ডিপ্লোমা বাণিজ্য

হিমালয়া দেবনাথ
Published : 14 May 2015, 05:45 PM
Updated : 14 May 2015, 05:45 PM

আমি জনসংখ্যাকে জনশক্তি বলতে রাজি নই কারণ আমরা সকলেই জানি। কি এমন শক্তি নিহিত আছে যে জনসংখ্যাকে জনশক্তি বলতে হবে? জনসংখ্যাকে তখন জনশক্তি বলা যায় যখন তারা স্বয়ং উৎপাদনক্ষম ও উপার্জনক্ষম হয়। অল্প সময়ে, অল্প পরিশ্রমে, স্বল্প খরচে উৎপাদন ও উপার্জন করার জন্য জনশক্তির মাঝে যখন দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তখন জনশক্তিকে দক্ষজনশক্তি বলা হয়। আর দক্ষ জনশক্তিকে কোন দেশের জনসম্পদ বলা হয়।

জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি  শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলন করা হয়েছে কারিগরি শিক্ষা- এসএসসি ভোকেশনাল, ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং  তাছাড়া রয়েছে স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ কোর্স। একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে কারিগরি শিক্ষা দক্ষ জনশক্তি গঠনে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে  কিন্তু কারিগরি শিক্ষার যে মান তা চিন্তা করলে গা শিউরে ওঠে। ধরুন, চার বছর মেয়াদী  ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং  এর কথা। ৪ বছরে প্রতি ছয় মাসে ৮টি সেমিস্টার। প্রাইভেট / ব্যক্তি মালিকানাধিন ইন্সিটিউট এ  প্রথম ৩ টি সেমিস্টারের পরীক্ষায় পরীক্ষার রুমে  ডিউটি, খাতা দেখা, মুল্যায়ন ও ফলাফল তৈরি  ইত্যাদি  পুরো প্রক্রিয়ার দায়িত্ব ন্যাস্ত থাকে প্রতিষ্ঠানের উপর। বাকি সেমিস্টারগুলো সরাসরি কারিগরি বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করে।  পরীক্ষার হলে শিথিল  ডিউটি, খাতা দেখায় ছাড় তারপরেও ফলাফলে দেখা যায় পাশের হার খুব কম (২০% থেকে ৩০%)। মজার ব্যাপার হল এই পাশের হার  ১০০% এ উন্নীত করা হয়। যার অর্থ দাঁড়ায় ৩য় সেমিস্টার পর্যন্ত কোন ছাত্রছাত্রী ফেল করে না। কিন্তু ৪র্থ পর্বে বোর্ডের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পর যখন ফল প্রকাশ হয় তখন দেখা যায় পাশের হার গড়ে  ১৫%থেকে ৫০%। কারিশমাটা কোথায়? আরেকটু গভীরে যাব। প্রাইভেট পলিটেকনিকগুলোতে মূলত ভর্তির সময় থেকে বাণিজ্য শুরু হয়। একই টেকনোলজিতে ভর্তির জন্য বিভিন্ন ছাত্রের সাথে বিভিন্ন টাকার অ্যামাউনটে চুক্তি করা হয়। এই চুক্তি হতে পারে কারো সাথে ৯০ হাজার টাকায়, কারো সাথে ১ লাখ ১০ হাজার, ১ লাখ ৩০ হাজার,১ লাখ ৪০ হাজার ইত্যাদি। মোদ্দা কথা একই মাল বিভিন্ন খরিদ্দারের কাছে বিভিন্ন দামে বিকান। সরকার এদিক থেকে খুব উদাসীন। কোন নিয়ন্ত্রন নেই, যে যার মতো পারছে ব্যবসা করে যাছে। ছাত্র ভর্তি নিয়ে নো টেনশন, ছাত্র প্রতি ভর্তি কমিশন আছে বিভিন্ন মাত্রায়। সেদিক হতে ছাত্র- শিক্ষক সবাই লাভবান। শিক্ষক বলতে স্বল্প বেতনে পার্টটাইম / গেস্ট টিচার। খুব কম প্রশিক্ষক আছেন যারা পার্মানেন্ট। সেদিক হতেও বড় অঙ্কের টাকা সেভ করে প্রতিষ্ঠান লাভবান।

