জুয়ারিদের হাতে দেশের টাকা ও কিছু অপ্রিয় জিজ্ঞাসা !!

ফখরুল ইসলাম হিমেল
Published : 13 March 2016, 07:21 PM
Updated : 13 March 2016, 07:21 PM

রিজার্ভ সাধারণত রাখা হয় দেশের উন্নয়ন কাজে পাওনা বিদেশি ঠিকাদারকে পরিশোধ করার জন্য। আর, এখন সেই টাকা দেশের মানুষের উন্নয়নে ব্যবহৃত না হয়ে হয়েছে জুয়ারিদের বিনোদনের নিছক মাধ্যম হিসেবে। সাধারণ মানুষের সাথে প্রবঞ্চনাই হল।

এখন দৃষ্টি দেয়া যাক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুরক্ষিত রিজার্ভের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরি (অনলাইন হ্যাকড) হওয়ার ঘটনাটির দিকে। ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া অর্থের শেষ ঠাঁই হয়েছে জুয়ার আসর ক্যাসিনোতে। সেই অর্থ দিয়ে তিনটি ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা হয়েছে।

রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে এই অর্থ তাদের ক্লায়েন্টদের মাধ্যমে চলে যায় স্থানীয় এক ফরেন এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীর কাছে। ওই ব্যবসায়ীর ফরেন এক্সচেঞ্জ কোম্পানি 'ফিলরেমেতে' ওই অর্থ ফিলিপিনো মুদ্রায় কনভার্ট করা হয়। ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার স্থানীয় মুদ্রায় বিনিময়ের পর দাঁড়ায় ৩৭০ কোটি পেসোতে।

এরপর ওই অর্থ চলে যায় তিনটি বড় ক্যাসিনোতে। এগুলো হচ্ছে- সোলারি রিসোর্ট এ্যান্ড ক্যাসিনো, সিটি অব ড্রিমস এবং মাইডাস। পুরো অর্থ খরচ করে সেখানে জুয়া খেলার জন্য চিপস কেনা হয়। জুয়া খেলা শেষে ওই চিপস আবার ফিলিপিনো মুদ্রায় কনভার্ট করে সেই অর্থ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে হংকংয়ের বিভিন্ন এ্যাকাউন্টে।

ঘটনাটির গোঁড়ার দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি মাসের ১ বা ২ তারিখে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ডলার চুরি করা হয়। আন্তর্জাতিক হ্যাকার চক্র বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট কোড হ্যাকড করে ফেডারেল রিজার্ভকে নির্দেশনা দেয় এ টাকা ফিলিপিন্সের একটি ব্যাংকে ট্রান্সফার করার জন্য। এক্ষেত্রে তারা অর্থ স্থানান্তরের সব নিয়মকানুন অনুসরণ করে।

ফেডারেল রিজার্ভে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্টটি মূলত দেশের অভ্যন্তরে উন্নয়ন কাজে জড়িত বিদেশী ঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধে ব্যবহার করা হয়। হ্যাকাররা সেটি নিশ্চিত হয়েই ওই এ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ পাচারের পরিকল্পনা করে। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণ শোধের কথা বলে ৮১ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয় এই হ্যাকার চক্র। এদের মধ্যে ভাস্কুয়েজের এ্যাকাউন্টে ২৫ মিলিয়ন ঢুকেছে কাঁচপুর, মেঘনা-গোমতী দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ প্রকল্পের জন্য জাইকার কাছ থেকে নেয়া ঋণ শোধের কথা বলে। আইটি প্রফেশনাল লাগ্রোসাসের এ্যাকাউন্টে ৩০ মিলিয়ন ডলার নেয়ার ক্ষেত্রেও জাইকার ঋণ শোধের কথা বলা হয়। এখানে দেখানো হয় ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প। একটি আইপিএফএফ প্রকল্পে কনসালটেন্সি ফিস হিসেবে ক্রুজের এ্যাকাউন্টে নেয়া হয় ৬ মিলিয়ন ডলার। আর ভেড়ামারা কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি ফি হিসেবে বাকি ১৯.৯৯ মিলিয়ন ঢোকে ভারজারার এ্যাকাউন্টে।

