স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান!!!

ইঁচড়েপাকা
Published : 27 Feb 2012, 04:30 PM
Updated : 27 Feb 2012, 04:30 PM

ব্লগটি লেখার আগে বলে নিচ্ছি, আমি কোন অনুসন্ধানী প্রতিবেদক/সাংবাদিক নই। কিন্তু সম্প্রতি এই বিষয়টি আমার চোখে পড়ায় এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে গিয়ে বেশ কিছু খোঁজ-খবর করতে হয়েছে। তবে যেহেতু আমি এই ব্যাপারে পেশাজিবী নই, তাই খুব বেশী তথ্য আমি যোগাড় করতে পারিনি। আমার আশেপাশে যা দেখেছি, যা পেয়েছি সেগুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। কোন অনুসন্ধানী প্রতিবেদক যদি এই বিষয়টিতে মনযোগ দেন, তাহলে আরো অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বের করে আনতে সক্ষম হবেন বলে আমার বিশ্বাস।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তাক লাগিয়ে দেয়ার মত কিছু জাদুকরী ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতার বলে তারা প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এমনকি হাইকোর্টের রায় পর্যন্ত অমান্য করতে পারে নির্দ্বিধায়। অবাক হবেন না। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। গত তিন বছরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে ডাক্তার-নার্স সহ প্রায় ৩৯০০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পেয়েছে। আমাদের নেতা-নেত্রীরা খুব গর্ব করে দাবী করেন, সর্বস্তরে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নিবেদিত প্রাণ সরকার। বিগত কোন আমলে এত অল্প দিনে এত বেশী সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বাস্থ্যবিভাগে নিয়োগ পায়নি। তথাস্তু। এর বিরোধীতা স্বয়ং ঈশ্বরও করতে পারবেন না। আসলেই বিগত কোন সরকারের আমলে স্বাস্থ্যবিভাগের উপর এত মনযোগ দেয়া হয়নি। এই সরকার বস্তুতই চেষ্টা করেছেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে। সরকারের এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সাধারণ মানুষ কি আদৌ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে নিয়োগপ্রাপ্ত এই বিশালসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে?

সরকার দুই দফায় প্রায় সাড়ে চার হাজার এমবিবিএস ডাক্তার নিয়োগ করেছেন প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য। কিন্তু তাদের সেবা প্রদানের প্রকৃত চিত্র ইউনিয়ন গুলোতে সরেজমিনে না গেলেও ইদানিং পত্র-পত্রিকায় কিছু আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পত্রিকায় ও যে সব খবর আসছেনা তার প্রমাণ পেলাম দু'দিন আগে কুমিল্লায় বেড়াতে গিয়ে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলো হয় তালাবন্ধ নয়তো সেগুলোতে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার বা চিকিৎসা সহকারী এক-দু'জন বসে আছেন ঢাল তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার হয়ে। কোন ওষুধ-পত্র বরাদ্দ নেই, বা কিছু কিছু কেন্দ্রে থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলে জানা গেল, গত ৩ বছর কেন কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার পর থেকে কখনও তারা কিছু কিছু কেন্দ্রে এমবিবিএস ডাক্তার আসতে দেখেন নি। ঐ কেন্দ্রে কোন এমবিবিএস ডাক্তার আছেন কিনা তা-ও তারা জানেন না। উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার বা চিকিৎসা সহকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেল, সবগুলো ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রেই একজন করে মেডিক্যাল অফিসার বা এমবিবিএস ডাক্তার নিয়োগপ্রাপ্ত আছেন। কিন্তু আসেন না। হয় ছুটি নিয়ে ঢাকা বা কুমিল্লা সদরে থাকেন, নয়তো উপজেলা সদরে ডেপ্যুটেশনে কাজ করেন। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মস্থল হলেও কেউ কেউ তাদের কর্মস্থলে কখনোই যান নি এবং কোথায় বা কোনদিকে সেটাও বলতে পারবেন না।

