কুমার চক্রবর্তীর কবিতায় ভাষার সীমানা ও সময়ের সেতু

মোস্তফা জামান
Published : 2 Oct 2021, 04:30 AM
Updated : 2 Oct 2021, 04:30 AM

১.
ভাষা ব্যবহার করে কবিরা ভাব-ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন। ভাষা দৃশ্যমান অক্ষর বা আকারের মধ্যস্থতায় ভাব প্রকাশের বাহন, তবু একে বস্তু নামে চিহ্নিত করা যায় না। যেহেতু ভাব প্রকাশ করাই এর ঐকিক স্বভাব। আধুনিক মানুষ ভাষার এই আচরণ ও স্বভাবের মধ্য থেকে পরাচৈতন্যগত বিষয়-আশয় দূর করে ভাষাকে গদ্য আকারে গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন, 'বাস্তব' ও 'বর্তমানকে' হাজির করবার বাসনায়। গদ্যসাহিত্য আধুনিক হয়ে উঠবার সোপান বটে, কিন্তু ভাষাকে তার আদিধর্ম থেকে দুরে আনবার এই চেষ্টা শতভাগ সফল হয় নাই। নতুন এ-ভূমিকায় নতুন দিগন্তের সন্ধান মিলেছে- উপন্যাসের মতো ফর্ম-এর উত্থানের মধ্যে দিয়ে সাহিত্যে আন্তর্জাতিক নবস্রোত তৈরী হয়েছে, সাহিত্যে বিপ্লব ঘটেছে বলেও দাবি করা যায়। তবু ভাষাকে 'বস্তুগত সত্যের' তরে নিখুঁত হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটি কখনই সম্পূর্ণ হয় নাই। গদ্যের মধ্যেও হামেসাই কবিত্ব রয়ে যায়, টের পাওয়া যায় যে বাস্তবের প্রামাণ্য দলিল তৈরিতে ভাষা অতটা নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে ওঠে নাই।

ভাষার মধ্যে বস্তুগত ও ভাবগত বিষয়সহ আরো নানান বিষয়ের প্রতি পক্ষপাতের কারণে গদ্য ও পদ্যের পৃথক দুই দুনিয়া প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। দ্ব্যত্মবাদী না হয়েও এ-সত্য স্বীকার করে নিয়ে ভাষার ও কবিতার আলোচনা শুরু করতে হয়।

বাস্তু-ভিটার নির্মাণে যেমন বস্তুগতের মধ্যে অবস্তুক বিষয়ের মিশেল লক্ষ্যণীয় — অর্থাৎ বাসযোগ্য যে কোনো কাঠামো যেমন কল্পনার শক্তিতে বাস্তব আকার পায় — কবিতার স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায় না। কবিতা লিখিতরূপে চোখে দেখা যায় — যে বহুস্তরিত শব্দ ও অর্থপ্রপঞ্চ, অক্ষর, এ-কার, ও-কার ও অপরাপর যতিচিহ্ন সহকারে দৃষ্ট হয়ে ওঠে, আকার পায়, তা চোখের সামনে হাজির থাকে। লেখ্যরূপ ভাষার প্রামাণ্য জগত তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন বস্তুগতের মধ্যে অবস্তুক বিষয় চিহ্নিত করতে গিয়ে এক অমর উদ্ভিজকল্পনার দ্বারস্থ হন, তখন কবির ভাষায় কবিতার অভিধা দাঁড়ায় 'কল্পনালতা'। কবিতা কল্পনালতা হলে তাহলে গদ্য সাহিত্যের নাম দেয়া যেতে পারে বাস্তব্য ভূমির ওপর স্তম্ভ, যাকে ফেলিক সিম্বলও বলা যায়।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বহিরঙ্গ আলোচনা করবার নিমিত্তে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী গদ্য ও পদ্যকে পৃথক প্রদেশ নামে চিহ্নিত করে গদ্যকে মর্ত্য ও পদ্যকে স্বর্গলোকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। কুমার চক্রবর্তীর বিচরণের ক্ষেত্রটি এই দুই জগতের মাঝ থেকে এক নিরপেক্ষ স্বরের সূত্রে গড়ে উঠেছে দাবি করা চলে। 'বাংলা গদ্যরীতির ১৪০ বৎসর' শিরোনামের এক প্রবন্ধে রামরাম বসু লিখেছিলেন, যদি পয়ার শব্দটি পদচার ছন্দ্য শব্দ উদ্ভূত হয়, তবে তা পদাতিক জাতীয় ছন্দ্য, যে ছন্দ্য পথিকের মত পায়ে হেঁটে চলে, নেচে চলে না। নেচে না চলার ধারণাটি কর্য করে আমরা কুমার চক্রবর্তীর কবিতায় নর্তন নেই কিন্তু ছন্দ্য রয়েছে, এমন দাবি করতে পারি। যে ছন্দ্য অলংকারশাস্ত্রের নিয়মের পর কবির নিষ্ঠারতি হতে জন্ম লয় নাই। কবি যে শব্দকল্পনার পথ তৈরি করেন তা ছন্দ্যবিদ্যার নিরিখে নির্ণয় করবার অবকাশ নাই। কবি কুমার যে 'স্বরের অনন্যতা' গড়ে তোলেন 'ফুলের ভাষা', 'বীজের ভাষা', 'স্তম্ভিত মনোভাবের ভুলভুলাইয়া' বা আপন 'মনোবাস্তবতাগ্রস্ত' বিষয়-আশয় গ্রন্থিত করার বাসনায়, সে ভাষার কারুকার্য নিজস্ব। এতে উপমা রয়েছে অনুপ্রাস নাই, এমনকি বিরলতর অন্ত্যানুপ্রাসও।

পাঠক সমীপে তিনি যা হাজির করেন তারে গদ্যচালের স্বর্গলোকীয় উৎপাদন বলে ব্যাখ্যা করা চলে। এই কবির কবিতা নিজস্বতার আবাদে সুনির্দিষ্ট কিছু রূপ রস গন্ধ শব্দ স্পর্শ লাভ করে– তারা অস্তিত্ব হয়ে ধরা দেয়।

