সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী বাংলাদেশের উন্নয়নকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে

প্রফেসর ড. এম.এ. মান্নান
Published : 2 Sept 2012, 02:50 PM
Updated : 2 Sept 2012, 02:50 PM

যাঁরা পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছেন তাঁরা স্ব স্ব স্থানে যোগ্য ও স্বনামধন্য কিন্তু সংশোধনীতে আপাত তিনটা অসঙ্গতিপূর্ণ অপব্যাখা প্রদান করা হয়েছে- ১. ইসলামী মূল্যবোধের সাথে অসঙ্গতি ২. পশ্চিমা গণতন্ত্রের সাথে অসঙ্গতি এবং ৩. সুপ্রীম কোর্টের রায়ের সাথে অসঙ্গতি।প্রথমত, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে ইসলাম ধর্মকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে যা মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রের অপব্যাখার কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথেও দূরত্ব তৈরি করবে। অবশেষে, এই সংশোধনীতে সরকারী দলের প্রয়োজনমত আংশিকভাবে সুপ্রীম কোর্টের রায় গ্রহণ করা হয়েছে যা দেশকে একটা বিপর্যয়ের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে।

ইসলামী মূল্যবোধের সাথে অসঙ্গতি
বর্তমানে জেদ্দায় অবস্থিত Organization of Islamic Countries (OIC) এর ৫৭টি সদস্য মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে। Islamic Development Bank (IDB) এরও ৫৭ টি সদস্য রাষ্ট্র রয়েছে। ১৯৭৪ সালে আইডিবি এর যাত্রা শুরু হয় ২২জন সদস্য নিয়ে যার মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। বিশ্বে বসবাসরত সমগ্র মুসলিমের এক তৃতীয়াংশ বাস করে অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রসমূহে যেমন- ভারত, চায়না, রাশিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি। মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে বর্তমানে বিশ্বে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৮৪% । আরো জানা যাচ্ছে ২০০৯ সালের জরিপ অনুসারে ধর্মাবলম্বী হিসাবে পৃথিবীতে ক্রিস্টানদের সংখ্যা প্রায় ২০৩ কোটি ৪০ লাখ আর ২০১৬ সালে তা কমে গিয়ে ২০৩ কোটি ৩০ লাখ হবে। সেখানে বর্তমানে মুসলমানদের সংখ্যা ১৫৭ কোটি যা ২০১৬ সালে বেড়ে গিয়ে হবে ২০৩ কোটি ৪০ লাখ অর্থাৎ খ্রিস্টানদের সংখ্যা ক্রমে কমে যাচ্ছে কিন্তু মুসলমানদের সংখ্যা সর্বাধিক হবে যেখানে তরুণদের আধিক্য থাকবে। সার্বিক দিক বিবেচনায় দেখা যায় ধর্মাবলম্বী হিসাবে পৃথিবীতে একবিংশ শতাব্দী হতে যাচ্ছে মুসলমানদের উন্নয়নের স্বর্ণযুগ আর সেটা হচ্ছে ইতিহাসের অনিবার্য ধারাবাহিকতায়। কিন্তু, পঞ্চদশ সংশোধনী ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতা (Code of time) কে উদঘাটন্ (Unfold) করতে এবং সময়ের পরিক্রমার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

ইসলাম একটি জীবন দর্শন (a Complete Code of Life) যাহা সকল ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্যতা ও নীপিড়ন বিলোপ করেছে। ইসলাম শুধু বাংলাদেশের নয় বরং বিশ্বের ১.৬ বিলিয়ন মানুষের। তাই ইসলাম সম্পর্কে যে কোন ব্যাখ্যা মুসলিম উম্মাহর Sharia Scholar দের নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়া একান্তই কাম্য।

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে [বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)/পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে]।সংবিধানে পূর্বে এর বাংলা অনুবাদ ছিল- 'দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে।তবে, এক্ষেত্রে 'পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে কথাটিও যুক্ত করা হয়েছে। বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম আরবী বাক্যটির বাংলা কী হতে পারে তা নির্ধারণে মুসলিম উম্মাহর Sharia Scholar দের সাহায্য গ্রহণ করলে ভালো হতো।সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বহাল রেখে ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা"। এখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলে রাষ্ট্র আবার ধর্ম নিরপেক্ষ কী করে হয়! বিষয়টি পরস্পর সাংঘর্ষিক।

