে আজ থেকে ঠিক দুই প্রজন্ম পরে বাংলা ভাষা হয়ত হারিয়ে যাবে,হিন্দির উৎপীড়নে কিংবা জীবিকার প্রয়োজনে ইংরেজির আয়ত্তকরনে।তারপরও যদি টিকে থাকে তা হয়ে থাকবে অচ্ছুত,অপাংতেয়।

আমরা মুখে দেশপ্রেমের কথা বলি,শহিদ-দের জন্য মায়াকান্না দেখাই,ভাষা শহিদ-দের নিয়ে আবেগের ফোয়ারা ছুতাই…তবে আমরা কি জানি,আমরা আসলে এক-একটা ভন্ড…
স্বাধীনতা,বিজয় দিবস বা ভাষা দিবস এখন আলু-পতল এর মত একটা মাত্র দিবস পালনের ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে।
মুখে ভালবাসার কথা বলে আমরা প্রতিনিয়ত দেশ বা ভাষাপ্রেমের নামে ভন্ডামী করে যাচ্ছি…
বাসার ড্্রয়িং রুম থেকে থেকে করপোরেট দুনিয়া,সব খানেই এই ভন্ডামি চলছে…
জনমানসিকতার এই ভন্ডামিপ্রবনতা দূর করতে হবে।তা না হলে প্রক্ৃতি যে প্রতিশোধ নেবে,তার দায়ভার আমরা কেউ এড়াতে পারব না।
আমাদের,সচেতন তরুন্-দেরই জেগে উঠতে হবে,আমরাই পারি,দেখিয়ে দিতে চাই আর একবার সারা বিশ্বকে…
জাগো বাহে,কোন্ঠে সবাই…??