পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিলঃ মৌলিক আর্থ-সামাজিক সংস্কার জরুরী

প্রফেসর ড. এম.এ. মান্নান
Published : 19 July 2012, 09:17 AM
Updated : 19 July 2012, 09:17 AM

সরকারী বেসরকারী কিছু কর্মকর্তা ও কানাডীয় কোম্পানীর দুর্নীতিকে দায়ী করে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে না বলে গত ৩০ জুন এক বিবৃতির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে গেল। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৯০ কোটি ডলার যার মধ্যে ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল বিশ্ব ব্যাংকের, এডিবি ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪ কোটি ডলার ঋণ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। এখন বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন না করায় অন্য দাতাদের পিছিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। পরবর্তিতে বাংলাদেশে কার্যরত দাতাদেশ ও সংস্থার স্থানীয় প্রতিনিধিদের ফোরাম স্থানীয় পরামর্শক গোষ্ঠীর (এলসিজি) সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী দাবী করেন দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে এক বিশাল বিতর্কের সূচনা হয়েছে। কেউ কেউ বিভিন্ন রকম শুল্কারোপের মাধ্যমে দেশীয় অর্থায়নে এ পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তাব রেখেছেন, এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মাননীয় স্পীকার বিকল্প অর্থায়ন নিয়ে প্রস্তাব রেখেছেন। কেউই আমাদের আর্থ সামাজিক অবকাঠামোর মৌলিক সংস্কার করে এর মাধ্যমে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করে পদ্মা সেতু ছাড়াও স্বনির্ভর অর্থনীতি পরিবর্তনের কথা বলছে না। আমার এই ছোট প্রবন্ধে আমি যেটা বলতে চেয়েছি তা হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন ঘটছে তা হলো প্রান্তিক পরিবর্তন; কিন্তু এই প্রান্তিক পরিবর্তন দিয়ে এ দেশের ভাগ্য বদলানো সম্ভব নয়। জাতির ভাগ্য বদলাতে চাইলে চিন্তা ধারায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন, বিদেশী সাহায্য ছাড়াই চলার চিন্তা একটি বৈপ্লবিক চিন্তা হতে পারে; কিন্তু সাহায্য ছাড়া চলতে গেলে প্রয়োজন হবে নিজস্ব সম্পদ সমাবেশের। আর সে জন্য চাই নতুন অর্থনৈতিক মডেল। সেই মডেল উদ্ভাবনই হবে প্রকৃত কাঠামোগত পরিবর্তন। এরই প্রেক্ষাপটে এ লেখাটি লেখা হচ্ছে।

দাতা সংস্থাগুলো দেশীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে বাধা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীকে অর্থনৈতিক পঙ্গুত্বের হাত থেকে মুক্তি দিতে ধনী দেশগুলোর পরামর্শ, প্রত্যক্ষ সহযোগীতা ও নিয়ন্ত্রণে গড়ে ওঠে বিশ্ব ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা। এসব সংস্থা বিশেষ করে গরীব দেশগুলোকে ঋণ দানের মাধ্যমে কর্মসূচী বাস্তবায়নে সাহায্য করে যাতে দেশগুলো দরিদ্রতার নাগপাশ থেকে মুক্তি পায়; কিন্তু দেখা গেছে দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীর বেশি কাল ধরে এদের সাহায্য ও পরামর্শ গ্রহণ করে খুব কম দেশই দারিদ্র থেকে পুরোপুরি পরিত্রাণ পেয়ে উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হতে পেরেছে। আসলে সাহায্যের ছদ্মাবরণে দাতা সংস্থাগুলো তৃতীয় বিশ্বে এমন সব অপরাধ করে চলেছে যার কারণে দেশগুলো আরো বেশী সাহায্য নির্ভর হয়ে পড়েছে। এসব দেশের জনগণ আরো দরিদ্র হয়েছে, তাদের দুর্ভোগ বহুগুণ বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক সাহায্য ও অনুদানের ক্ষেত্রে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে এসব অনুদান প্রকৃত পক্ষে ধনী দেশের গরীব কর দাতার অর্থ যা গরীব দেশের ধনীদের দেয়া হয়। এইভাবে দাতা সংস্থাগুলো বিশ্বব্যাপি অভিজাত শ্রেণী সৃষ্টি করছে এবং এই অভিজাত শ্রেণীগুলোর স্বার্থ বজায় রাখতে পারস্পরিক বাধ্যবাধকতার নেটওয়ার্ক তৈরি অক্ষুন্ন রাখছে। দাতা সংস্থাগুলো বিশ্বব্যাপি কর্পোরেট শক্তি সৃষ্টি এবং কর্পোরেট এলিটদের টিকিয়ে রাখছে। দরিদ্র দেশ থেকে ধনী দেশে মেধা পাচারকে উৎসাহিত করছে। গ্লোবাল এলিটদের সাথে স্বল্প সম্পর্ক বা সম্পর্কহীন দরিদ্র ও অনভিজ্ঞদের সুবিধা প্রাপ্তির পথে বাধা সৃষ্টি করছে সাহায্য সংস্থাগুলো। এই সংস্থাগুলো একটি দেশের সংস্কৃতি থেকে উন্নয়নকে বিছিন্ন করে ফেলে। দেশীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়। সর্বোপরি কারো পরিবেশের ক্ষতিকে এরা তোয়াক্কা করে না।

