দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়, রইলো না-৫

মওলা ই কুদ্রত
Published : 9 May 2012, 06:15 PM
Updated : 9 May 2012, 06:15 PM

কমলাপুর রেলস্টেশন যখন তৈরী হচ্ছিল, আমরা সেই নির্মান কাজ দেখতে যেতাম কারন তা আমাদের মতিঝিল কলোনী লাগোয়া, দেখে চমকৃত হতাম! এটা বোধ হয় ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে হবে, নির্মীয়মান স্টেশনের চারদিকেই ছিল ঘন বৃক্ষরাজি ও সমৃদ্ধ গ্রাম! স্টেশনের ঠিক পেছনটা থেকেই শুরু হত বিশাল বিল ও ঝিল, বর্ষাকালে থৈথৈ পানিতে তা থাকতো টইটুম্বুর!

এদিকে গ্রামের মধ্য দিয়ে উত্তরে একদিকে মদনবাবুর আম বাগিচা (যেখানে এখন শাহজাহানপুর ও গোরান, সেখানে শুনেছি কবি বেনজীর আহমেদের বাড়ী ছিল! আমার ছোট ভাই প্রয়াত ইঞ্জিনিয়ার সেখানেই জন্ম নেয় কারন আমরাও কলোনী হবার আগে সেখানে থাকতাম আমার খুব ছেলেবেলাতে, ভাল মনে পড়ে না!), মাঝামাঝি বাসাবো ও কিছুটা দক্ষিন দিকে ছিল কমলাপুর!

দক্ষিন কমলাপু্রে এমন কি ৭১-র স্বাধীনতার পরেও আমি গ্রামের মেলা হতে দেখেছি! কমলাপুর রেলস্টেশনের রেল লাইন ধরে সোজা দক্ষিন দিকে হেটে আমরা গেণ্ডারিয়া ধুপখোলা মাঠে ফুটবল খেলতে যেতাম, এই বিস্তীর্ণ এলাকাতে পথে শুধু একটা জাহাজ আকৃতির বিল্ডিং ছিল, আর কোন স্থাপনা দেখিনি!

তখনো এখনকার বিশ্বরোড হয়নি (এই রোডটি বাংলাদেশ আমলে সম্ভবতঃ এরশাদ সাহেবের সময় তৈরী হয়)! তখন পাকিস্তানী আমলে নতুন তৈরী হওয়া কমলাপুর রেল স্টেশনের চারপাশে ছিল নিখাদ পল্লী এলাকা!

কমলাপুরে, আরো একটু পূর্বে গ্রামের মধ্যে একটা অট্টালিকা দেখতাম, শুনেছি সেটা বাংলাদেশের প্রথম চিত্র পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের বাড়ী ছিল! চারপাশে ছিল কাঁচা পাকা ও গ্রাম্য বাড়ী, সাথে ঘন সবুজ আম, জাম, কাঠাল ও অন্যান্য নানা গাছের সারি! এসব গ্রামের পেছনে, অর্থাৎ আরো পূর্বে ছিল বিশালাকায় বিল ও ঝিল! সেই বিল পেরিয়ে মান্ডা আর তা পেরিয়ে শীতলক্ষ্যার তীরে পৌছুনো যেত! আমি ও আমার কয়েক বন্ধু একবার ছেলেবেলায় বাসাবো কদমতলী দিয়ে নেমে বিলের ধান খেতের ভেতর দিয়ে হেটে হেটে মান্ডার সেই মন্দির পেরিয়ে শীতলক্ষ্যার তীরে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম, ফেরার পথে ওই বিলের থেকে জেলেদের ধরা মাছ কিনে নিয়ে এসেছিলাম! তখন ওই বিলের ভেতর দিয়ে শুধু মাত্র শীতকালে জমির আইল দিয়ে হাটা যেত, কোন পথ ছিল না, বর্ষাকালে থৈ থৈ করতো অথই পানি!
বাসাবো আর কমলাপুরের মাঝামাঝি একটি রাস্তা ছিল, কাঁচা, সেখান দিয়ে গেলে উঠতাম বৌদ্ধ মন্দিরে!

দেয়ালে ত্রিশরন মন্ত্র লেখা ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারটি ছিল বিরাট এলাকা নিয়ে, সাথে অনেক আমলকি, কামরাঙ্গা আর নানা ধরনের গাছ ও দীঘি! সেখানে বিপুল সংখ্যায় গাছপালা থাকায় পাখীদের ভীড়ও ছিল দেখার মতো! এলাকাটাকে তখনও সবুজবাগ বলতো! সেখানে সম্ভবতঃ কিছু বৌদ্ধ শ্রমনও থাকতেন! কিন্তু এখনকার মতো এত জনাকীর্ণ ছিল না ওই বৌদ্ধ বিহারটি! একটা অদ্ভুত শান্ত, মৌন কিন্তু ভাবগম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করতো সেখানে! সর্বক্ষণ পাখীরা নানা সুরে ডেকে যেত!

