বিএনপির জঙ্গি তত্ত্ব এবং বানরের কুমির দর্শন

আশফাক আবীর হাসিব
Published : 31 March 2017, 05:14 PM
Updated : 31 March 2017, 05:14 PM

জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। উন্নত দেশগুলো থেকে উন্নয়নশীল দেশসমূহ আজ জঙ্গিবাদে কমবেশি আক্রান্ত। জঙ্গিবাদের হুমকি উপেক্ষা না করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই বিপদ মোকাবেলা করে যাচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন বাহিনী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে, বিপদ মাথায় নিয়ে মোকাবেলা করছে জঙ্গিবাদকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারি বাহিনীর সদস্যরা জীবনের ঝুকি নিয়ে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। অগনিত সংখ্যক পুলিশ সদস্য প্রান হারিয়েছে জঙ্গিবাদ বিরোধী সংগ্রামে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একের পর এক এক জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছেন। গুলশানে জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে দুজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে জীবন দিতে হয়েছে ।


সর্বশেষ সিলেটে আতিয়া মহলে অভিযান চালাতে গিয়ে জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম, সিলেটের পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক চৌধুরী আবু মো. কয়সর, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ছাত্রলীগের উপপরিবেশ–বিষয়ক সম্পাদক জান্নাতুল ফাহিম, মদনমোহন কলেজের হিসাববিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ওয়াহিদুল ইসলাম নিহত হয় এবং গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদের মৃত্যু হয়।
বর্তমান সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেকটি অভিযান সরাসরি পর্যবেক্ষন করেন এবং সে অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একের পর এক সফল অভিযানের মাধ্যমে দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় অকুতভয় সৈনিকের ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গোটা দেশের আপামর জনগণ একাত্ন হয়েছেন কোন প্রকার দ্বিমত ছাড়াই। সবচেয়ে আশার কথা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ শুরু হয়ে গেছে। সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ব্যাপারে জনসচেতনতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ সর্বোপরি গোটা জাতি একাত্ন। জঙ্গিবাদে জড়িতদের পরিবার থেকেই আইনের হাতে সোপর্দ করা হচ্ছে। এরকম পরিবেশে জঙ্গিবাদ প্রিয় মাতৃভূমিতে কোনভাবেই তার বিষবৃক্ষের শেকড় গাঁথতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।

কিন্তু অতীব আশ্চর্যের এবং শঙ্কার বিষয়, দীর্ঘদিন থেকেই বিএনপি এই জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযান পরিচালনা ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে আসছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বিতর্কিত মন্তব্য করছেন এবং বিতর্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা করেই চলছে। গণতান্ত্রিক বিশ্বে যেকোন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা যায়। কিন্তু দায়িত্বশীল নেতৃত্ব থেকে দায়িত্বশীল মন্তব্যই জাতি প্রত্যাশা করে। কতটা দায়িত্বশীলতা নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ রাজনীতি করছেন সেটা বিষদ বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তা অবশ্য ভিন্ন বিষয়।


গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার কিছু দিন পরেই বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বললেন, ''এই সরকার কথায় কথায় কিছুদিন পরপর জঙ্গির ধোঁয়া তুলে। অমুক জায়গায় এতজন জঙ্গি পাওয়া গেছে। তারপর জঙ্গিগুলোকে ধরে, সত্যিকার জঙ্গি কি না জানি না। কিছু লোক তাদের ধরা থাকে। এগুলোকে না খেয়ে খেয়ে দীর্ঘদিন বন্দী করে রেখে তাদের দাঁড়ি-চুল বড় করে, বিদঘুটে চেহারা হয়ে যায়। তারপর তাদের জঙ্গি বলে সামনে নিয়ে আসে। আর কতগুলো পুলিশ আছে, অস্ত্রশস্ত্র সাজিয়ে বলে এরা জঙ্গি, হরকাতুল জেহাদ, এদের ধরেছি। তার কিছুদিন পর দেখা যায়, লোকগুলোকে ধরে, তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। কেন গুলি করে মেরে ফেলা হয়? দেশে আইন আছে, আদালত আছে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এগুলো দুঃখজনক ঘটনা।'' (bdnews24.com)