যে সমস্ত বিষয়ের পর কবির নিষ্ঠা, যে যে রহস্য উদঘাটনে কবির মনযোগ, তার উৎসমুখগুলোর হদিস করা যাকঃ প্রকৃতি ও জীবনের রহস্য, অস্তিত্বের অনস্তিত্ব হয়ে উঠবার খায়েশ, আপন সত্তার মধ্য থেকে অপরের দিকে যাত্রা, এমনকি সত্তার দশা বিচার ও বর্ণনা, অস্তিত্বের সংকট ও নৈরাশ্যবাদ, সময় বা কালের সূত্রে নিজের সাথে নিজের ও বহির্জগতের সম্পর্ক — এসবই কবির বিষয়। আরো আছে ভাষাবিষয়ক উত্তাপ ও ওজনহীনতা, কারণ ভাষা যে প্রপঞ্চ তার মধ্য দিয়ে যে স্পর্শযোগ্য ও দৃশ্যমান দুনিয়ার বর্ণনা কেবলই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, সেই বিষয়ের পর কবির নজর আছে।

শূন্যতাও কবির এক বিশেষ মনোযোগের ক্ষেত্র। কবিতার দৃশ্যমান জ্যামিতি যে সকল অদৃশ্য বিষয়ের সূত্রে তৈরি হয়, তা দেহ-মন-দর্পণ বা দেহ-মন-নিরবস্তুকতা কিংবা জীবনের সাংগীতিক মাত্রা বা জ্যামিতি হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। যা এঁকে রেখে যেতে চান কবি, তা শুধু ছবি হয়ে থাকবার নয়, শব্দ দিয়ে গড়বার নয়, এমনকি ব্যাখ্যা করে বোঝাবারও নয়, কবি তা দৃশ্য-অদৃশ্যের দ্বৈততা পাশ কাটিয়ে অনুভূত ও দৃশ্যমান জগতপ্রপঞ্চ ভাষার আওতায় নিয়ে আসতে চান। আরো চান যাপিত জীবনের অয়নমন্ডলের সত্যসমূহের উন্মোচন। ফলে প্রচলিত আকার-নিরাকার, সময়-অসময় এমনকি বাস্তব-অবাস্তব, এমন বৈপরীত্ব তার কাব্যের দুনিয়ায় তেমন একটা কার্যকর থাকে না। বলা জরুরি যে, বোধ ও বৈদগ্ধ্যের সূত্রে কবি যাপিত জীবনের ধারনার সাধারণ কাঠামো নাকচ করে এর র‌্যান্ডমনেস বা অনতিক্রম্য ক্রমহীনতা চিহ্নিত করেন। এরই সূত্রে মানবের বাস্তবতা, যা কর্তার মধ্যস্ততায় যাপিত জীবনের বহুস্তরিত ভাষ্য তৈরী করা ছাড়া আর কোন উপসংহারের দিকে গমন করে না, ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়।

কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'সৃষ্ট জগতের সমগ্রতা মানুষের মধ্যে আসিয়া ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া গেছে।' বিশ্বকবি এইখানে মানবের ইচ্ছাকে চিহ্নিত করেছেন তাল নষ্টের উদ্যোক্তা হিসাবে। কবি লিখেছেন, 'মানুষের নিজের একটা ইচ্ছা আছে, জগতের লীলার সঙ্গে সে সমান তালে চলে না; বিশ্বের তালটা সে আজও সম্পূর্ণ কায়দা করিতে পারিল না। কথায় কথায় তাল কাটিয়া যায়' (কবির কৈফিয়ত, সবুজপত্র, প্রকাশকাল বাংলা ১৩২২)।

বাংলার বিশ্বখ্যাত কবি দুনিয়াদারির একটি দিক চিহ্নিত করেছেন। অপর যে দিক, যার সূত্রধর হিসাবে কবি কুমার চক্রবর্তী রবীন্দ্র-পরবর্তী কয়েকজন কবির সাথে সঙ্গত করেন, তা নিস্তব্ধতা, নিঃসঙ্গতা এমনকি শূন্যতা নামের সার্বজনীন এসেন্স বা সারবস্তুতে চেনা যায়।

অচেনাকে চেনার তরে যে শব্দপ্রপঞ্চ তা এমনতর স্পর্ষযোগ্য বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে ঘরের খবরদায়ী হয়ে থাকে। এমন অবস্তুক ধারণার মধ্যে দিয়ে ভাষার মধ্যে, তথা জীবন বিষয়ক বয়ানের ভিতরেও যে নিস্তব্ধতা, তার খোঁজ মেলে। জ্ঞানের মধ্য দিয়ে অনতিক্রম্য এই বোধ ফরাসী চিন্তক মার্লো পঁতি ভাষার প্রাইমর্ডিয়াল বা আদিম কাঠামোর মধ্যে চিহ্নিত করেছেন। পঁতি বলেন — আন্তরিক জীবন আসলে আন্তরিক ভাষা। অর্থাৎ, ভাষার আশ্রয়ে মানুষ জীবন গড়ে, যদিও ভাষা দিয়ে জীবনের শুরু নয়, এমনকি শেষও নয়।

বহির্জগত আর অন্তর্জগতের তাল যদি ইচ্ছার কবলে পড়ে দুইভাগ হয়ে যায়, যেমনটা রবি ঠাকুর লক্ষ্য করেছেন, ভাষার সূত্রে বয়ানও আদি হতেই বিভক্ত। এই বিভাজনে চোখ রাখবার আগে খোঁজ করা যাক, কুমার চক্রবর্তীর কবিতায় নিঃশব্দের ক্ষণ যে অনতিক্রম্য এ বিষয় কেন ফিরে ফিরে আসে। কবিতার শিরোনাম 'অতিক্রম', ক্ষুদ্র কলেবরের মধ্যে এতে বৃহতের ইশারা রয়েছে।

'মূহুর্ত ভরে আছে মূহুর্তে

যেমন জীবনের ভেতর ডুব দিয়ে থাকে জীবন

স্তব্ধতার আয়না

না বলতে না বলতেই

আমরা পেরিয়ে যাব বলার সীমানা।'

এরপর ভাষার সীমানা আর জীবনের সীমানা একার্থবাচক গণ্য করা যায় কিনা, প্রশ্ন রয়ে যায়। যাপিত জীবন ও প্রকাশিত জীবন এক বলে গণ্য করা চলে না। ভাষাপ্রাপ্ত প্রাণীর এমনই পরিণতি। এই পরিণতির কথাই ওপরের পাঁচটি স্তবকে বিধৃত।

