‘সত্যায়িত’: ঔপনিবেশিক পদ্ধতির চর্চা বন্ধ হোক

হাসান মাহমুদ আলিফ
Published : 7 Feb 2018, 02:36 AM
Updated : 7 Feb 2018, 02:36 AM

কিছুদিন আগে একটা সরকারি চাকরির জন্য আবেদনপত্রের সাথে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র সহ প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র পাঠাতে হবে। তবে শর্ত একটাই, কাগজপত্র সমূহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা দ্বারা সত্যায়িত করতে হবে। সত্যায়িত করার আবার একটি পদ্ধতি আছে, উক্ত কর্মকর্তার নাম লেখা একটি সিলমোহর থাকবে এবং সিলের উপর উনি কলম দিয়ে লিখে দিবেন 'সত্যায়িত'। এটা করলেই আপনার সব সনদ 'বৈধ' হয়ে যাবে এবং উক্ত সনদপত্রসমূহ সরকারি দপ্তরে পাঠানোর উপযুক্ত হবে। অথচ আপনি পনের থেকে বিশ বছর পড়ালেখা করে যে সনদ অর্জন করলেন সেটা কোন সরকারি দপ্তরে পাঠানোর উপযুক্ত হল না শুধুমাত্র একটা সিল না মারার কারণে! পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এই ধরনের প্রথা আছে কিনা আমার জানা নেই, থাকলে যদি কেউ জানেন জানালে উপকৃত হব।

এবার ফিরে আসি আগের আলোচনায়। যথারীতি আমাকেও তো কাগজপত্র সত্যায়িত করতে হবে। কোথায় পাবো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা- সেটা খুঁজতেই দুই-তিন দিন কেটে গেলো। এরপর যাও পেলাম তাও নাকি সনদপত্রের মূল কপি দেখা ছাড়া নাকি কেউ সত্যায়িত করে না। ভাগ্য খারাপই বলতে হয়, কারণ আমার সনদপত্রের মূলকপি সব যে গ্রামের বাড়িতে! মেসে থাকি, সেজন্য নিজের কাছে মূল কপি রাখতে নিরাপদ বোধ করি না। কিন্তু সেটা তো আর আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তাকে বুঝাতে পারবো না, তাই আমার কাজ হল না। মেসের একজন পরামর্শ দিলো নীলক্ষেত গেলে নাকি সব কিছু টাকা দিলেই সত্যায়িত করে দিবে। কথা অনুযায়ী নীলক্ষেত যাত্রা এবং 'বিশ' টকার বিনিময়ে সব কাগজ সিল সহ সত্যায়িত করে অতঃপর সরকারি অফিসে প্রেরণ। শুনেছি অনেকে নাকি নিজেরাই সিল বানিয়ে বাসায় বসেই সব কাজ শেষ করে, তাদের আর আমার মত নীলক্ষেত যাওয়ার দরকারও পড়ে না।

এবার আসি মূল কথায়। যেই কাজ নীলক্ষেত গিয়ে মাত্র বিশ টাকা দিয়ে বা বাসায় বসেই শুধুমাত্র একটা সিল বানিয়েই করা যায় সেটার জন্য কেন সাধারণ মানুষকে এত হয়রানির শিকার হতে হবে? আপনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা, একটা ছেলে বা মেয়ে আপনার পিছনে পনের থেকে বিশ বছর পড়ালেখা করে অর্জিত সনদ নিয়ে ঘুরবে, কারণ আপনি একটা সিল মেরে না দিলে তার সনদসমূহ যে বৈধতা পাবে না। তাও আপনাকে সনদের মূল কপিই দেখাতে হবে।

এখন প্রশ্ন হল, যদি একটা ছেলের বা একটা মেয়ের এত বছর পড়ালেখা করে অর্জিত সনদের বৈধতার জন্য দরজায় দরজায় ঘুরতে হয় তাহলে তার এত বছরের শ্রমের কি মূল্য দিল আমাদের রাষ্ট্র?

আমরা কথায় কথায় ডিজিটাল বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ করি। কিন্তু আমরা ভুলে বসে আছি যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে রোল ও রেজিস্ট্রেশন নাম্বার দিয়ে যেকোন পরীক্ষার ফলাফল বা সনদ খুব সহজেই যাচাই করে নিতে পারি। সেক্ষেত্রে সত্যায়িত করার কি কোন দরকার আছে কি? যেকোন সরকারি প্রতিষ্ঠান চাইলেই তো তথ্যসমূহ খুব সহজেই যাচাই করে নিতে পারে, তাহলে আর কতদিন আমাদের এই উপনিবেশিক প্রথা পালন করে যেতে হবে? সরকারে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল যদি সরকারি অফিস সমূহই ভোগ করতে না পারে তাহলে সাধারণ মানুষ এর সুফল কিভাবে পাবে?

এই প্রথা থেকে অবশ্যই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, তবে উদ্যোগটা সবার আগে কিন্তু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তাদেরই নিতে হবে।