পঞ্চম সংশোধনীর আলোকে সংবিধানের ২য় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ৮(১ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হইবে যাবতীয় কার্যবলীর ভিত্তি। পঞ্চদশ সংশোধনীতে এ বিধানগুলো সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে ইতিহাসের ব্যর্থ মতবাদ "সমাজতন্ত্র" কে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।শুধু তাই নয় বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম আরবী বাক্যটিও অর্থহীন হয়ে পড়েছে।

৫ম সংশোধনীতে "(২৫)(২) অনুচ্ছেদের আলোকে রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।" সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে এই অনুচ্ছেদ বাদ দেয়া হয়েছে যা নিঃসন্দেহে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে একটা বিরূপ বার্তা দিচ্ছে যা অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে। বিষয়টি মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কাজ করবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মধ্য প্রাচ্যে আমাদের লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করছে। রেমিটেন্স এর সিংহ ভাগ মধ্যপ্রাচ্য থেকেই আসছে।সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে সংবিধান সংশোধন করে সমস্যা ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে। কুয়েত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ বাংলাদেশ হতে শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ ঘোষণা করেছে এবং যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে তাদের ভিসাও আর নবায়ন করছে না। এতে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের কোন ক্ষতি হয়নি যারা ঘর বাড়ি, গবাদি পশু বিক্রি করে বা ধার দেনা করে বিদেশ গিয়েছে বা যাওয়ার প্রস্ততি নিয়েছে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের উন্নয়নের জোয়ার ব্যাহত হচ্ছে।

Boston Consulting Group পরিচালিত এক সার্ভেতে দেখা গেছে মধ্য প্রাচ্যের কতিপয় পরিবার, ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের হাতে ৮০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এর বেশি অর্থ অলস পড়ে আছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এই ফান্ডের কিছু সুবিধা পাচ্ছে। এই সংশোধনীর কারণেই নিকট ভবিষ্যতে এই ফান্ডের সুবিধা পাওয়া হতে বাংলাদেশ বঞ্চিত হতে পারে।

পশ্চিমা গণতন্ত্রের সাথে অসঙ্গতি
আমাদের সংবিধান পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদলে (ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি ডেমোক্রেসি) প্রণয়ন করা হয়েছিল কিন্তু বর্তমানে ১৫তম সংশোধনীতে যেভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে তা পূর্ববর্তী ধারনার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সংবিধানকে কখনও এমনভাবে প্রণয়ন করা ঠিক হবে না যে এটা অপরিবর্তনযোগ্য কারণ মানুষের জন্যই সবকিছু এবং সংবিধানেও সেটা উল্লেখ করা হয়েছে যে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।সংবিধান কোনভাবেই আল কোরআন বা বাইবেল নয়। এটা মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি এবং পরিবর্তনশীল পৃথিবীর জন্য পরিবর্তিত ও যুগোপযোগী আইন ও বিধান প্রণয়নই গণতন্ত্রের মূল নীতি।

ব্রিটেনে কোন লিখিত সংবিধান নাই আর সেজন্যই সেখানে গণতন্ত্রের চর্চাটা আরো বেশি। সেখানে বিচার বিভাগই মানুষের প্রয়োজন অপ্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখে। এখনও পর্যন্ত আমেরিকান সংবিধানই বিশ্বের সবচেয়ে ছোট লিখিত সংবিধান যেখানে আছে মাত্র ৭টি অনুচ্ছেদ ও ২৭টি সংশোধনী। অন্যদিকে ভারতের সংবিধান হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিখিত সংবিধান যেখানে আছে ৪৪৪টি অনুচ্ছেদ, ১২টি শেডিউল ও ৯৪টি সংশোধনী। কোন দেশের সংবিধান বা সংবিধানের কোন অংশ অপরিবর্তনীয় এরকম কোন তথ্য আপাতত আমার হাতে নেই। এরকম একটা সংশোধনী দেশের মানুষকে ভুল বার্তা দিচ্ছে, বিভ্রান্ত করছে। বাকশাল হবে কীনা, একনায়কতন্ত্র হবে কীনা এরকম বিষয় নিয়ে পত্র পত্রিকায় আলোচনা চলছে। গণভোটের বিধানও বাতিল করা হয়েছে। সার্বিক বিষয়টি পশ্চিমা দাতারা সন্দেহের চোখে দেখছে। চায়নার সমাজতন্ত্র বা রাশিয়ান মডেলের সমাজতন্ত্র ইতিহাসের ব্যর্থ মতবাদ। এরাই এখন বাজার ভিত্তিক অর্থনীতির পথ ধরে চলছে। বর্তমান সংশোধনী পশ্চিমা দেশের গণতন্ত্রের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে।