ভাষা মানুষে মানুষে নৈকট্য আনে, আবেগ ও বুদ্ধি উৎপাদন করার মধ্যে দিয়ে। অথচ ভাষা বিষয় ও বিষয়ীর মধ্যে দূরত্ব তৈরী করে দেয়, যা চিরন্তন। আবার ভাষার মাঝে যে আদি নৈঃশব্দ্য, তার সূত্রে জগতের মধ্যে ঐক্যের ধারণা জন্মে। বলা, না-বলার বিপরীত কোনো ক্রিয়া নয়, বরং না-বলা বা নৈঃশব্দ্য ভাষার মূল প্রাণ। অর্থাৎ যা বর্ণনীয় তা অবর্ননীয়ের মধ্যে থেকে বর্ণনীয়।

কবি কুমার চক্রবর্তীর অসংখ্য কবিতায় হয়তো এর ইঙ্গিত মেলে। কারণ ভাষাপূর্ব যুগে দেহ ও মন নামের ঐকিক সত্তায় যদি ধরে নেই 'ইচ্ছার' ছেদ ছিল না, তবে এই সত্তার মধ্যেই নিঃশব্দের বাস। অর্থাৎ ভাষার-জীবনের-যাপনের নৈঃশব্দ্য সত্তার ভাষাপূর্ব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে ভাষাপ্রাপ্ত সত্তার মধ্যে জেগে ওঠে। কবিতা এমন দুই সত্তার মধ্যে দিয়ে সত্তার আদি, বর্তমান ও অনন্ত এই তিনের মধ্যে সহজে গড়ায়। একারণে কবি আদ্যপান্ত বর্ণনায় মাতেন, দেখেন বা অনুভব করেন এমন কিছু যা গদ্যে সুরাহা করা যায় না, গৎ বাঁধা, নিয়ামানুগ দুনিয়াদারীতে যার খোঁজ মেলে না।

দুনিয়ার আড়ে যে পরাদুনিয়া বা দুনিয়া-পূর্ব যে জগত, কবি তা উদঘাটনের চেষ্টা করেন। 'অদৃশ্য ল্যান্ডস্কেপে' লক্ষ্য করা যায় কালের বিলোপ। কবির সম্মুখে উপস্থিত বিশ্ব আগের দেখা বিষয়ের সাথে একাকার হয়ে যেতে যেতে তার মাঝে 'অনন্তের বোধ' জন্ম দেয়। কবি দেখেন ও বর্ণনা করেন: 'যেভাবে পাথর থেকে বের হয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস

সম্ভবত নীরবতা আঁকে তার ভাষা, যে ভাষায়

অন্তহীন রূপান্তর বেলাভূমি ছেয়ে একাকী দাঁড়ায়।'

জাগতিকতার আওতায় সাধারণ যে দেখার সূত্র, সেই দেখা ও বোঝাপরার মধ্য দিয়ে তাই কবির ঐকান্তিক কামনা-বাসনার প্রকাশ যেমন হবার নয়, তেমন জীবনের গূঢ় সত্য বিষয়ে বা রহস্যময় এলাকায় আলো ফেলা সম্ভব নয়। কুমার চক্রবর্তীর ২০১৯-এ প্রকাশিত কবিতা সংগ্রহে 'শুধু সাদা পড়ে থাকে' কবিতার শেষ লাইনে ওপরের চিন্তাপ্রকৌশলের পরিণতি কি দাঁড়ায় তার ইশারা মেলে: 'এইসব রাত সরে গেলে শুধু সাদা জেগে থাকে।' অর্থাৎ শুরু যদি অক্ষরহীনতায়, আকারহীনতায়, শেষ হলো সাদাপাতায়। শূন্যতাই আদ্যশক্তি হিসেবে কবিতার দালানের পিছনে খাড়া রয়।

২.

'তার বয়ানই তার চিন্তা'

— মার্লো পঁতি

বয়ানই ভাব, চিন্তা, এমনকি চিত্রকল্প। এমত ঐক্যের বিপরীতে কি করে কবিতায়, কাব্যিক মাত্রা সৃষ্টির বাসনার সূত্রে কথা বা উচ্চারণ ভাগ হয়ে যায় তার হদিস করা যাক।

ভাষায় অর্থ নির্মাণের তাগিদে সোজাসাপ্টা প্রকাশময়তার প্রতি পক্ষপাত লক্ষণীয়। এমত প্রকল্পের সূত্রে লেখকেরা গদ্যের স্তম্ভের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকেন। কিন্তু ভাষার মধ্যে যে সাবলিমিনাল বা অন্তর্লীন মর্ম উপস্থিত, বয়ানকারী যদি তাকে শক্তির ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করেন, তবে তাকে কল্পনালতার ধারণায় থিতু হতে হয়, বিশ্বস্ত থাকতে হয় চেতনাপ্রবাহের র‌্যান্ডমনেসের সহজ প্রকাশে। সর্বোপরি, কবিতা আদিকাল থেকেই ভাষার মধ্যে যা অন্তঃসলীলা, সেই আপাত অধরা বিষয়ের উপাসনার ফল।

বাক্যের মধ্যে ইঙ্গিতময়তার সূত্রে গড়ে ওঠা দর্শন বা দেখা কবিতার মর্ম তৈয়ার করে। কুমার চক্রবর্তীর কবিতায় তা প্রামান্য বটে। ভাষা শিরোনামের কবিতায় কবির আর্তি: 'জেগে ওঠ ফুলের ভাষা, বপিত বীজের ভাষা' যদি হয় প্রকৃতির মাঝে আদিম সত্তা জাগিয়ে তোলার আহ্বান, তবে এর জগত-দর্শনও বর্তমান। একই কবিতায় কবি লেখেন, 'বই পড়ি, যতক্ষণ না পৃষ্ঠা থেকে উড়ে যায় শব্দরা।' মশকরার সূত্রে ভাষা যে অস্থিতিশীল নির্মাণ, সে দিকে কবি নির্দেশ করেন। ভাষা বস্তুগতের বিবিধ বর্ণনার নিমিত্তে এক প্রকার জাগতিকতার জন্ম দেয়, যা গদ্যময়, তার বিপরীতে কাব্যময়তার আকাশ নির্মাণ আসলে ভাষার নৈরাকার সত্তার স্বীকৃতি। সময়ের সেতু কবিতায় কবি লিখেনঃ