আর  প্রতিষ্ঠান/ প্রাইভেট পলিটেকনিক  বলতে ভাড়া করা কোন ভবন, যেখানে ক্যাম্পাস বলতে যা বোঝায় অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক  বিকাশের জন্য খেলার মাঠ, গাছপালা বাগান, জিম, লাইব্রেরী, ইনডোর গেম, সামায়িকি প্রকাশনা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রোভার, বিএনসিসি  ইত্যাদির লেশ মাত্র খুঁজে পাওয়া ভার।  ক্লাস করার জন্য পর্যাপ্ত রুম আর ল্যাবের বড়ই অভাব। এদের দেখে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় কি দরকার ছিল স্কুল -কলেজ – ভার্সিটিগুলো এত বড় এলাকাজুড়ে স্থাপন করার। জনসংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে সেখানে কিছু মানুষের বাসস্থানের ব্যাবস্থা করলে অন্তত স্থানের সংকুলান হতো। কিন্তু তাই কি সম্ভব ! মানুষ তো শেখে পরিবেশ থেকে। তাই ক্যাম্পাসের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাইভেট ডিপ্লোমার কথা কি বলব অনেক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির অবস্থা এর থেকে আরও করুন।

যেহেতু তাদের প্রশিক্ষকগণ পার্টটাইম সেহেতু ছাত্রছাত্রীরাও পার্টটাইম। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীরা খুব অনিয়মিত। আর পড়াশোনা না করে যদি পাশ করা যায় তাহলে কষ্ট করে কলেজে এসে লাভ কি। কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় হাতে-কলমে শেখার  জন্য যে যন্ত্রপাতি বা মেশিনারিজ এবং কাচামাল দরকার তা খুব প্রতিষ্ঠানের আছে । মেকানিক্যাল, টেক্সটাইল, মেরিন ইত্যাদি টেকনোলজিতে  ব্যবহারিকের জন্য যে সমস্ত ভারি মেশিনারিজ প্রয়োজন তা তারা স্থাপন করতে পারেনা কারণ ভাড়া করা ভবনে  এগুলো স্থাপনের অনুমতি মেলেনা। কদাচিৎ প্রতিষ্ঠান আছে যারা অল্প পরিসরে  নিজস্ব ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। রুম সংকটে এরাও  ভারী মেশিনারিজ স্থাপনে আগ্রহী হয় না ।  তাছাড়া  তারা কেবল ব্যাবসাটাই ভাল বোঝে।  তাই ব্যবহারিক ক্লাস ছাত্রছাত্রীদের নাগালের বাইরে থাকে। সাধারণ শিক্ষায় থিওরি পড়াশোনা বেশি থাকে কিন্তু এদের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয় এরা আরও মহা থিওরি পড়াশোনা করে। একজন ছাত্র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ে যদি মিলিং মেশিন, শেপার মেশিন, লেদ মেশিন চোখে নাই দেখে অপারেট তো দূরের কথা। এভাবে কি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব? সার্টিফিকেট টাকা দিয়ে কেনা যায় কিন্তু দক্ষতা, জ্ঞান টাকা দিয়ে কেনা যায় না তা অর্জন করতে হয়। 

এখন কারিশিমাটা জানব, ১ম, ২য়, ৩য় সেমিস্টারে  অধিক ছাত্রকে যদি তিন বিষয়ের বেশি ফেল করাই তাহলে তারা ড্রপ আউট হবে ফলে ইনকামের ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে।  যে ড্রপ আউট হবে সে তো আর বেতন দিয়ে পড়তে যাবেনা।  আমি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে তা নিশ্চয় চাইব না। তাই পাশ করিয়ে দেবার জন্য নির্দেশ করব।  ৪র্থ সেমি এর পরীক্ষা দিতে দিতে ৪ বছরের অর্ধেক সময় অর্থাৎ ২ বছর হয়ে যায় আর এ সময়ের মধ্যে এই ফি, ঐ ফি দিয়ে চুক্তির অর্ধেকের বেশি টাকা আদায় হয়ে যায়। ইতিমধ্যে আরও দুটি ব্যাচ ভর্তি হয়। তাই ইনকামের ধারাবাহিকতা ঠিক থাকে। যদি এক বা দুই বিষয়ে ফেল করাই সেক্ষেত্রে বিষয়প্রতি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আদায় করা হয় এবং বিনিময়ে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়।  এটাও  ইনকাম   টার্গেট ঠিক রাখতে সহায়তা করে। এভাবে প্রাইভেট পলিটেকনিকগুলো প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নেয়।  প্রশ্ন হতে পারে তারপরেও  ছাত্রছাত্রীরা কেন এত বেশি ফেল করে। একটা কারণ উপরে বলা হয়েছে বাকিটা এরকম…।