তো উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার বা চিকিৎসা সহকারী হিসেবে তারা কি করছেন জানতে চাইলে তারাও কিছু দুঃখের কথা শোনান। বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগটা তো এভাবেই চলছে। কেউ কেউ মাসের পর মাস অনবরত ছুটি কাটাচ্ছে, আর কেউ কেউ ছুটি পাচ্ছেনা। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার নির্দেশে তারা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন। দায়িত্ব অনেক থাকলেও তারা তেমন কিছুই করতে পারছেন না কারণ, তাদের সাথে অন্যান্য পদ গুলোতে যেমন- ফার্মাসিস্ট, এম এল এস এস পদগুলোতে কাউকে দেয়া হয় নি। ওষুধপত্রের বরাদ্দ নেই। মেডিক্যাল অফিসার থাকলেও আসেন না। রোগীরা মাঝে মাঝে এসে মারমুখী হয়ে ওঠে ওষুধপত্র নেই বলে। কিন্তু কিছুই করার থাকে না, সব সহ্য করতে হয়। কেন ওষুধ বরাদ্দ নেই সেটা তো ওপরের কর্তারা জানেন। আর তার জন্য জনরোষে পড়তে হয় দায়িত্ব পালনরতদেরকে। এক চিকিৎসা সহকারী আক্ষেপের সাথে পাশের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসারকে দেখিয়ে বলেন, দু'জনে এক-ই সাথে একই সাথে ডিপ্লোমা পাশ করেছি, কিন্তু আজ সে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার আর আমি চিকিৎসা সহকারী। সে প্রমোশন পায়নি বা আমার চেয়ে বেশী দক্ষ তা নয়। সে ফ্যামিলী প্ল্যানিং এ চাকরী করে আর আমি স্বাস্থ্য বিভাগে- পার্থক্য শুধু এটুকুই। আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে ১৯৯৬ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক গেজেটের মাধ্যমে 'চিকিৎসা সহকারী' পদটিকে 'উপ-সহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা' পদে রূপান্তরের আদেশ দেয়। ঐ আদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই ১৬ বছরে সেটি কার্যকর করেনি। ত্বত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পর পর ৩ বার নোটিশ দেয়া হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে দায়ের করা এক রিটের রায়ে গত বছর ২০১১ এর অক্টোবরের ১৭ তারিখ হাইকোর্ট অবিলম্বে পদের নাম পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়। কিন্তু রায়ের পর সাড়ে তিন মাসেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই নির্দেশ পালন করেনি।

পরে বিডিনিউজ২৪ডটকম এর স্বাস্থ্য পাতা সার্চ করে এর সত্যতা পেলাম। সেখানে 'স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক পদের নাম পরিবর্তনের নির্দেশ' শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের
লিংকটি দিয়ে দিলাম।

কুমিল্লায় ঘুরতে গিয়ে এমন কিছু কথাও কানে এসেছে, কিছু কিছু ডাক্তার নাকি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বসে অফিস টাইমে ভিজিট নিয়ে রোগী দেখেন। এতসব ঘটনা, দুর্ঘটনা, দুর্নীতি দেখে বা শুনে যা বুঝলাম তার সারমর্ম হল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত অনিয়মে ঢাকা। এই ঘটনা গুলো বিভিন্ন সময় পত্রিকায় ও প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীও এগুলো জানেন। যার কারণে বিভিন্ন সময় তারা নানা রকম হুঁশিয়ারীর বাণী উচ্চারণ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে। এমন কথাও আমরা বলতে শুনেছি, গ্রামে থেকে চিকিৎসা করতে না পারলে চাকরী ছেড়ে দেন। আমরা শুনে খুব আনন্দ পেয়েছি প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনে, আশাবাদীও হয়েছি। ভেবেছি এবার বোধহয় কিছু হবে। কিন্তু কই? যে লাউ সেই কদু।

শিরোনামেই তো বলেছি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ক্ষমতা হাইকোর্টের চেয়েও বেশী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তো শুধুই একটা প্রতিষ্ঠান, মানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর কর্তা ব্যক্তিদের ক্ষমতা। আমরা জানি, গেজেট প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর নির্দেশাকারে প্রকাশিত হয়। তারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করতে পারে, রাষ্ট্রপতির নির্দেশ/গেজেটও তাদের কাছে কিছুই না। শেষ ছিলো হাইকোর্ট। কিন্তু সেই হাইকোর্টের রায় ও তাদের গায়ের লোম পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি। এখন কয়েকটা প্রশ্ন মাথায় আসে। হাইকোর্টের রায় কতদিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হয় (৩মাসেরও বেশী)? হাইকোর্ট কি তাহলে অকার্যকর? স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কি এদেশে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান? প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, হাইকোর্ট এর চেয়েও ক্ষমতাশালী?
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দোৈনিক জনকন্ঠে প্রকাশিত একটি লিংক।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দোৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি লিংক।