আমাদের শব্দগুলো বেড়ে যায়

আমাদের ভাষাপ্রবাহ বেড়ে যায়

আলোক বন্যার মতো কেঁপে ওঠা তোমার দেহের দিগন্তে।

এখানে, রূপের মধ্যে থেকে অরূপে পৌঁছানোর সহজ কোন ভ্রমণ নাই, যা আছে তা দেহ ঘিরে দেহেরই দিগন্তের ঠিকানা। অর্থাৎ কবি রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে, রূপের বিস্তৃতির সম্মুখীন হয়ে ভাষার স্ফিতির বা পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কথা বলছেন। রূপই কবির কাছে যথেষ্ট অধরা বিষয় — রূপের মাঝারেই শূন্যের শুরু, কারণ সকল অবয়বই রহস্যময় এবং তা শূন্যতার দিকেই অগ্রসর হয় বলে মনে হয়। এ কারণেই বাস্তবের বর্ণনা তৈরি করবার জন্য ভাষা যথেষ্ট নয়। দু'লাইন বাদে একই কবিতায় কবি লেখেন:

এভাবেই তুমি আসো হে রাতজাগা গোলাপ

প্রাচীন পুস্তকের অনুভূতি মতো

যেন অন্ধকারে চুপ করে থাকা কোন পাখির মর্ত্যবোধ।

অর্থাৎ বেঁচে থাকার মধ্যে যা কিছু সারমর্ম তা যেমন অর্থবাচকতার মধ্যে দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বা নিজের হয়ে ওঠে না, তেমন স্মৃতির চিত্র হিসাবেও তাদের গণ্য করা চলে না। তারা এক মোকাম গড়ে তোলে, যেখানে বোধ ও অনুভূতি সজাগ হয়ে ওঠে। বস্তুও হয়ে ওঠে অনুভূতিপ্রবণ, যেমনটা কবি কুমার পুস্তকের প্রাচীনতায় অনুভব করেছেন। এমত নৈরাকারের রূপদর্শন যদি হয় দার্শনিকতালব্ধ বাস্তবতা, তবে দৃশ্যমান দুনিয়ার খোদ বা আসল ব্যাখ্যাকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন কবি। বদ্রিআরের ভাষায় তিনি প্রত্যক্ষ জগতের মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন 'নাস্তি' নিয়তির আকারে উপস্থিত, তার পর দৃষ্টি রাখেন। কবি কুমারের কাছে যা 'নাই' তাও অস্তিত্বশীল হয়ে ধরা দেয়। কবি কুমার শুধু স্বীকৃতির মধ্যেই থেমে থাকেন না, পৃষ্ঠা থেকে শব্দরা, অর্থাৎ আকার-আকৃতিগুলো উড়ে যায়, যাতে মর্মে চোখ রাখা যায়। ওমন উদ্ধারপর্বে কবি লক্ষ্য করেন 'গাছ পালায় আর শূন্যতায়'। কিন্তু এই ন-স্থানে থিতু হন না কবি। তার মর্মের বাগান আরো দক্ষিণে, আরো আদি কোন 'আমির' ভিতরে সম্ভাবনার ফুল হয়ে ধরা দেয়। কবির আপন ভাষায়: 'যতক্ষণ না আমি জেগে উঠি / কথা বলি বোবা ভাষায়'। জগত যদি ভাষা ও মর্মে, এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল, এ কবির মনোযোগ দু'য়ের মধ্যে সমভাবে লক্ষণীয়।

আগেই চিহ্নিত করা গেল যে, কবিতার কাঠামো নির্মাণে বা শৈলীর সূত্রে কবি গদ্য ও পদ্যের মাঝখান দিয়ে হাঁটেন। পদচারণায় ছান্দিক বৈশিষ্ট্য যে চঞ্চলতা নিয়ে আসে, যে সৌন্দর্যের জন্ম দেয়, তেমন কাব্যিকতা আরোপ না করবার তাগিদে কবি গদ্যরীতি পদ্যের দুনিয়াতে জাগিয়ে রাখেন। প্রাত্যহিক বাস্তব অভিজ্ঞতা বলবার বাসনা থেকে যদি আধুনিক গদ্যরীতির জন্ম, যুক্তি-তর্কের রাস্তা তৈরী করবার জাগতিক ইচ্ছা যদি এর মূল অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে, কবি কুমার তাকে ব্যক্তিগত সত্যোপলব্ধি ও সময়উত্তীর্ণ বাস্তবের ধারণা নির্মাণে ব্যবহার করেন। সর্বপরি, স্থান-কাল যদি কর্তার মনোবাঞ্ছা বা ইচ্ছার অভিঘাতে খন্ড খন্ড হয়ে যায়, এই কবি তা একের ধারণার মাঝে ফিরিয়ে আনতে চান, অর্থাৎ সমগ্রকে ঐকিক বাস্তবতা হিসাবে দেখতে ও দেখাতে চান। এমন দার্শনিক প্রকল্প বাস্তবায়নে কবি ধীরলয়ে কথা বলেন, গদ্যের গুরু-স্বর ও কাব্যের লঘুছন্দ এ দুয়ের মাঝভুবনে বিরাজ করেন।

এই কবির কবিতায় ধর্মবোধ আছে, কিন্ত কোন সর্বকুলশাসনকারী সয়ম্ভূ ঈশ্বর নাই, ফলে ধীরগতি ভাষাশৈলী তার নিরাবেগ বয়ান সৃষ্টিতে সহযোগীতা করে — ভাবকে পাঠকের অন্তরে জায়গা করে নিতেও সাহায্য করে। কবি 'বস্তু থেকে ছায়ায়' কবিতায় লেখেনঃ

'জন্মমৃত্যুর মাঝে যে নৌকা তার কোনো মাঝিমালা নেই

নিজেই সে চলে জন্ম থেকে মৃত্যুতে, বস্তু থেকে অনস্তিত্বে।'

পাশ্চাত্যের যে লজিকবিদ্যা ঐতিহাসিকতা দিয়ে মানুষ, সত্তা ও তদসংলগ্ন আচার ও বিচারের প্রক্রিয়াকে সমন্নিত চেহারা দেবার প্রয়াস পায়, তা নির্মাণ মাত্র। মানুষ ও সত্তাবিষয়ক সত্য দার্শনিক বিচারের আওতায় এনে বয়ান তৈরীর যে কারখানা তার নাম অধিবিদ্যা। অধিবিদ্যা কবিতার বিষয় হয়ে উঠলে তখন তা আর তত্ত্ব থাকে না, ভাব হয়ে ওঠে — বস্তুর নিরিখে ও বস্তুনিরপেক্ষ যে ভাব, এই দুইপ্রস্থ ভাবপ্রপঞ্চ কুমার চক্রবর্তীর কবিতার মেজাজ গঠনে সহায়তা করেছে।

