মির্জাগঞ্জে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন ও রাজনৈতিক সম্প্রীতি, সহাবস্থান

আশফাক আবীর হাসিব
Published : 29 Feb 2016, 07:19 PM
Updated : 29 Feb 2016, 07:19 PM

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহরে সারা দেশের মত পটুয়াখালী জেলার অন্যতম উপজেলা মির্জাগঞ্জেও ভাষা শহীদদের স্মরনে উপজেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অর্পন শ্রদ্ধাঞ্জলি করা হয়। যথাযোগ্য মর্যাদায় ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে দিবসটি উৎযাপিত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ, বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকা-টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং সাধারন মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন ছিল ভাষা দিবস উৎযাপনের আয়োজনে। দল, মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ এতে অংশ নিয়েছে। অবশ্যই এটা রাজনৈতিক সহাবস্থান ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন মহান মুক্তিযুদ্ধও এই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বলিয়ান হয়েই সংগঠিত হয়েছিল।

যে কোন অঞ্চলের টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আর সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সকলের অংশগ্রহন নিশ্চিত করা অবশ্যই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্বদিচ্ছার উপরে অনেকাংশে নির্ভর করে। সরকারী দলের নেতৃবৃন্দ যদি অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা ধারন করেন তবেই সহাবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব। একথা বললে অত্যুক্তি হবেনা যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলে এ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকে। কেননা মির্জাগঞ্জের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা তাই দেখতে পাই। একথার সাথে অনেকেই শুধুমাত্র বিরোধিতার খাতিরে দ্বিমত পোষন করতে পারেন। কিন্তু সঠিকভাবে পর্যালোচনা করলে হয়ত অনেক তথ্যই সামনে চলে আসবে।

মির্জাগঞ্জ মরহুম ইয়ার উদ্দিন(রঃ) এর স্মৃতিধন্য পুণ্যভূমি। এ প্রজন্মের মানুষ হিসেবে আমাদের দেখা সময়কালে আমরা দেখেছি ঠিক কবে থেকে প্রতিহিংসার রাজনীতি এই জনপদে প্রবেশ করেছে। কতিপয় অরাজনৈতিক ব্যক্তির নেতা হওয়ার খায়েশে অঙ্গার হয়েছিল মির্জাগঞ্জ। শান্তির পায়রা হত্যা করে, অহেতুক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছিল সেইসব অতিথি রাজনীতিক।

'৭১ দেখিনাই, কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৭ দেখেছি। '৭১ দেখার স্বাধ মিটিয়া গিয়াছে।

২০০১ থেকে ১/১১ সময়কালে মির্জাগঞ্জের রাজনৈতিক অবস্থার কথাই বলছি।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাজারো উদাহরন দেয়া যাবে। বাহাস করতে চাইলে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যাবে। এখনও নির্যাতিতরা সেসব নিশ্চই ভুলে যায়নি। শারীরিক ক্ষত শুকালেও মনের ক্ষত শুকিয়ে যায়নি। প্রাসঙ্গিক কারনে শুধুমাত্র এই ভাষা দিবস কেন্দ্রীক অঘটন-ঘটনার মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৫ দিবাগত মধ্যরাত। এবং ২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রথম প্রহর।
বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। মির্জাগঞ্জ তথা পটুয়াখালীতে সাবেক বিমান বাহিনীর প্রধান জনাব আলতাফ হোসেন চৌধুরীর শাসন চলছে। মির্জাগঞ্জের বর্তমান শহীদ মিনার তখন ছিলনা। সুবিদখালী কলেজ চত্বরের শহীদ মীনারেই সবাই ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাত। শহীদ বেদিতে একুশের প্রথম প্রহরে বিএনপি এবং ছাত্রদলের লোকজন আগেই অবস্থান নিয়েছিল। কিছু সময় পর উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ফুল দেয়ার জন্য উপস্থিত হয়। মাতৃভাষা দিবসের রীতি অনুযায়ী প্রথম প্রহরে ফুল দেয়া আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু বিধি বাম, সংঘর্ষের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল তৎকালীন বিএনপি ও ছাত্রদল। অতর্কিত হামলায় গুরুতর আহত হন অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী। একই রাতে ক্রমাগত ভাবে কয়েকবার শহরের বিভিন্ন স্থানে রাস্তা আটকিয়ে হামলা চালানো হয় ছাত্রলীগ নেতাদের উপরে। উপরের ছবিতে উপস্থিত প্রায় সকল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ সেদিনের সেই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী এবং ভুক্তোভুগীও বটে। বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক খান তখন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। সুবিদখালী বাজারে তার বাসায় রাতে হামলা হলে সেখানে উপস্থিত নেতা-কর্মীরা শীত উপেক্ষা করে নদী সাঁতরে নিজেদের রক্ষা করেন। সারারাত ছাত্রদলের প্রহরা-মহরায় অস্থির ছিল মফস্বলের এই নগর, যেন অলিখিত কারফিউ। আর ছবিতে উপস্থিত বিএনপি নেতৃবৃন্দদের প্রায় সকলেই তৎকালীন উপজেলা বিএনপির বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নির্যাতন-নিপীড়ন করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলটির উপজেলা নেতৃবৃন্দকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেয়নি সেদিনকার ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কর্মীরা। সন্ত্রাস এবং হামলা-মামলা দিয়ে ঘরছাড়া-গ্রামছাড়া করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের।