উপরিউক্ত অর্থনৈতিক অপরাধের সাথে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত মূলগত কারণ নিম্নে উল্লেখিত ৯টি প্রকল্পের (হাইপোথিসিস)সাথে যুক্ত করা যায়:
১. সাহায্য ও অনুদান কেনা-বেচার জন্য বাজার সৃষ্টি করা হয়েছে।
২. মন্ত্রী আমলাদের বিদেশ সফর, বিদেশে তাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য শিক্ষা মঞ্জুরী, অবসর গ্রহণের আগে বা পরে উপদেষ্টাগিরি ইত্যাদির মাধ্যমে সাহায্যের একটা বড় অংশ অনার্জিত আয়ে পরিণত হয়।
৩. কথিত প্রজেক্ট প্রসেসিং কস্ট এর বিনিময়ে দাতারা আমদানী শর্ত জুড়ে দেয় এবং নিজেদের পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করে, বিদেশী উপদেষ্টাদের জন্য উচ্চ বেতনে চাকুরীর সুযোগ ইত্যাদি। এসব কায়েমী স্বার্থবাদী গ্রুপগুলোর স্বার্থে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা জরুরী।
৪. তৃতীয় বিশ্বে প্রায়ই ঋণ দেয়া হয় বড় ধরনের ঋণ প্রকল্পে বিশেষ করে বৃহদাকার বাঁধ নির্মাণে, যা বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটায় এবং লাখ লাখ মানুষকে বাস্তচ্যুত করে।
৫. কর্মচারীদের মাত্রাতিরিক্ত বেতনের কারণে তৃতীয় বিশ্বে মেধা পাচারের মতো সমস্যা দেখা দেয়।
৬. বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ অনুসৃত তথাকথিত কাঠামোগত সমন্বয় নীতি বা কৌশলের দাবী হচ্ছে, যেসব দেশ এই নীতি গ্রহণ করবে তাদেরকে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, ভর্তুকি হ্রাস ইত্যাদি করতে হবে। গরীবের জন্য অতি প্রয়োজনীয় জিনিস ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদার ওপর থেকে ভর্তুকি হ্রাস কর্মসূচী গ্রহণ করার পর প্রত্যেক সরকারকে বড় ধরনের মূল্য দিতে হয়।
৭. বিশ্ব ব্যাংকের নতুন ঋণ প্রদানের চেয়ে দ্রুত গতিতে সুদসহ ঋণ আদায়ের প্রবণতা। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের ১৯০০ প্রকল্পে দেয়া হয়েছে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; কিন্তু স্বল্প মেয়াদী সুদমুক্ত ঋণ আদায় করা হয়েছে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
৮. স্থিতাবস্থা বজায় রাখার স্বার্থে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণকে বাধা দেয়া হয়।
৯. মুসলিম রাষ্ট্রসহ সকল উন্নয়নশীল দেশকে অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত করা এবং একচেটিয়াত্ব কায়েমের নতুন হাতিয়ার হচ্ছে বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশন। প্রতিযোগীতামূলক মুক্তবাজারের অর্থনীতির পক্ষে চিৎকার করা হলেও বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমেই ৫ থেকে ৬টি বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে। বিশ্বের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ খাদ্য ও পানীয় কৃষিজাত কাঁচামাল, খনিজ ও ধাতব পদার্থের আমদানি-রফতানি এদের মাধ্যমে হয়। বস্তুত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৈদেশিক বাণিজ্য এখন বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে।