ফেডারেল রিজার্ভ থেকে প্রথম অর্থ যায় যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ব্যাংকে। এ ব্যাংকগুলো হচ্ছে ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, সিটি ব্যাংক এবং ওয়েলস ফার্গো ব্যাংক। ওই তিনটি ব্যাংক থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার (৮১ মিলিয়ন) ট্রান্সফার করা হয় আরসিবিসির চারটি ব্যাংক এ্যাকাউন্টে।

আশ্চর্যের বিষয়, ওই এ্যাকাউন্টটিও ওই দিনই খোলা হয়। অথচ ব্যাংকের এই নতুন এ্যাকাউন্টগুলোতে কোথা থেকে কিভাবে অর্থ আসছে, তা নিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোন প্রশ্ন করেনি। জালিয়াত চক্র ব্যাংকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার লেনদেন করলেও তাদের জানা কোন আয়ের উৎস নেই, যা দিয়ে তারা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের যথার্থতা প্রমাণ করতে পারে। এদের মধ্যে কিম উং ছাড়া বাকি পাঁচজনের আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং চক্রের সঙ্গে সরাসির যোগাযোগ রয়েছে। এই তথ্যগুলো তাদের দায়কে অবশ্যই ইঙ্গিত করে।

প্রতিষ্ঠানের নামের বানান ভুলের কারণে শ্রীলঙ্কায় যাওয়া ২০ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬০ কোটি টাকা। বানান যাচাই করতে জানানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। এরই মধ্যে ঘটনাটি আলোচিত হওয়ায় অর্থগুলো আটকে দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

চুরি হওয়া টাকার মধ্যে ২০ মিলিয়ন ডলার শ্রীলঙ্কার একটি এনজিওর নামে ছাড় করতে আদেশ দেওয়া হয়। আদেশে এনজিওটির নামের শেষে লেখা হয় Foundation শব্দটি। ওই এনজিওটি শ্রীলঙ্কান ভাষার উচ্চারণ মিল রাখতে গিয়ে Foundation শব্দটি লেখে Fandation।

শেষের শব্দের বানান না মেলায় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ ছাড় করেনি। সুইফট প্রক্রিয়ায় লেনদেনের সময় প্রতিষ্ঠানের নামের ক্ষেত্রে হুবহু লিখতে হয়। দাড়ি, কমা, কোলন পর্যন্ত মিলিয়ে দেখা হয়। নামের বানান যাচাইয়ে ব্যাংকিং রীতি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের সঠিক নাম লেখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ভাগ্যিস হ্যকাররা বানান ভুল করেছিল। নেহায়ত, ভাগ্যের জোরেই এই অর্থ বেঁচে যায় বাংলাদেশের, না হলে এত বড় একটা নিখুঁত কাজে বানান ভুল হওয়ার মত শিশুর কাজটি সম্ভব হতো না!

এর মধ্যে ৮ ফেব্রুয়ারি চীনের নববর্ষের দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম জানতে পারে তাদের অর্থ ফেডারেল রিজার্ভ থেকে লুট করা হয়েছে। ওই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের কাছে জরুরী বার্তা পাঠায় ওই অর্থ ছাড় না করা এবং ফেরত দেয়ার জন্য। যদি ওই ফান্ড ট্রান্সফার করা হয়, তা হলে ওই অর্থ যেন ফ্রিজ বা স্থগিত রাখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানায়, জালিয়াতি করে অর্থ স্থানান্তরের অর্ডার দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওই দিন ফিলিপিন্সে সরকারী ছুটি থাকায় এ ব্যাপারে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।

পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে রিজাল কামার্শিয়াল ব্যাংক সুইফট বার্তা পায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। যাতে সঠিক তদন্তের জন্য অর্থ ছাড় বন্ধ এবং এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ততক্ষণে কাজ যা হওয়ার হয়ে গেছে। ৮১ মিলিয়ন ডলার থেকে ইতোমধ্যে ৫৮.১৪ মিলিয়ন ডলার তুলে নেয়া হয়েছে ব্যাংকটির জুপিটার স্ট্রিট শাখা থেকে। তখন ফিলরেমের এ্যাকাউন্টে ১৫.২ মিলিয়ন ডলার, ইউলিয়াম গোর এ্যাকাউন্টে ৪২.৯৩ মিলিয়ন ডলার এবং ফিরেমের কাছে আরও ২০ মিলিয়ন ডলার চলে গেছে।

ঘটনাটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এটি দীর্ঘ পরিকল্পনার। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিচালনা ব্যবস্থা সম্পর্কে হ্যাকারদের খুব স্বচ্ছ ধারণা ছিলো বলে মনে করছেন সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, হ্যাকাররা ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট কারও কারও ওপর নজরদারির মধ্য দিয়ে এই ধারণা অর্জন করে থাকতে পারেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্স এক প্রতিবেদনে এ কথা জানিয়েছে। বিপুল অংকের এই অর্থ হাতিয়ে নিতে হ্যাকারদের প্রথমে অর্থ স্থানান্তরের আদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে খুব ভালো করে জানতে হয়েছে, যেন প্রতারণা করতে গিয়ে তারা কোনও প্রশ্নের মুখে না পড়েন।

প্রশ্ন রয়েছে বিশ্বব্যাংকের আইটি প্রধান রাকেশ আস্থানাকে ঘটনা তদন্তে নিয়োগ প্রসঙ্গেও। তার নেতৃত্বে বিদেশী এবং দেশী আইটি বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। বাংলাদেশের সকল ব্যাংকের আইটি ব্যবস্থাপনায় কোন ঘাটটি আছে কিনা, বিশেষজ্ঞরা সেটা চিহ্নিত করবে। ভালো কথা, তবে কি আমাদের এই সক্ষমতা টুকু নেই?
হঠাৎ করেই একজন ভারতীয় নাগরিককে আইটি কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মাঝেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী পুলিশ ও র‌্যাবের আইটি এক্সপার্ট হিসেবে বাংলাদেশীরাই রয়েছে। এর বাইরেও বুয়েটসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিকমানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে আইটি এক্সপার্ট রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত অনেক আইটি ফার্মেও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল কম্পিউটারেই একটি বিশেষ সফটওয়্যার ইনস্টল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সফটওয়্যারটি রাকেশ আস্থানার তৈরি। এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি খাত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনাকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে।

গত ৮ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে প্রথম দিনই কাজ শুরু করেন রাকেশ আস্থানার টিম। প্রথম দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল ফ্লোরের ইন্টারনেট পয়েন্ট লাইন চেক করে। কোন পয়েন্টে ইন্টানেটের স্পিড কত তা লিপিবদ্ধ করা হয়। এসময় টুকে নেওয়া হয় প্রতিটি পয়েন্টের আইপি এড্রেস ও সিরিয়াল নম্বর। এতে করে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়টি কতটা জোরালো ভাবে দেখা গেল, এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।

কথা হল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও যদি টাকা অরক্ষিত থাকে, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিয়েই। এটিএম বুথ জালিয়াতি দিন কয়েক আগের ঘটনাও প্রশ্নটিকে আরও সামনে এনেছে। আসলে সাইবার জালিয়াতি থেকে আমারা কতটা নিরাপদ?

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি হওয়ার কারণ অনুসন্ধান, দেশি-বিদেশি দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ এবং খোয়া যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকারকে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিতে হবে। আশা করব এই কাজে তদন্তের ন্যায্য স্বার্থ রক্ষা ব্যতিরেকে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এই ঘটনায় জনগণের মধ্যে যেন অহেতুক ভুল-বোঝাবুঝির কারণ না ঘটে। এই বিষয়ে প্রাথমিক রাখঢাক কাম্য ছিল না। সংশ্লিষ্টরা সরকারের আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে জানাতেও বিলম্ব করেছে। এমনকি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন যে তাঁকেও বিষয়টি জানানো হয়নি। যদিও তিনি টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা এ কাজে জড়িত থাকার বিষয়টি নজরে আনা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে স্বীকার করেছেন যে, তাদের কম্পিউটার সিস্টেমে দুর্বলতা ছিল এবং এ সমস্যা পুরোপুরি ঠিক করতে দু'বছরের বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।

এটি শুধু একটি ঘটনাই নয়, চিন্তার ভাঁজ ফেলতে পারে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থায়। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি অনলাইন ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকদের আস্থার সঙ্কট তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা এড়াতে তথ্যপ্রযুক্তির হালনাগাদ সংস্করণ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অনলাইনভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা যত সম্প্রসারিত হবে এ ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ততই বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এক্ষেত্রে গ্রাহক আস্থা ধরে রাখতে আর্থিক খাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।