আজকে মির্জাগঞ্জে বিএনপি সকল ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে পারছে। কিন্তু তখন যেন অলিখিত সামরিক শাসন ছিল। উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন পর্যন্ত মির্জাগঞ্জের মাটিতে করা সম্ভব ছিলনা।

কল্পকাহিনী নয়, বাস্তব পরিস্থিতি এমনই ছিল।

আর আজকে কতটা নির্বিঘ্নে, কতটা শান্তিপূর্নভাবে দল-মত নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহনে সকল রাষ্ট্রীয় দিবস, স্থানীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। সেদিনের তুলনায় এযেন রূপকথা। জেলা শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিএনপির জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ নির্বিঘ্নে শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছে। কিন্তু আমরা দেখেছি নির্বাচন চলাকালীন অবস্থায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এড. শাহজাহান মিয়াকে বহনকারী গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলা। জনতা মানবঢাল তৈরি করে রক্ষা করেছিল এড. শাহজাহান মিয়াকে। '৯৬ সালে বা তার পূর্বে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল তখনও রাজনৈতিক সহাবস্থানের ক্ষেত্রে কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। তখন আওয়ামী লীগ হামলা-নির্যাতন চালালে বিএনপির পক্ষে কিছুটা অজুহাত দেখানো যেত। বলা যেত আওয়ামী লীগ করেছিল তাই বিএনপিও করেছে।

বিএনপি শাসনামলে যে দুঃশাশনের চিত্র মানুষ দেখেছ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সাধারন মানুষ যে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে, পিচ ঢালা রাজপথে মহরা দিয়ে যে তান্ডব হয়েছিল, তার দায়ভার তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বকেই নিতে হবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে যে শোষণমূলক আচরন হয়েছে, তাতে মানবতা লজ্জিত হয়েছে। সেই ঘটনার বিপরীতে আজ যখন সকলেই প্রাপ্ত অধিকার বিনা বাঁধায় ভোগ করতে পারছে সেটা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের জন্য যেমন গর্বের, ঠিক তেমনি বিএনপির জন্য লজ্জার।

আজকের এই সম্প্রীতির পরিবেশ, এই সহাবস্থান বজায় রাখতে অবশ্যই শাসক দল আওয়ামী লীগের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অনেকে বলতে পারেন আওয়ামী লীগের সেধরনের হিম্মত নাই। এটা হিম্মতের প্রশ্ন নয়, এটা মানবতার প্রশ্ন, এটা অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রশ্ন। ভাল ব্যবহারকে অনেকে দুর্বলতা ভাবেন। কিন্তু মহানুভবতা, মনুষ্যত্বই মানবের ধর্ম বলে বিশ্বাস করি।

অনেক বন্ধু উন্নয়নের কথা দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু উন্নয়ন কার জন্য ? নিশ্চই জনগনের জন্য। সেই জনগনকে ভীতিকর অবস্থায় অব্যাহত সন্ত্রাসের মধ্যে রেখে কি ধরনের উন্নয়নের কথা জাহির করতে চান, বোধগম্য নয়।

প্রতিহিংসার সেই রাজনীতি এখন অনুপস্থিত। তাতে কি উন্নয়ন থেমে আছে? বরঞ্চ শান্তিপূর্ণ উন্নয়নই জনগনের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।

ভেঙেছ কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেবনা ?!
জনগনের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরে আওয়ামী লীগ পটুয়াখালী জেলায় রাজনৈতিক সহাবস্থান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ স্থাপনে সক্ষম হয়ে। এজন্য অবশ্যই জেলা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগ এই কৃতিত্বের দাবীদার। এটা মানবতার বিজয়, মহানুভবতার বিজয়, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিজয়। নির্যাতনের সেসব অকথ্য ঘটনার বিপরীতে এখনকার পরিস্থিতি যেন অস্ত্রের পরিবর্তে ফুল, যুদ্ধের পরিবর্তে উষ্ণ আলিঙ্গন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাতেই জনগনের নিরাপত্তা বজায় থাকে, সামাজিক ন্যায়বিচার অধিষ্ঠিত থাকে বিধায় জনগন ম্যান্ডেট দিয়েছিল। আগেই বলেছি, যেকোন অঞ্চলের টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। সরকার রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল রাখতে পেরেছে বলেই সারা দেশে শান্তিপূর্ন উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সন্নিকটে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়েও অতীতে বিএনপি শাসনামলে মির্জাগঞ্জবাসী রাজনৈতিক খলনায়কদের কালো জাদু প্রত্যক্ষ করেছিল। শান্তি-উন্নয়ন যথাক্রমিক প্রক্রিয়া। কেন্দ্র থেকে তৃনমূল পর্যন্ত শান্তি, সম্প্রীতি এবং উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সারা দেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষের প্রার্থীদেরই জনগন নির্বাচিত করবে ইনশাল্লাহ।