পশ্চিমা দাতারা অনুদান দেয় মুক্ত বাজার অর্থনৈতিক ধ্যান ধারনার উপর ভিত্তি করে; কিন্তু আমাদের সমাজ মুক্ত বাজার অর্থনীতির সমাজ নয়। এই সমাজের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এটি মূলত: একটি কৃষি ভিত্তিক সনাতন (Traditional) সমাজ। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতিও চলছে। এ দেশের ৮৮ শতাংশ জনগণ মুসলমান এবং তাই এই সনাতন অর্থনীতি মূলতঃ ইসলামিক কৃষ্টির সাথে যুক্ত; কিন্তু এই কৃষ্টিকে আর্থিককরণের কোন চেষ্টা কখনো করা হয়নি।

৫টি মৌলিক প্রস্তাবনা
১. ত্রিমুখী বাজেট প্রণয়ন
আমাদের বাজেটে একটা মৌলিক সংস্কার আনতে হবে। আমাদের বাজেটগুলি একটি নিয়মিত ব্যবধানের যোগ-বিয়োগ যাহা পশ্চিমা দাতাদের অনুদান দেয়া তথাকথিত মুক্ত বাজার অর্থনীতির ধ্যান ধারনার উপর ভিত্তি করে করা হয়। স্বনির্ভর অর্থনীতি ও স্বেচ্ছাসেবক খাতের বিনিয়োগ চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। এখন এক নতুন চিন্তা ধারায় সমকালীন আর্থ-সামাজিক সমস্যার বিশ্লেষণ ও সমাধানের জন্য ত্রিমুখী বাজেট প্রণয়ন জরুরী হয়ে পড়েছে।
১.১ ত্রিমুখী বাজেটের প্রথম খন্ড বাজেট হবে বাজার ভিত্তিক (কর্পোরেট সেক্টর) অর্থনীতির বাজেট যার মূল লক্ষ্য হবে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি,অপচয় হ্রাস এবং প্রশাসনের পরিধি সংকোচন।
১.২ ত্রিমুখী বাজেটের দ্বিতীয় খন্ড বাজেট হবে বাজার বহির্ভূত (নন কর্পোরেট সেক্টর) তৃণমূল অর্থনীতির বাজেট যার প্রধান লক্ষ্য হবে দারিদ্র বিমোচন। গ্রাম ও স্থানীয় পর্যায়ের সর্ব নিম্ন স্তরের জনগণ যথা: ভূমিহীন মজুর, প্রান্তিক চাষী, ক্ষুদ্র কারিগর, ব্যবসায়ী, শহরাঞ্চলের বেকার, ক্ষুদ্র পল্লী শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে জীবনের নূণ্যতম চাহিদা মেটানোর প্রান্তিক প্রবৃত্তি পূরণের ব্যবস্থা করা। সঞ্চয় প্রবণতা বাড়াতে আগ্রহী করা। তাদের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা।
১.৩ ত্রিমুখী বাজেটের তৃতীয় খন্ড বাজেট হবে স্বেচ্ছাসেবক খাতের (ভলান্টারী সেক্টর) অর্থনীতির বাজেট যার লক্ষ্য হবে বিশেষ করে সামাজিক তহবিল গঠন ও সামাজিক বিনিয়োগের জন্য ইসলামী অর্থ বন্টন ব্যবস্থার বাধ্যতামূলক ও স্বেচ্ছামূলক বিবিধ পন্থা যেমন-
ক. যাকাত, সদকা, ওয়াকফ, ক্যাশ ওয়াকফ ইত্যাদির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দানের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন এবং হজ্ব তহবিল পরিচালনা
খ. প্রচলিত, অপ্রচলিত ও স্বেচ্ছামূলক খাতের মূল অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যোগ্য গ্রাহকদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন
গ. পল্লী ও শহরাঞ্চলের উদ্বৃত্ত স্বেচ্ছাশ্রম কাজে লাগানোর কর্মসূচী গ্রহণ

