ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য সংকটের কারন ও সমাধানের উপায় এবং বর্তমান সরকারের ভুমিকা

মো: আবু নাসের
Published : 24 April 2012, 03:52 AM
Updated : 24 April 2012, 03:52 AM

তারল্য সংকট বর্তমানে আমাদের দেশে একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। এটি দিনের পর দিন আর বেড়েই চলছে। এই অবস্থা এই ভাবে চলতে থাকলে আগামীতে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা উঠে যাবে। নিশ্চয়ই এই অবস্থা কার কাম্য হতে পারে না।

বর্তমানে আমাদের দেশে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে চরম তারল্য সংকট বিরাজ করেছে।গ্রাহক ব্যাংকের নিকট গিয়ে তার চাহিদা মত টাকা লেনদেন করতে পারছে না।বিশেষকরে যারা ঋণ নিতে চায় তারা তাদের প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছে না। ব্যাংক গুলো আজ চরম এক তারল্য সংকটে মধ্যে আছে। এই অবস্থা বেশ কিছু দিন ধরেই বিরাজমান। কোন ভাবেই এর উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং দিন কে দিন এই অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।

প্রথমে আসা যাক তারল্য বলতে আমরা বুঝি, তারল্য হল ব্যাংকের স্বল্প কালিন অর্থ পরিশোধ করার ক্ষমতাকে বুজায় তারল্য এর সহজ সংজ্ঞা হল লিকুইডিটি ইজ দ্যা অ্যাবিলিটি অফ এ কম্পানি টুঁ পে কারেন্ট লায়াবিলিটিজ টুঁ কারেন্ট এসেট।

তারল্য সংকট বলতে আমরা বুজি – কোন কারনে গ্রাহক যদি ব্যাংকের নিকট টাকা চেয়ে না পান তখন তারল্য সংকট পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ গ্রাহকের চাহিদা মেটানোর মত টাকা ব্যাংকে জমা না থাকার মত অবস্থাকে তারল্য সংকট বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।

অর্থনীতিবিদরা তারল্য সংকট ক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন এই ভাবে, তারল্য সংকট বলতে এমন একটি অবস্থাকে বুজায় যেখানে বিনিয়োগযোগ তহবিলের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয় তাকে তারল্য সংকট বলে।

এই বার আসা যাক তারল্য সংকট কেন হচ্ছে তার কিছু কারন। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির আলোকে তারল্য সংকটের কিছু কারন সাধারন ভাবে উল্লেখ করা হলঃ-
১. ব্যাংক থেকে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহনঃ বর্তমানে সরকার অতিমাত্রায় ব্যাংক গুলো থেকে ঋণ গ্রহন করেছে বিভিন্ন বিবেচনায় ফলে ব্যাংকগুলো চরম এক তারল্য সংকটে পড়েছে। তবে আমরা লক্ষ্য করছি যে সরকারের এই গৃহীত ঋণ সাধারণত বেশিরভাগ ই অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার হয়ে আসছে। কাজেই অনেক ক্ষেত্রে সরকারের ঋণ গ্রহন কে নিরুসাহিত করা হয়। কিন্ত বর্তমান সরকার নানা কারনে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অতিমাত্রায় একের পর এক ঋণ গ্রহন করেই চলছে। চলতি অর্থ বছরে ২০১১-২০১২ জন্য জাতিও বাজেট ঘোষণাকালে সরকার ব্যাংক থেকে ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা ঋণ গ্রহন করবে। কিন্তু ইতিমধ্যে সরকার ঘোষণা কৃত ঋণ গ্রহনের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে তার পরিমান ২৭ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এটা প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেশী ফলে ব্যাংক থেকে সরকারের উচ্চমাত্রায় রিন গ্রহনের ফলে বিনিয়োগ কার্যক্রম চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। এতে ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের চাহিদা মত ঋণ সরবরাহ করতে পারছেনা এতে আগামিতে আমাদের দেশে উৎপাদনশীল কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে।

২। দেশে বিদ্যমান উচ্চহারে মুদ্রাস্ফীতি: মুদ্রাস্ফীতি এটি আরেকটি অন্যতম প্রধান কারন। মুদ্রাস্ফীতির কারনে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। মানুষ উচ্চ মূলে জিনিসপত্র কিনতে হচ্ছে, ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যাংককে পূর্বের সঞ্চয়ের টাকা তুলে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছে। আবার অনেক সময় ব্যাংককে গিয়ে ব্যাংকের তারল্য সংকটের কারনে যথা সময়ে গিয়ে টাকা তুলতে পারছে না। গত জাতীয় বাজেট কালে আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী সাহেব বলেছিলেন চলতি অর্থ বছরে গড় মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে রাখবেন কিন্তু অর্থমন্ত্রীর কথা শুধু কথাই রয়ে গেল বাস্তবে তা আর হয়ে উঠেনি। কন ভাবেই মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে রাখা যাচ্ছে না এর মাত্রা আরো বেড়েই চলছে।মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি তো পায় ই নাই বরং আমরা লক্ষ্য করছি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা দিন কে দিন হ্রাস পাচ্ছে। এতে বর্তমানে মানুষের সঞ্চয়ের সামর্থ্য প্রকট হারে হ্রাস পেয়েছে। মানুষ এখন আর ইচ্ছে করলেই ব্যাংকে টাকা জমাতে পারছে না কারন তার নুন আনতে ই পান্তা ফুরায়। অনেক সময় সরকারের মন্ত্রি সাহেব ব্যক্তিতা দিয়ে থাকেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে নাকি মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে তার এই বক্তবের সাথে বাস্তবতার কত টুকু মিল আছে তা আজ আপনারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। আমি মনে করি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারনে অনেক সময় সরকারের ভাল ভাল অর্জন ও বার্থ হয়ে যায়।

৩. ব্যাংক থেকে উত্তোলিত টাকা শেয়ার বাজারের অস্বাভাবিক বিনিয়োগঃ অনেকে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের থেকে বড় ধরনের টাকা উত্তোলন করে শেয়ার বাজারে স্বল্প সময়ে অধিক লাভের আশায় বিনিয়োগ করেছেন।কিন্তু শেয়ার বাজারদরের অস্বাভাবাবিক দর পতন ও চরম দুর্নীতির কারনে অনেক মানুষ আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে। কেউ কেউ ব্যাংকের সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন।এতে শেয়ার বাজারের লুট করা টাকা গুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একটা বড় ধরনের তারল্য সংকট দেখা দিয়াছে।

৪. শেয়ার মার্কেট থেকে সরিয়ে নেয়া টাকা ডলারে রুপান্তর করে দেশের বাহিরে পাচারঃ অনেকে মনে করেন শেয়ার মার্কেট থেকে বড় ধরনের একটা অঙ্ক পাচার হয়ে গিয়েছে ডলারের মাধমে। ফলে কিছু দিন ধরে ডলারের দাম অযোক্তিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে কয়েক মাস আগেও ছিল মার্কিন ডলার প্রতি ৭২-৭৫ টাকার মধ্যে যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৮৪-৮৫ টাকা। এটি তারল্য সংকটের অন্যতম একটি কারন। তাই আমরা খুদ্র বিনিয়োগকারী হিসাবে সরকারের কাছে আবেদন দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের সঠিক বিচারের মাধমে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হক।

৫. বৈদেশিক মুদ্রার পরিমান কমে যাওয়াঃ বেশ কিছু দিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে আমাদের দেশে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে গেছে। কারন বিদেশ থেকে কর্মী পেরত ও কর্মী না নেয়া বিভিন্ন কারনে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে গেছে। ফলে তারল্য সংকট আর প্রকট আকার ধারন করেছে।

তারল্য সংকট সমাধানের উপায় ও করণীয়:

১. সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহন বন্দ করতে হবেঃ সরকারকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ব্যাংক থেকে অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহন বন্দ করতে হবে।ফলে ব্যাংক গুলি তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। এতে তারল্য সংকট অনেক তা কমে আসবে।

২. মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণঃ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনের দায়িত্ব সরকারের কাজেই সরকারকে এর প্রয়োজনীয় সময় উপযোগী প্রদক্ষেপ নিতে হবে।

৩. শেয়ার মার্কেটের লুট করা টাকা উদ্ধার করে শেয়ার মার্কেটকে সচল করাঃ সরকার মার্কেটের দূষীদের থেকে লুট করা টাকা উদ্ধার করে পুনরায় শেয়ার মার্কেট এ প্রদানের মাধ্যমে সারে মার্কেটকে সচল করা। ফলে তারল্য সংকট থেকে কিছু টা মুক্তি মিলবে।

৪. দেশের বাহিরে টাকা পাচার বন্দ করাঃ অনেক সময় আমাদের দেশে কিছু অসৎ দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা দেশের বাহিরে পাচার করে থাকেন। এতে বড় ধরনের একটা অঙ্ক দেশের বাহিরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফলে এর প্রভাব তারল্য সংকট হয়ে পুরো দেশের উপর পড়ছে।

৫. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণঃ আমাদের সরকারের প্রতিটি দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বিদেশে কর্মী পেরন নিশ্চিত করা এবং তাদের প্রয়োজনীয় সুবিদা নিশ্চিত করা। এতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে তারল্য সংকট সমাধান করা সম্ভব।

আমাদের দেশে একটি প্রবণতা বার বার ই লক্ষ্য করা যায় তা হল যখনি কোন সমস্যা সৃষ্টি হয় কিছু দিন তা নিয়ে বেশ হৈচৈ করা হয়। কিন্তু যখনি আরেকটি নতুন ঘটনা ঘটে যায় তখন পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা এক পর্যায়ে সময়ের আবর্তে চুপসে যায় অর্থাৎ আমরা সমস্যা সৃষ্টি হলে তা নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা করতে খুব ভালবাসি। কিন্তু সমস্যা সমাধানের কিম্বা একই সমস্যা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটতে পারে সেই ব্যাপারে আমরা ও আমাদের সরকারগুলো বরাবরই উদাসীন। তাই বিশেষ করে আমাদের বর্তমান অন্যতম প্রধান সমস্যা তারল্য সংকট এটি নিয়ে সরকারের করণীয় হওয়া উচিৎ। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিদ্ধমান তারল্য সংকটের প্রকৃত কারন অনুসন্ধান করে এর সমাধানের উপায় খুজে বের করা খুবই জরুরি। সেই সাথে ভবিষ্যতে এমন সংকট সৃষ্টি হতে না পারে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখনি নেয়া জরুরি।