সুপ্রীম কোর্টের রায়ের সাথে অসঙ্গতি

সুপ্রীম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তের রায়ে বলা হয়েছে, ১০ম এবং ১১তম সংসদ নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনীর প্রবিধান অনুসারে (তিনটি ল্যাটিন ম্যাক্সিম এর কথা উল্লেখ করে যা কিছু সাধারণভাবে বেআইনী, বিশেষ প্রয়োজনে সেটা আইনসম্মত হিসাবে মেনে নেয়া যায় এবং মানুষের নিরাপত্তা হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তাও সর্বোচ্চ আইন )অনুষ্ঠান করা যায়। এই রায়কে মেনে নিয়েই ১০ম এবং ১১তম সংসদের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা সম্ভব। আমাদের দেশে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান, এরা ইসলামী কৃষ্টির সাথে জড়িত। রোমান আইন ছাড়াও ইসলামী জুরিসপ্রুডেন্সও প্রয়োজনীয়তা মতবাদ (Doctrine of Necessity) বিষয়ে বলেছে, যেখানে দুইটি বিকল্পই খারাপ সেখানে যেটি অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর সেটি গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়। এই দুই মেয়াদের পর কীভাবে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হবে তা আলোচনা করে ঠিক করা যেতে পারে এবং আগামী ১০ বছর পর দেশের অবস্থা আরো পরিবর্তিত হতে পারে সেখানে পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজতর হবে।

রাজনীতিবিদরা যে পরস্পরের প্রতি আস্থাহীন তা বোঝা যায়। দেশের প্রধান দু'টি রাজনৈতিক দল এখন মুখোমুখি অবস্থান করছে। এ সাংঘর্ষিক, অস্থিতিশীলতার মূলে রয়েছে আস্থার সংকট, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস। গণতন্ত্রের মূল কথা হলো অপরের ভিন্ন মতের উপর শ্রদ্ধা পোষণ করা। আমার মনে হচ্ছে এখানে সেটার চরম ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতে পৌঁছানোর কোন বিকল্প নেই। সংঘাত সংঘাতেরই সৃষ্টি করে। আমি যদি বলি বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাঁর শরীক দল বা বিএনপি ও তাঁর শরীক দলের দেশপ্রেমের ঘাটতি রয়েছে বা তারা জনগণের কল্যাণ চায় না তাহলে তা হবে অনেক বড় ভুল ধারনা। পাশাপাশি এটাও হবে ভুল হবে যদি আমরা ভাবি কোন সংবিধান আল কোরআনের বাণী বা বাইবেল। সুতরাং, খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ, প্রান্তিক চাষী এদের শান্তির কথায় মাথায় রাখলে নেতা যত বড়ই হোন দেশের কল্যাণের কাছে তিনি অনেক ছোট। যদি এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় তাহলে কোন নেতাই কোন অন্যায় করতে পারে না। তাদের উদ্দেশ্যই হবে তাদের জীবনের চেয়ে বড়। সুতরাং আলোচনায় বসতে নিজেকে ছোট ভাবার কোন কারণ নেই। জনকল্যাণের মহত উদ্দেশ্যের তুলনায় নেতা অনেক ছোট। মহত কাজের জন্যই আলোচনায় বসা দরকার। বর্তমানে দেশের এ অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগকে অহং বোধ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। হত্যা, গুম, নির্যাতন, হরতালের যে রাজনীতি শুরু হয়েছে তা অচিরেই শেষ হওয়া দরকার। দেশে যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে মানুষের কল্যাণ ও নিরাপত্তার খাতিরে তা নিরসন হওয়াও সময়ের দাবী।

-প্রফেসর ড. এম.এ. মান্নান
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড
সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক,জেদ্দা।
Email: hmct2004@yahoo.com