২. ওয়াকফ প্রপাটি বন্ডের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির উন্নয়ন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ১৯৮৬ সালের তথ্যমতে, সারা দেশে ১ লাখ ৫৩ হাজার ওয়াকফ এস্টেট রয়েছে। তবে ওয়াকফ ভবনের তথ্যমতে, বর্তমান ওয়াকফ এস্টেটের সংখ্যা ২ লাখেরও বেশি হবে। জানা যায়, ওয়াকফ ভবনের তালিকাভুক্ত ওয়াকফ এস্টেট হচ্ছে ২০ হাজার। ওয়াকফ ভবন সূত্রে জানা যায়, এরমধ্যে ১৪-১৫ হাজার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ওয়াকফ এস্টেট জ্ঞাত আছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর একবার অডিট করার কথা থাকলেও প্রতি পাঁচ বছর অন্তরও অডিট করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের সব ওয়াকফ সম্পত্তি দেখভাল করতে জনবল কাঠামোতে পদ রাখা হয়েছে ১১১টি। মগবাজারের কেন্দ্রীয় দফতরের বাইরে জেলাগুলোতে পরিদর্শক রয়েছে মাত্র ২২ জন। একেক জনের অধীনে একাধিক জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এত কম জনবল দিয়ে এই বিশাল দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব।

সম্প্রতি কিছু তথ্য উপাত্ত প্রাথমিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে সরকার এ বিশাল ওয়াকফ সম্পত্তির উন্নয়ন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মোট বাজেটের আদায়কৃত রাজস্বের ২৭ শতাংশ সংগ্রহ করতে পারে। Waqf Property Development Bond প্রবর্তন করে ইসলামী ব্যাংকগুলোর একটি কনসোর্টিয়াম দ্বারা এই উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়া যেতে পারে। এমনকি হিন্দুদের দেবোত্তর সম্পত্তির উন্নয়নের ব্যাপারেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বেচ্ছামূলক খাত বিকাশের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি এবং গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, অর্থায়ন ও পুঁজি বাজার সংগঠিত করার প্রক্রিয়া হিসেবে ক্যাশ ওয়াকফ এর প্রবর্তনের মাধ্যমে সামাজিক পুঁজি এবং সামাজিক বিশ্ব ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সম্প্রতি এক মার্কিন পরিসংখ্যান অনুযায়ী জানা যায়, আমেরিকার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সমগ্র অর্থনীতির জিডিপির শতকার ৮ ভাগ এবং আমেরিকার কর্ম সংস্থানের প্রায় ১০ ভাগ কর্মসংস্থান তৈরি করেছে যা কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের সমন্বিত কর্মসংস্থানের চেয়ে বেশী।একবিংশ শতাব্দীতে ইসলামী আর্থ- সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্জীবিত করলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গবেষণায় এক বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।

৩. সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের প্রতি বিরূপ বার্তার সংশোধন প্রয়োজন
ইসলাম একটি জীবন দর্শন (a Complete Code of Life)যাহা সকল ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্যতা ও নীপিড়ন বিলোপ করেছে। ইসলাম শুধু বাংলাদেশের নয় বরং বিশ্বের ১.৬ বিলিয়ন মানুষের। তাই ইসলাম সম্পর্কে যে কোন ব্যাখ্যা মুসলিম উম্মাহর Sharia Scholar দের নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়া একান্তই কাম্য। কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে ইসলাম ধর্মকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তাহা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

প্রস্তাবনার শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে [বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)/পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে]।সংবিধানে পূর্বে এর বাংলা অনুবাদ ছিল- 'দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে।'তবে, এক্ষেত্রে 'পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে' কথাটিও যুক্ত করা হয়েছে। বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম আরবী বাক্যটির বাংলা কী হতে পারে তা নির্ধারণে মুসলিম উম্মাহর Sharia Scholar দের সাহায্য গ্রহণ করলে ভালো হতো।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বহাল রেখে ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা"। এখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলে রাষ্ট্র আবার ধর্ম নিরপেক্ষ কী করে হয়! বিষয়টি পরস্পর সাংঘর্ষিক।

পঞ্চম সংশোধনীর আলোকে সংবিধানের ২য় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ৮(১ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হইবে যাবতীয় কার্যবলীর ভিত্তি"। পঞ্চদশ সংশোধনীতে এ বিধানগুলো সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে ইতিহাসের ব্যর্থ মতবাদ "সমাজতন্ত্র" কে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

৫ম সংশোধনীতে "(২৫)(২) অনুচ্ছেদের আলোকে রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।" সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে এই অনুচ্ছেদ বাদ দেয়া হয়েছে যা নিঃসন্দেহে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে একটা বিরূপ বার্তা দিচ্ছে যা অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে। বিষয়টি মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কাজ করবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মধ্য প্রাচ্যে আমাদের লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করছে। রেমিটেন্স এর সিংহ ভাগ মধ্যপ্রাচ্য থেকেই আসছে।