বৌদ্ধ মন্দিরটি পার হলেই ছিল বেগবান স্রোতের বিশাল ঝিলের ওপরে একটি কাঠের সেতু, চার পাশে ছিল সেই একই ঝিল যা কিনা মান্ডার বিলের সাথে মিশেছিল!

১৯৭১ সালের আগস্ট -সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই রাস্তা দিয়ে অস্ত্রপাতি নিয়ে অনেকবার যাওয়া আসা করেছি! তখনও প্রকৃতির ওই একই চেহারা ছিল, এমন কি ১৯৭৬ সালে যখন আমি জাসদের গণবাহিনীর সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলাম, একই রকম সীমানা দেখা যায়না এমন একটি ঝিলের কোনে মুগদা পাড়ার এক বাড়িতে আমাদের ব্রিফ করতে এসেছিলেন আব্দুল্লাহ সরকার, নির্দেশ দিচ্ছিলেন যে ১৯৭৬ সালের ৩১ মার্চ মিছিল বের করতে হবে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে মার্চ মিছিল হিসেবে পরিচিত, এটা তিনি আমাদের বলেছিলেন পার্টির সিদ্ধান্ত হিসেবে যাতে কর্নেল তাহের কে মুক্ত করা যায়!

পার্টিগত ভাবে খুব জুনিয়র হলেও মার্ক্সবাদ তখনই বিস্তর পড়ে ফেলেছিলাম, তাইই প্রতিবাদ করে বলেছিলাম গণ-বাহিনীর আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে "সারফেস" করা ঠিক হবে না, তাতে সরকার "কম্বিং" অপারেশনের সুযোগ পাবে! আমার কথা পরে ফলেছিল, আর সম্ভবতঃ জাসদ নেতারা ওই মিছিলটি দিয়ে পার্টিকেই স্যাবোটাজ করেছিলেন!

তখন জাসদ ঢাকা শহর পুর্বাঞ্চলীয় গণ-সংগঠনের নেতা ছিলেন পরে জাতীয় পার্টির সময়ে ঢাকার ডেপুটি মেয়র ও এখন বিএনপির ঢাকা মহানগর সদস্য সচিব জনাব আব্দুস সালাম! জাসদ গণ-বাহিনীর কম্যান্ড দেখতেন কেন্দ্রীয় ভাবে গাজী মতিউল হক পেয়ারু (গত ৪০ বছর ইউরোপে বসবাস রত) ও পুর্বাঞ্চলীয় এলাকার দ্বায়িত্বে ছিলেন সুসংগঠক ও প্রজ্ঞাবান নেতা গাউস ভাই (কয়েক বছর আগে ডিআইটি এক্সটেনশন রোডে ছোটো ভাইয়ের গুলিতে নিহত!)!

সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময় এই মিটিং এর জায়গাটি এমন ভাবে বাছা হয়েছিল যে প্রয়োজনে আমরা যেন নিরাপদে সরে যেতে পারি কারন তখন ও ওই পুরো এলাকা জুড়ে বিশালায়তনের বিল আর ঝিল!

বহুদিন পরে এসে আমরা বুঝতে পারি যে জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আসলে বাংলা দেশের স্বার্থ বিরোধীদের দ্বারাই পরিচালিত ছিল, কিত্নু আমার চাইতেও হাজার হাজার মেধাবী তরুনরা দলে দলে যোগদান করেছিল দেশের ভাল কিছু একটা করা যাবে সেই প্রত্যাশায়! জাসদ করতে গিয়ে হাজার তরুন প্রান ঝরে গেছে, ক্ষতি হয়েছে লাখো তরুনের, কিন্তু আজও বিচার হয়নি এই পার্টিটির নেতাদের যারা তরুনদের বিভ্রান্ত করেছিলেন ও মরনের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন বিপ্লবী রোমান্টিসিটির সবক দিয়ে! তারা পরে ক্ষমতার হালুয়া রুটি নিয়েও কাড়াকাড়ি করেছেন, এখনো করছেন! সুযোগ পেলে পরে এ বিষয়ে আরও লিখবো!

আজ এই পঞ্চাশোর্ধ জীবনে সময় পেলে কখনও বা রাত্রির নক্ষত্র-জ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, অথবা কালবোশেখির ঝড়ের শব্দে কান পাতি, মনে মনে একাই ভাবি কারন এ ভাবনার এখন হয়তো আর কোন সাথীই নেই কোথাও! ভাবি য়ামার বা আমাদের ঢাকার সেই গ্রামীন মাধুর্যের কথা, ভাবি আমার বা আমাদের মতো সে সময়ের তরুনদের বিপুল সম্ভাবনার কথা আর তার সাথে এখনকার নিজকে মেলাই, করুনা করতে ইচ্ছে করে নিজেকে!

এক কথা লিখতে গিয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের ছেলেবেলা, কৈশোর আর যৌবনের স্মৃতিরা যে বড় বিশৃঙ্খল, সে সব যে আমি বাঁধতে পারিনে কোন শৈল্পিক বিনি সুতোর মালায় কারন ওরা যে একের ভেতর অনেকে! দিবা রাত্রিই আসে আর পালিয়ে যায়, আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়!