ধরুন আপনার সন্তান যখন অষ্টম শ্রেণি পাশ করে নবম শ্রেণিতে উঠবে তখন নিশ্চয় আপনি হুট করে সিদ্ধান্ত নেবেন না, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিবেন আপনার সন্তান বিজ্ঞান না বাণিজ্য না মানবিক বিভাগে পড়বে। কিন্তু আমরা অবিভাবকরা এমন যে সন্তান জেনারেলে ভাল করছে না অতএব ভোকেশনালে পড়াই। কিন্তু একবারও ভাবিনা যে ভোকেশনালে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির মতো সাবজেক্ট রয়েছে। এস এস সি তে ভাল করেনি অতএব ডিপ্লোমা পড়াই এখানেও ভাবিনা যে ডিপ্লোমার পড়াশোনা বিজ্ঞান বিষয়ক পড়াশোনা। আর এমন অবস্থায় ঐ ছাত্র না পারে গিলতে না পারে উগরে দিতে। সঙ্গত কারনে ছাত্র পরীক্ষায় ফল খারাপ করে। মধ্যে পড়ে আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয় ব্যাঙের ছাতার মতো যত্র তত্র গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট পলিটেকনিকগুলো।   যদি প্রাইভেট পলিটেকনিকগুলো ইনকামের চিন্তা না করে  প্রথম থেকে ডিপ্লোমা সম্পর্কে ছাত্র এবং ছাত্রের অবিভাবককে সচেতন করার চেষ্টা করত তাহলে আমরা দক্ষ মানুষ পেতাম।

দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কারিগরি শিক্ষার কোন বিকল্প নেই কিন্তু আমাদের সচেতন হওয়া উচিৎ এই সমস্ত প্রাইভেট পলিটেকনিকগুলোর ব্যাপারে। তা না হলে আমাদের সন্তানেরা কারিগরি শিক্ষার নামে প্রতারিত হবে। শিক্ষা নিয়ে একটি মহল এভাবে ছিনিমিনি খেলবে তা মেনে নেওয়া অনেক কষ্টের। সরকারের উচিৎ প্রাইভেট পলিটেকনিকগুলোকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে নিয়মিত মনিটরিং এর আওতায় আনা। তাহলে অনেক সাধারণ পরিবারের সন্তানেরা এদের প্রতারণার হাত থেকে যেমন মুক্তি পাবে তেমনি শিক্ষার মানও অনেকটা নিশ্চিত হবে। কোন সরকারের কাছে এমন প্রত্যাশা করছি? খোদ সরকারি পলিটেকনিকের যে অবস্থা তা বলার মত নয়। যা মেশিন পাতি আছে তাও  পরিচালনার অভাবে নষ্টপ্রায়। সামনে ডিপ্লোমার অ্যাডমিশনের সময় তাই আমরা যেন ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেই, প্রতিষ্ঠান দেখে, ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে তবেই ভর্তির সিদ্ধান্ত নেব।

আমার দেখা  যন্ত্রপাতি- মেশিনারিজ  সমৃদ্ধ ভাল মানের কয়েকটি প্রাইভেট টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান যেগুলোর নাম উল্লেখ করার মতো যেমন ঢাকার মঠস, জার্মান টেকনিক্যাল, বাংলাদেশ- কোরিয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, এস ও এস টেকনিক্যাল, কারিতাসের টেকনিক্যাল, দিনাজপুরের নভারা টেকনিক্যাল, খুলনার হোপ পলিটেকনিক  অ্যান্ড টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট ও  বিটিএস।