৪. ইতিহাসের অনিবার্য ধারাবাহিকতা উপলব্ধির চেষ্টা
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায় একবিংশ শতাব্দী ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের জন্য উন্নয়নের স্বর্ণযুগ। সম্প্রতি Pew Forum on Religion and Public Life, USA এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে বর্তমান বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১.৬ বিলিয়ন মুসলমান এবং প্রতি ৪ জনে ১ জন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। খ্রিস্টান জনসংখ্যা প্রায় ২.১ বিলিয়ন থেকে ২.২ বিলিয়ন সেই হিসাবে মুসলমানরা পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম জাতি। পশ্চিমা বিশ্বে আনুপাতিক হারে বয়স্ক জনগোষ্ঠী (Aging Population) যার গড় বয়স ৮০ এর উপর তারা সমাজে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। পক্ষান্তরে, মুসলিম বিশ্বে আনুপাতিক হারে তরুণ মুসলিম জনগোষ্ঠী (Young Muslim Population) যার গড় বয়স ৬৫ বছর যাহা একবিংশ শতাব্দীতে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সাফল্য অর্জনে প্রত্যাশিত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

ক্রেডিট রেটিং কমার পর যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র আগামী ৫০ বছরের মধ্যে নব্য তৃতীয় বিশ্বের দেশে পরিণত হবে; অচিরেই চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রথম স্থান দখল করবে। জাপান গত ৪৬ বছর ২য় স্থান ধরে রাখার পর বর্তমানে ৩য় স্থানে অবস্থান করছে এবং আগামীতে তাদের পক্ষে ৩য় স্থান ধরে রাখাও সম্ভব হবে না। ভারত উদীয়মান শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এ সকল রাষ্ট্রের পক্ষে তাদের অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হবে। তার কারণ মূলত দু'টো প্রথমত: তারা মুসলিম দেশগুলোর তেল এবং খনিজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল হবে আর দ্বিতীয়ত: মুসলিম দেশ বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদশের সুলভ জনশক্তি ও তুলনামূলক মজুরী পার্থক্য (wage Differentiation)যা মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সহায়তা করবে। ইতিহাসের অনিবার্য ধারাবাহিকতায় একবিংশ শতাব্দী হবে তরুণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর যারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল যেখানে ইসলামী রেঁনেসা ও মুসলমানদের অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবের সোনালী যুগের সূচনা করবে। এই সকল কারণে এই শতাব্দী মুসলিম উম্মাহর আর্থিক উন্নয়ের স্বর্ণযুগ যাহা অনুধাবন (Unfolding the Code of Time) করা আমাদের জন্য জরুরী।

৫. নব্য ইসলামিক সম্পদ আকৃষ্টের জন্য নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জনশক্তি সৃষ্টি করা
অবশেষে, মধ্য প্রাচ্যের Emerging New Islamic Wealth কে explore করার কোন চেষ্টা করা হয়নি। Boston Consulting Group পরিচালিত এক সার্ভেতে দেখা গেছে মধ্য প্রাচ্যের কতিপয় পরিবার, ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের হাতে ৮ শত বিলিয়ন মার্কিন ডলার এর বেশি অর্থ অলস পড়ে আছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এই ফান্ডের কিছু সুবিধা পাচ্ছে। এই বিশাল ভাসমান ফান্ড বাংলাদেশে আকৃষ্ট করার কোন প্রচেষ্টাই করা হয়নি। এই বিশাল অর্থ বিনিয়োগমুখী করতে হলে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার প্রচেষ্টা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক নেয়নি। সরকার একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হিসাবে ইসলামী ফাইনান্সের উপর Degree দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে এবং এই শিক্ষার সাথে নৈতিক মূল্যবোধকে যোগ করতে পারে। আমরা শুধু পদ্মা সেতুর ৩ বিলিয়ন ডলারের কথা ভাবছি। মধ্যপ্রাচ্যের বহু ধনী ব্যক্তি বা পরিবার রয়েছে যারা একটি চেকেই ৩ বিলিয়ন ডলার দিতে পারেন। যাঁরা পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছেন তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নাই, তাঁরা স্ব স্ব স্থানে স্বনামধন্য কিন্তু তাঁরা ইতিহাসের ধারবাহিকতার Code of time কে Unflod করতে পারেন নাই। তাঁরা সময়ের পরিক্রমার সঠিক ব্যাখা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। নব্য ইসলামীকে সম্পদ আকৃষ্টের জন্য আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করা জরুরী হয়ে পড়েছে।

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা।