বন্যা ও আমরা

মুহাম্মদ হেলাল উদ্দিন
Published : 26 August 2017, 08:20 PM
Updated : 26 August 2017, 08:20 PM

বন্যা বরাবরই অামার জন্য ভয়ের ব্যাপার। বন্যার একটা করুণ কাহিনী দিয়েই শুরু করি। একবার বন্যায় সবার বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। সবাই অনেক উঁচুতে বাঁশ দিয়ে মাচা বেঁধে সেখানে বাস করতে শুরু করেছে। এক পরিবারে ১ বছরের ছোট্ট একটা শিশু ছিল।একদিন সেই শিশুকে তার মা 'হিসু' করানোর সময় শিশুটি নিচে পড়ে গেল। শিশুটির বাবা পাশেই ত্রিফলা নিয়ে মাছ মারার জন্য তীক্ষ্ণ নজর রাখছিল। শিশুটি যে পড়ে গেছে তার মা তাতে হতবিহ্বল হয়ে পড়ায় কোনো কথা বলতে পারেনি। হয়তো পতনের শব্দটিও দীর্ঘ ছিলো না।

শিশুটির বাবা যেই শিশুটির পানিতে নড়াচড়া দেখল ভাবল অাহারে বড় মাছ একটা! তিনি তার ত্রিফলা দিয়ে যেটা গেঁথে অানলেন তা দেখে তার কী অবস্থা হয়েছিল তা না বললেও চলে।

২.
১৯৯৮ সালের বন্যার সময় অামি খুবই ছোট। তবে ওই বছর অামি অার অামার ছোট চাচা এতো মাছ মেরেছিলাম যে কখনো ভুলে যাবার নয়। কারেন্ট জালের ছিদ্র যে কয়টা তত মাছ অাটকা পড়তো জালে। খুলতে খুলতে হয়রান হবার দশা।

সে বছর অামাদের বাড়িতেও পানি উঠল। কী যে ভয় পেয়েছিলাম। ছোট চাচাকে বলেছিলাম, কেউ মরলে কবর দিবো কেমন কইরা? কোথাও তো মাটি নাই।

চাচা বলেছিলেন, ভাসিয়া দিবো।

অামি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কাক-চিল-শকুন ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে অামার মরা দেহ খাবে? কী ভয়ঙ্কর!

৩.
২০০৪ সালের বন্যায় অামি ক্লাস সেভেনে পড়ি। সে বছরের মাছ মারাই অামার জীবনের শেষ মাছ মারা। অামি অার ছোট চাচা বড়শি দিয়ে মাছ মারতাম। একটা ছিপের মধ্যে ২টা করে বড়শি লাগানো থাকতো, অার অাধার ( পানি দিয়ে মাখানো পাউরুটির দলা) লাগানো হতো ২টা বড়শিতেই। পানিতে সেই বড়শি ফেলা মাত্র মাছ টোন পানির নিচে যেত অার সঙ্গে সঙ্গে বড়শি উঠানো মাত্র ২ টা করে পুঁটি মাছ উঠে অাসতো। যারা বড়শি দিয়ে পুঁটি মাছ মেরেছেন তারাই শুধু এর মজা বুঝতে পারবেন। প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টা করে পুঁটি মাছ মারতাম অার পরে গরম তেলে সেগুলো কাঁটাসহ ভেজে খাওয়া! অাহা! কোথায় গেল সেই দিন?

৪.
কয়েকদিন অাগে বাড়িতে অাসলাম কোমর পানি ভেঙে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল তখন বন্যার সময় দিনে ৪-৫ বার গোসল করতাম। অার এখন কোমর পানিতে নামতেই ভয় করে, জ্বর অাসবে না তো?

৫.
ছোটবেলায় অামাদের বিচি কলা গাছ ছিলো অনেক। বন্যার সময় সেই বিশাল বিশাল বিচি কলা গাছ কেটে ভেলা বানাতাম। সেই ভেলায় করে অামরা শাপলা তুলতাম। পুকুরের মধ্যে যে শাপলা গুলো থাকতো সেগুলো হতো সবচে বড় বড়, একেকটা ১০-১২ হাত। ২-৩ টা দিয়েই বাড়ির সবার তরকারি হয়ে যেত।

৬.
একবার ভেলা নিয়ে অনেক দূর চলে গেলাম সঙ্গে ছিল সিগারেট। বাজার থেকে অনেক ভয়ে ভয়ে সিগারেটটা কিনে এনেছিলাম। খুবই খুশি মনে ভেলা বাইতে বাইতে গেলাম। অনেক দূরে যাবার পর মনে হলো যাক এখন অার কেউ দেখবে না। পকেট থেকে সিগারেটটা বের করে দেখলাম, নাহ! অক্ষতই অাছে। খুবই খুশি হলাম। কিন্তু তারপরই মনে হলো ইস্ সিগারেট ধরানোর জন্য তো ম্যাচ নিয়ে যাইনি!  নিজের বোকামির জন্য রাগে সিগারেটটা কুঁচি কুঁচি করে ছিঁড়ে পানিতে ফেলে দিলাম।

৭.
একবার বন্যার মধ্যে এক বয়স্ক মহিলা মহিলা অামাকে বললেন, গ্যাদা, অামারে ওইখান থিকা কয়েকডা নাল(লাল) হাবলা (শাপলা) তুইল্যা অাইন্না দেও। অামি তুমার ফুবু হই। তুমার দাদিরে হাবলা দিমু গো।

অামি মনে মনে ভাবলাম অামার সব ফুপুই তো বোরখা পরে, এই বোরখা ছাড়া মহিলা কে?

অামি বললাম, অাপনি অামার কোন ফুপু?

' অাছি গো অাছি, অামি তুমার ফুবু! দেও গ্যাদা হাবলা তুইল্যা অাইনা।'

অামি হাফ-প্যান্ট খুলে অনেক দূর সাঁতার কেটে ওনাকে শাপলা তুলে এনে দিলাম।

শাপলাগুলো উনার হাতে দেওয়া মাত্র উনি সেকি দৌড়।

তখন অামার মনে হলো মহিলার মিথ্যা বলার কী দরকার ছিলো? মিথ্যা না বললেও তো উনাকে অামি শাপলা তুলে এনে দিতাম।