দেশের একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান, একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এতটা হাল্কা ধরনের মন্তব্য অবশ্যই জাতিকে হতাশ করেছিল। তার পরেই ঢাকার মিরপুরে একটি জঙ্গি আস্তানায় পুলিশ সফল অভিযান চালায়। সেখানে রুপনগর থানার দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা গুরুতর আহত হন। সেই হতাশাযুক্ত কথাবার্তা থেমে নেই। জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযান হলেই বিএনপির পক্ষ থেকে প্রপাগান্ডা শুরু হয়ে যায়। অনেকটা গাত্রদাহের মতই মনে হয়।

মার্চের মাঝামাঝি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতেই সরকার জঙ্গিবাদের সাইনবোর্ড ব্যবহার করছে। গত ১৬ মার্চ এবং ১৭ মার্চ আত্নঘাতী জঙ্গি হামলা সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, কেনো আত্নঘাতীরাই শুধু মারা যায়? যে মানুষটি আত্মঘাতী বোমা দিয়ে নিহত হলো সে কি তাকে নিহত করবার জন্যই আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে? তাহলে কি সাধারণ জনগণ নিহত হলে মির্জা সাহেব খুশি হতেন?
এই ধরনের প্রপাগান্ডা তারা চালিয়েই যাচ্ছেন ক্লান্তিহীনভাবে। সর্বশেষ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জনাব খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, এত জঙ্গি আস্তানা কোত্থেকে আসছে? গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার পর সরকার জঙ্গিবাদ নিশ্চিহ্ন করার দাবি করেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এখন কিভাবে আপনারা জঙ্গি আস্তানা খুঁজে পাচ্ছেন?'
শুধু এখানেই শেষ নয়, প্রতিনিয়তই উদ্দেশ্যমূলক বানী বিএনপির বড়, মাঝারি, ছোট সব ধরনের কেন্দ্রীয় নেতাদের মুখ থেকে বের হচ্ছে।

যেহেতু দলগত ভাবেই তারা এধরনের কথা বলে যাচ্ছে, সেহেতু বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকার ও তার বিভিন্ন বাহিনীর ইস্পাত কঠিন সংগ্রামকে বিতর্কিত করার এজেন্ডা বাস্তবায়নের মিশনেই হয়ত লিপ্ত আছে। যদি তা না হয় তবে তাদের মতিভ্রম বা স্মৃতিভ্রম হয়েছে বলেই মনে হয়। কেননা বোঝার ভুল একরকম আর উদ্দেশ্যমূলক দুষ্ট আচরন অন্য বিষয়। জঙ্গিবাদ নিয়ে বিএনপির ক্রমাগত এই উদ্দেশ্যমূলক তত্ত্ব আবিষ্কার সত্যিই উদ্বেগ এবং শঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা তাদের ক্রমাগত অপপ্রচার জঙ্গিবাদকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদ জুগিয়ে যাচ্ছে।

আমরা যদি ধরে নেই যে, বিএনপি এসব কথা তাদের বিশ্বাস থেকেই বলছে। তাহলে এটা তাদের মতিভ্রম বৈ অন্য কিছু নয়। একটা গল্প মনে পরে, এক বনে কিছু দুষ্ট বানর বাস করত। তাদের কাজই ছিল বিভিন্ন দুষ্টামির মাধ্যমে বনের পরিবেশ ঘোলাটে করে রাখা। বিভিন্ন স্থানে তারা আড্ডা দিত, এবং বিভিন্ন ধরনের মাদক সেবন করত। একদা নদীর ধারে একটি গাছের উপরে বসে কয়েকটি বানর মদ্য পান করছে। এসময় একটি টিকটিকি এসে কৌতহল নিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করল, মামা তোমরা কি খাচ্ছ? বানরের দল তাকে বলল, আমরা মদ্যপান করিতেছি। বেচারা টিকটিকি আবদার করে বলল, আমিও খাবো। বানর বলল, তুই ছোট, খেয়ে সামাল দিতে পারবিনা। জোড়াজুড়ি করার পরে একটু মদ টিকটিকিকে খাইয়ে দিল। টিকটিকি নেশা সামলাতে না পেরে মাথা ঘুরে নিচে নদীর তীরে শুয়ে থাকা কুমিরের গায়ে পরল। কুমির রাগ হয়ে বলল, তোর এই অবস্থা কেনো। টিকটিকির কাছ থেকে সব ঘটনা শুনে কুমির ঐ গাছে কাছে গিয়ে বানরকে বলল, এই তোরা এখানে মদ খেয়ে বনের পরিবেশ নষ্ট করছিস কেনো। নেশার ঘোরে চোখ মেলে কুমিরের দিকে তাকিয়ে বানর সর্দার বলে উঠল, মামা কইছিলাম না তুই সামলাইতে পারবি না। মাল খাইয়া তুইতো ফুইল্লা এই রকম হইছো। সাথে সাথে দলের অন্য বানরেরাও অট্টহাসি দিয়ে বলে উঠল, দেখ শালা টিকটিকি একফোটা খেয়েই ফুইলা কুমিরের মত হইয়া গেছে, আর আমরা বোতলের পর বোতল খাচ্ছি আমাদের কিছু হয় না।
মাতাল বানরের দল কুমিরকে টিকটিকি ভেবে মাতলামি করে অট্টহাসি দেয়। নেশার ঘোরে কুমিরের মত সমূহ বিপদকে তারা ভয় পায়না। টিকটিকি ভেবে হেসে উড়িয়ে দেয়। জঙ্গিবাদের মত বিপদকেও বিএনপি বর্তমান সরকারের নাটক হিসেবে জাতির কাছে প্রতিষ্টা করার নেশায় মত্ত। যেন রাত জেগে বোতল শেষ করে, পরদিন খবরে জঙ্গি বিরোধী সফল অভিযান দেখে চোখ কচলাতে কচলাতে সমস্বরে বলে ওঠে নাটক, নাটক, সবই নাটক।

এটার অবশ্য অন্য একটা কারন থাকতে পারে। যেমন ধরুন বাংলা ভাই, শায়খ আঃ রহমানদের রাষ্ট্রীয় মদদদানের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে বিএনপি জোট সরকারের বিরুদ্ধে। তাদের তৎকালীন মন্ত্রীসভার সদস্যদের সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ আছে। দেশের মানুষ একথা ভুলে যায়নি যে, বিএনপির আস্কারার প্রকাশ্য দিবালোকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজপথে " আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।" স্লোগান দিয়ে জঙ্গি সংগঠন মিছিল করেছিল। জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য বানিয়েছিলেন দেশটাকে। আর এখন সাধুবাক্য ব্যবহার করে বানী দিচ্ছেন। জঙ্গিবাদের সাথে আপনাদের যে ফুলশয্যা হয়েছিল, তার ফল হিসেবেই আজকের জঙ্গিবাদের জন্ম।

বিষয়টা অনেকটা ঐ চোর আর মুসুল্লির গল্পের মত। ফযরের নামায আদায় করতে আসা মুসুল্লিকেও চোর নিজের মত ভাবছে। বিএনপি'র এসব অসাড়, অপাংক্তেয় মন্তব্য জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানকে কোন করমেই বিতর্কিত করতে পারছে না। শুধু তাদের অবস্থান দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে জনগণের মনে তাদের এধরনের বক্তব্যকে নেশাতুর সংলাপ বলেই যায়গা করে নিবে। জনগণ কর্তৃক ধীরে ধীরে প্রত্যাখ্যাত হতে থাকবে।

জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে বক্তব্য প্রদান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দেউলিয়াপনাকে সামনে নিয়ে আসে। রাজনীতি যেহেতু জনগণের জন্য, জনগণের মাধ্যমেই করতে হয়, সেহতু জনগণের পক্ষে অর্থাৎ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধেই বিএনপির কথা বলা উচিত। যদি সঠিক পন্থায় রাজনীতি তারা করতে চায়। দিকভ্রান্ত নাবিকের ন্যায়, রাজনৈতিক অপুষ্টিতে ভোগা অনভিজ্ঞের মত বক্তব্য বিএনপি'কে শুধু জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নই করবে না, ধীরে ধীরে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীতে পরিনত করবে।

বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সফলতা তাদের চোখে পরে না। সিলেটের জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহল থেকে নিজেদের জীবনের ঝুকি নিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ জনগনকে সরকার উদ্ধার করতে পেরেছে, তা তাদের স্বস্তি দেয় না।

ক্ষমতার রাজনীতিতে বিরোধীতা থাকবে। কিন্তু ক্ষমতা যাওয়ার জন্য জনগণের নিরাপত্তাকে যখন কোন রাজনৈতিক দল গুরুত্ব দেয় না, তখন সেই রাজনৈতিক দল ক্ষমতার প্রেমেই অন্ধ্য বলা যায়। জনগণের প্রেম বা দেশপ্রেমে নয়।

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের চলমান সংগ্রামের সাথে, যুদ্ধের সাথে জনগণ একাত্ন আছে। আর জনগনকে সাথে নিয়েই ভয়ঙ্কর জঙ্গিবাদকে সরকার মোকাবেলা করবে ইনশাল্লাহ।