পাঠের সুবিধার্থে মূল্যায়নের মূল সূত্রগুলিতে ফের ঢু দেয়া যাক। কুমার চক্রবর্তীর কবিতার নির্মাণশৈলীর ঋজুতা, এর গদ্য-পদ্য ভেদহীন মন্থর গতি, এর ছন্দনিরপেক্ষ নির্মলতা মূলত স্বরের নিরপেক্ষতা, নিজস্ব অস্তিত্ববাদী দর্শন ও ফেনমেনলজি বা প্রপঞ্চবিদ্যার সূত্রে গড়ে উঠেছে বললে সত্যের অপলাপ হয় না।

প্রপঞ্চবিদ্যা বিষয়ে খোলাসা করে যে কথাটা কওয়া জরুরি, তা হল বস্তু কোন ইমেজ বা ছবিমাত্র নয়, কিংবা এসেন্সও নয়। বস্তু অনুভূতির ক্ষেত্রবিশেষ। এই সূত্রেই আলোচ্য কবির কবিতার ঘর ও ঘরানা আলাদা হয়ে যায় — বিষয় ও বিষয়ীর মধ্যেকার তফাৎ প্রকাশিত ভাবের মধ্যে দিয়ে নতুনভাবে বিন্যস্ত হবার সুযোগ পায়। কবি যেমন কবিতা গড়ে তোলেন তার অভিজ্ঞতার আলোয়, তেমন ভাষাও তাকে কবিতার কাঠামো নির্মাণে সাহায্য করে। কবির ভাষা ব্যবহার করে বলা চলে কবিতা 'আত্মমর্মরতা'।

৩.

কবিতা যদি হৃদয়গ্রাহী সত্য বলার পথরেখা বা গোপনীয় বিষয়ের উন্মোচন হয়ে থাকে, এর চিত্রকল্প, রূপকল্প ও উপমা, এই তিনের মধ্যে দিয়ে কবি কবিতার সুরাহা করেন। কবি কুমারের কাছে অনুপ্রাস অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু উপমা তাকে জগতের নতুনতর পাঠ তৈরীতে সাহায্য করে।

কবি বিনয় মজুমদার অলঙ্কারশাস্ত্র বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে অনুপ্রাসের ব্যবহার নিয়ে কটুক্তি করতে দ্বিধা করেন নাই। বিনয়ের মতে অনুপ্রাস 'পর পর দশটি কি পনেরোটি কবিতায় ব্যবহার করলে অসহ্য বোধ হয়'। অন্যদিকে উপমা বিষয়ে তিনি যার পর নাই উৎসাহি — তার মতে 'উপমাই আমরা দৈনন্দিন কথাবার্তায় প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করি … সেই জন্যই উপমা কবিতার সবচেয়ে স্বাভাবিক অলঙ্কার।'

স্বাভাবিক এই অলঙ্কার কবি কুমার চক্রবর্তী কিছু সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে সামনে নিয়ে আসেন। উদাহরণ হিসাবে আমরা 'সময়ের সেতু' কবিতার চোখ রাখতে পারি। 'প্রেমপত্রের মৃদু পংক্তির মতো / গড়িয়ে আসা অনুভূতিরা আজ নিশ্চুপ,' কিংবা..'নির্জন পাহাড়ের গায়ে / দাঁড়িয়ে থাকা পাইন গাছের সম্মোহন,' এসবই 'ভাষাপ্রবাহের' মধ্যে বাস্তব বিষয়ের সাথে অনুভূতির জগতের সেতু নির্মাণের আয়োজন। আমি যে অভিধা, আপনার সাথে বর্হিজগতের সম্পর্ক নির্ধারণের যে অহংর্নিভর সর্বনাম বা উত্তমপুরুষ, তার দশা ব্যাখ্যা করতে একই কবিতায় কবি লেখেন 'আমি এক নদী যার দুই কুল ভেঙে গেছে'।

এমনতর উপমা ব্যবহারে কবির সংযম একটি লক্ষণীয় গুন — তিনি উপমা প্রতীকমুখীন করে তোলেন না। পাশাপাশি কবি সাক্ষী-সম্পর্কহীন কিছু প্রতীক ব্যবহার করেন। একই কবিতায় কবি প্রচলিত প্রতীক ও অপ্রচলিত বা ব্যক্তিগত কল্পনার সূত্রে পাওয়া প্রতীক ব্যবহার করেছেন। 'সময়ের সেতু' বা 'প্রাণভোমরা' যদি প্রচল শব্দবন্ধ হয়, 'তুমি এক প্রাচীন অ্যালবাম', 'সময়ের শরীর' কিংবা 'অতলের উচ্চতায় দেখা সবুজ আয়না' একান্ত নিজস্ব সৃষ্টি। 'মনস্তত্বের চন্দন' এমন আরেকটি প্রস্তাব।

রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ, এই চারিবৃত্তে শ্রবণের বিষয়টি নিস্তব্ধতার সূত্রে কবি চিরন্তনের বা শাশ্বতের প্রতীক হিসেবে খাড়া করেন। প্রকৃতির মধ্যে দিয়েও কবি চিরন্তনতার শরীর গড়ে তুলতে প্রয়াসী — সেক্ষেত্রে প্রতীক চিত্রকল্পে পরিণত হয়। 'সময়ের সেতু' থেকেই ফের মোক্ষম উদাহরণ সংগ্রহ করা যাক — 'আলোকন্যার মতো কেঁপে ওঠা তোমার দেহের দিগন্তে / মাস্তুলের শেষ ছবি রেখে হারিয়ে যায় এক সন্ধ্যানৌকা।'

রূপ থেকে রূপান্তরে অনায়াস গমন কুমার চক্রবর্তীর 'স্বভাব', এমনটা দাবি করা চলে । রূপান্তরের সূত্রে কবির চিত্রকল্প ব্যাখ্যা করা যায়। রূপকগুলো এনালজি বা সাবস্টিচিউটের মধ্যে দিয়ে কবি তৈরী করেন। কিন্তু এদের তিনি অনায়াসে নতুন সম্পর্কের দিকে ঠেলে দেন, অথবা রূপান্তর ঘটাতে পারেন, বা ভিন্ন এক মাত্রার উন্নীত করতে সক্ষম হন। 'কালো আয়না' কবিতায় যেমন এক অধরা জগত নির্মাণ করেন কবি — বস্তুত তুমি এক নদী যা বয়ে চলে দিগন্তে / অথবা তুমি এক গোপন গ্রন্থ, অক্ষরগুলো রাতে / উড়ে উড়ে ছায়ার মন্দির হয়ে রয়।'

বস্তু অবস্তুতে পরিণত হবার এমত উদাহরণ আরো ঢের পরিমাণে আমাদের আলোচ্য কবির কবিতার পাওয়া যাবে। এমন রূপান্তরে ধারণা এখানে রূপ ও রূপকের সম্পর্ক নির্ধারণ করে দেয়। 'পানসালায়' শিরোনামের কবিতায় এর উদাহরণ মেলে: গ্রামে গিয়ে দেখি — পাখিগুলো পাতা হয়ে গেছে / পাতাগুলো পাখি'

যে বিশেষ লক্ষণার অবতারণা না করে কুমার চক্রবর্তীর কবিতার শরীর ও অলংকার বিষয়ে আলোচনা এমনকি তার কাব্যপ্রতিভা লয়ে কথাবার্তা সম্পূর্ণ হবে না তার নাম এলিমিনেসন বা বিয়োজন। কবি বিনয় মজুমদার থেকে এ বিষয়ক বিদ্যা ধার করা যাক। এলিমিনেসন, যার বাংলা শব্দ কবি বিনয় প্রস্তাব করেন নাই, তার মতে বাদ দেয়ার প্রক্রিয়া, যা আধুনিক কবিতার একটি মৌল চরিত্র। পাশাপাশি কবি বিনয় কবুল করে নেন যে, এলিমিনেসনের 'ফলে রহস্যময়তা বাড়ে, দুর্বোধ্যতা বাড়ে — মাঝে মাঝে কবিতার, অর্থ 'কোনদিন বোঝা যাবে না' অবস্থায় এসে দাঁড়ায়।

বিনয় এর পর কবিতা বিষয়ে যা পেশ করেন, তা-ও কবি কুমার চক্রবর্তীর কবিতার আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। 'কবির চরম উদ্দেশ্য পাঠককে ভালো লাগানো, বোঝানো নয়, এবং দেখা গেছে আমাদের সর্বাপেক্ষা প্রিয় বাস্তব বস্তুগলি — চাঁদ, তারা, ফুল, লতা, নানাবিধ পাখি, পাখিদের গতিভঙ্গি ইত্যাদি কখনই আমরা সম্পূর্ণ বুঝি না।'

কবি কুমারের কবিতায় অলঙ্কার বিষয়ে আলোচনা উপলক্ষ করে যদি কিছুটা পথ আলোকিত করা গেল, তবে তার যাত্রা ও গন্তব্য বিষয়ে চোখ রাখা এখন জরুরি হয়ে পড়ে।

৪.

কুমার চক্রবর্তীর কবিতায় ভ্রমণ আছে, ভ্রমণবিলাসিতা নাই। এই কবির পদচারণা কাল্পনিকতার সূত্রে অতলাত্তিকও নয়, এমনকি বাস্তব দুনিয়ার বুকে পথচিহ্ন রেখে রেখে পরিক্রমণও তাঁর কীর্তির অংশ নয়। কবিকেই সাক্ষী মেনে, তাঁর আপন বয়ানের সূত্রে তাঁর ভ্রমণের প্রকৃতি উদঘাটন করা যাক। 'কবিতাসংগ্রহ' শিরোনামের ২০১৯ সালের সংকলনের ভূমিকায় কবি চিন্তার কতেক পদচিহ্ন রেখে গেছেন। কুমার চক্রবর্তী লিখেছেন সমুদ্রের মধ্য দিয়ে পথ করে এগিয়ে যাওয়ার কথা। প্রাথমিক বিচারে এই ইচ্ছার মাঝে নবুওয়াতি ইশারা মেলে, তবে, গন্তব্য বিষয়ে তাঁর বিষদ বর্ণনায় চোখ রাখলে এমন ধারণার পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। কবি অজানা দ্বীপের সন্ধানে অস্বাভাবিক ভ্রমণের স্বপ্ন দেখেন। এমত ভ্রমণ একান্তই ব্যক্তির, কবির, এতে গোষ্ঠীর হিতৈষণার কোনো নিশানা মেলে না।

কল্পনা কবির নিয়তি। এই নিয়তির ব্যাখ্যা দিতে আমরা আবার কবির দ্বারস্থ হতে পারি। কল্পনা ও বাস্তবতার বিস্তৃত দিগন্তের মধ্যেই কবির 'প্রাণান্ত অনুসন্ধান' যা, কবির মতে, 'ব্যর্থতা' নামের এক অপরিচিত স্থানাঙ্কে কবিতাকে স্থাপন করে। ব্যর্থতার মধ্যেই আবার কবির সার্থকতা নিহিত।

ভাষার আধিপত্যকে প্রশ্রয় দিয়ে 'দৃশ্য ও অদৃশ্যমান' বিশ্বকে বারংবার পাঠের আওতায় নিয়ে আসবার চেষ্টায় এই ব্যর্থতা বোধের জন্ম। এ এক দুনিয়াদারী ঠিক, কিন্তু তা 'গতিবাদের' বিপরীতে, কাল বিষয়ক সকল সফল 'বাগ্মিতার' অবর্তমানে গড়ে ওঠে। কবির কবিতার বাগান থেকে আমরা এই বাগবৈশিষ্ট্যের ধারা থেকে, শব্দ ও কল্পনার যুগলবন্দী থেকে যে নিশানা পাই, তারই সাহচর্যে এই নতুনতর জাগতিকতার কাঠামো চিনতে পারি।

কবিতার নরম মাটিতে আমরা যে রতœসম্ভার ব্যঙ্ময় হয়ে ফুটে উঠতে দেখি তার কয়েকটির সূত্র ধরে এই আলোচনা গাঢ় করে তোলা যায়। পরপর কয়েকটি শব্দবন্ধে ঢু দেয়া যাক: 'শিথিল সাক্ষর', 'সম্ভাষণ', প্রান্তিকগামী রূপরেখা', 'বাস্তুহীনতা', 'বেতার সংকেতখেলা', 'মোহঘর', কিংবা 'নিশিভাষ্য'।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধের অনুসারী পদকর্তাদের সান্ধ্যভাষার কথা আমাদের জানা, শিথিল সাক্ষর থেকে নিশিভাষা অবধি ভাষিক নির্মাণে আমরা যে ঠিকানা পেলাম তা জগতের সাংগীতিক এক ধারাভাষ্য। এই ভাষ্য যদি বাস্তুহীন হয়, অর্থাৎ এর যদি কোনো ঘরানা না থাকে, এর জন্ম 'প্রান্তিকগামী' এক মধুভাষী কবির নিমিত্তে সৃষ্ট হয়েছে যিনি জগতের প্রামাণ্য পাঠ সন্দেহের দৃষ্টি দিয়ে পুনরায় পাঠ না করে, নতুন পাঠের আয়োজন করেন। ভাষা যে নির্ভরযোগ্য কোনো মাধ্যম নয়, এ বিষয়েও কবি সদা সজাগ — যার চিহ্ন তাঁর প্রায় প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি পঙক্তিতে লক্ষ্য করা যায়।

কুমার চক্রবর্তীর স্বগতোক্তি: কবিতার অপূর্ণতা আসলে ভাষার অপূর্ণতা। ফলে আমরা যদি প্রথম প্রস্তাবে ফিরে যাই — ব্যর্থতার প্রশ্নটি আবার সামনে নিয়ে আসি — তবে, ভাষার যে দরদালানে মানুষের বসবাস তার যে ফ্লুইড বা তরল ও প্রায় অধরা গঠন, তার চরিত্র অনুসারে আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দুনিয়া নির্মিত হতে থাকে। আধুনিক দুনিয়ার গতি ও গৎ এমন প্রায়-অধরা কাঠামোকে উপযোগিতা নির্ভর এক মাধ্যমে রূপান্তরিত করে নেয়। মুনাফা ও সহজ গন্তব্য — এই দুয়ের চক্রে যে নিরস গদ্যময়তা, তার বিপরীতে, বস্তুবাদীতার কেন্দ্র থেকে নিজেকে প্রান্তে স্থাপন করে, জীবন ও জগতের যে পাঠ, কবি তারই ভাষ্যকার। অসংখ্য বিন্দুর গান কবিতার শুরুতেই কবি জীবনের ফ্লুইডিটি বা বস্তু ও তার ব্যাখ্যার অস্থায়িত্ব স্পষ্ট করে তোলেন:

অসংখ্য বিন্দুর ওপর দিয়ে যখন যাই, আসলে সরলরেখার ওপর দিয়ে যাই, অসংখ্য সরলরেখার ওপর দিয়ে যখন যাই, ভাবি, রেললাইনের ওপর দিয়েই যেন যাই।

দেখা ও ভাষ্যের ভারসাম্য তাই সহজ কোনো বিজ্ঞান বা বিদ্যা দিয়ে সম্ভব হয় না। জগতকে ভাষার আওতায় নিয়ে আসাই যেখানে দুরূহ কাজ, তখন সংবেদনশীল চোখে তা থেকে প্রেম, প্রকৃতি, গমন, গন্তব্য — ইত্যাকার সকল বিষয়ের মর্ম উদঘাটন আরও জটিলতর এক প্রক্রিয়া। চোখ তো দেহ-মন-প্রজ্ঞার সাথেও সংলগ্ন। চোখের আলাদা কোনো একক ও স্বয়ম্ভু অস্তিত্ব নাই। যে আমি দেখে, তার দেহ সংবেদনার আধার, জ্ঞানের বাটি বা ঘর। আবার যখন সে ভ্রমণরত এবং তার গন্তব্য পুঁজি ও বস্তুবাদীতার মিথ্যা অহমিকা ও আহম্মকি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, তখন ভিন্ন এক সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। কবির আপন বয়ানে এই সৌন্দর্যের কাঠামো দেয়া যেতে পারে। 'মন্থরতার সৌন্দর্য আর বস্তুর সমাহিত রূপের সন্ধান করাটা জরুরি', এই আর্তির মাঝে অনুধাবন করা যায় যে কুমার চক্রবর্তী সহজগম্য কোনো আইটিনারারি বা ভ্রমণের তালিকা তৈরি করেন নাই। গন্তব্য তাঁর কাছে সমুদ্রের বিশালতার মধ্যে এক অচেনা দ্বীপের মতোই। এই চিত্রকল্প ছাড়াও হয়তো আরও কিছু গন্তব্যের ঠিকানা কবির কবিতা থেকে সংগ্রহ করা যায়। যেমন, 'অতলের কাছে' কবিতায় কবি কিছুটা ক্লান্তি ও শ্লেষের স্বরে লিখছেন, 'বল তুমি, কিভাবে সফল হব অন্তহীন / ভ্রমণের শেষে, জোছনার ছায়া ধরেও / হেঁটে যেতে অনায়াসে / কিভাবে পৌঁছব — তোমাদের কালবদলের দেশে'?

এই দেশ বা গন্তব্য বর্তমান গোলকায়িত বিশ্বের মধ্যে চিহ্নিত। কবির গন্তব্য একটু গহীন, এইখানে অতলান্তিকও বটে । কবি লিখেন: 'ভাবি, যদি যেতে পারি অতলের কাছে'।

উপসংহার

নৈরাশ্যের স্বর যদি কুমার চক্রবর্তীর কবিতার একটি দার্শনিক প্রকল্প হয়, অস্তিত্বের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও প্রকাশের সূত্রে যদি এমনটা আমরা স্থির করে বলতে পারি, তবু তা পাঠককে নৈরাস্যের অকুল দরিয়ায় নিক্ষেপ করে না। কবি মূলত কর্ম ও ফলের দূরত্ব সম্পর্কে জানান দেন মাত্র, এমনকি বলতে চান যে জীবনের ছকে কর্তার কর্তৃত্বের সীমা দুর্লঙ্ঘনীয়। পরিণতি বলে যে শেষ অধ্যায় তা রচিত হয় বটে, কিন্তু কর্তার এখানে করণীয় তেমন কিছু নাই। অন্তীমের ফল টক হলেও তা গ্রহন করতে হয়। কবি লেখেন:

আমরা সাদাকালোর ভেতর সঙ্গম করেছি

দেখেছি কিভাবে শরীরের রেখাগুলি

বাঁকা হয়ে যায়,

চেয়েছি সাদাছড়ি দিয়ে অন্ধজীবনকে

এগিয়ে নিয়ে যেতে।

(পানসালায়)

জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই বাসনাও মানুষের শাশ্বত বাসনা। পাশাপাশি প্রেম-প্রকৃতি, মানুষ ও অজানা বিষয়ের প্রতি আকর্ষন কবির দুনিয়ার সহজ আবাদের ভূমি উর্বর করে তোলে। একই কবিতার কবি লেখেন:

যেসব দিনের চাবি হারিয়ে ফেলেছি

সেই তোরঙের অন্ধকারে ঝুঁকি নেয় প্রেম।

সমাপ্তিতে কবি পুনরায় শুরু করবার আয়োজন লক্ষ্য করেন। বেশ কিছু কবিতায় এই মুদ্রা ফিরে ফিরে আসে। আধিবিদ্যক জ্বর কবিতার কবি লেখেন — 'প্রতিটি গন্তব্যই আসলেই আরম্ভর ভিত্তিবিন্দু,…' কিংবা একই কবিতায় যখন কবি লেখেন, 'আমি তো আমি নই, আমি হলাম তুমি আর সে, এবং পৃথিবীর অসংখ্য আয়না-প্রতীক নিয়ে ছকবন্দি ব্যক্তিত্বের উদ্ভিন্নতা।' মানব প্রকৃতি উদঘাটনে কবি কুমার আমি থেকে অনত্র গমন করেন — তারই পথরেখা তিনি কবিতায় রেখে যান বারংবার।

আমি, তুমি ও অপরের ঐক্য, মানব ও প্রকৃতির ঐক্য, আরও পর ইতিহাসপূর্ব যুগের পূর্বপুরুষের (হোক তা ভাষার নির্মাণ) সাথে ঐক্য, এমন বহুস্তরিত মিলনের ধারণা কুমার চক্রবর্তী কবিতায় জিইয়ে রাখেন। কবি লেখেন:

ছোট্ট পথটি চলে গেছে আনন্দের কোলাহল

নিয়ে। গাছগুলো স্বর্গীয় আভার ভেতর ওষুধি প্রেরণায়

হেসে ওঠে, যেন পূর্বপুরুষের ফেলে যাওয়া কৌম উল্লাস…

(প্রথম ভোর)

ভাষার সেতু থেকে শুরু করে সময় ও আরো আরো ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক সেতু এমত বহুবিধ নির্মাণের সূত্রে একাকী, মন্তরগতিপ্রিয় কবি ভাবিকালের দিগন্তেও চোখ রাখেন। পথপ্রদর্শনের স্পষ্ট বয়ান যদি নবুয়তির প্রমাণ হয়, সেখানে অলৌকিক অপরের মধ্যস্থতায় তা সাধিত হয়। কবির শব্দ বাক্য — যা চিত্রময় ও ভাবব্যঞ্জক — হয়তো কখনও কখনও অতিলৌকিকতার খুব কাছে চলে আসে। মহাবিশ্বমানচিত্র কবিতায় আমরা লক্ষ করি সময় অতিক্রম করবার কামনা। কবি লেখেন — 'মৃত্যুর আগেভাগে এমন এক পুস্তক রচনা করে যাব যা জীবনের কথা বলবে অন্ততকাল।'

বাস্তবতার জ্যামিতিক এক ব্যাখ্যা খাড়া করে, তা থেকে উত্তীর্ণ হবার পথ বাতলে দিতে চান। কবির স্বরে আমোঘ নিয়তি থেকে উদ্ধারের আকুতি স্পষ্ট: 'মহাবিশ্বমানচিত্র এক ত্রিমাত্রিক ধারণা, তাতে তোমরা পথ হারাবে আর তখন ধরতাই / হিসাবে তোমাদের কাজে লাগবে আমার এই শব্দহীন / পুস্তকখানা।'

এই ইচ্ছার আকাশ জীবনের ভূমিতে কবি গড়েন এক প্রকারের ধার্মিকতার সূত্রে। যে ধার্মিকতায় থিওফেনি বা ¯্রষ্টার অস্তিত্বের উন্মোচন নাই, কিন্তু জীবন ও তার গৎবাঁধা যাপনের যে যে বন্ধাত্ব বা জরাচিহ্ন – সবই তুরীর কোন ইচ্ছার মধ্যে দিয়ে পিছনে ফেলে আসবার তাগিদের মধ্যে চিহ্নিত।

কবির কাছে এইসব ইচ্ছা আসলে মুহূর্তের চাওয়া বই অন্য কিছু নয়। এখানেই অবতারপ্রতীম মানব সত্তা থেকে কবি পৃথক হয়ে যায়। তবে এমন হিরক মুহূর্তের চাওয়া, খেয়াল, এমনকি আবেগি উচ্চারণের পিছনে কবির বহুদিন ধরে গড়ে ওঠা জীবনদর্শন কার্য্যকর রয়। ফলে জীবন বিষয়ে, দুনিয়াতে মানবের পরিণতি নিয়ে, কবি কুমারের স্মরণীয় বহু আপ্তবাক্যের সন্ধান মেলে। আয়নামুহূর্ত কবিতার শেষ স্তবকের এমন দিনাতিপাতের সূত্রে গড়ে ওঠা প্রজ্ঞা ও তুমি-আমি যুগলের উদ্দীপনার স্থাপত্য লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।

দর্পন আজ তোমাকে অস্থির করে তুলবে,

বুঝবে তুমি, যাকে তুমি ভেবে বসে আছো জীবন

সে হলো প্রাত্যহিকতা

জীবন তো এখন এই আয়নামুহূর্তে

যখন তুমি আর আমি, রয়েছি যে নগ্নতায় মাখা!

আপাতত কবিতা বিষয়ে আলোচনার ইতি টেনে দিতে, কুমার চক্রবর্তীর কবিতার ভিতরে যে 'নরম ইঞ্জিন', যা 'মেঘের মতো চোখ নিয়ে' স্থির তাকিয়ে থাকে, কিংবা শোনে 'অজানা রেডিও স্টেশনের রহস্যময় ইথার সংকেতের মতো' কোন ধ্বনিপুঞ্জ, এমত 'বর্তমানের' পর চোখ রাখা যাক। যে বইয়ের মুখবন্ধ নির্মাণে তত্ত্ব ও তত্ত্ব বিনির্মাণের সূত্রে এত কথা বলা হলো, তার পর্ববিভাজন নিয়ে দুয়েকটি কথা বলা জরুরি।

যে পাঁচটি পর্বে এই পুস্তকের কলেবরকে নব এক বিন্যাসে বিন্যস্ত করা হল তার পিছনে গূঢ় কোন বিদ্যা নাই। ঘনিষ্ট পাঠের নিমিত্তে আপাত দৃষ্টিতে যে বর্গের ছায়া মিলেছে তাকেই মান্য জ্ঞান করে ও বইটি আত্ম ও অপর, সময় ও অস্তিত্বের জ্যামিতি, দেহ ও প্রকৃতি এবং মিলন ও মৌলিক জ্যামিতি পর্বে বিভাজন ।

এই পর্বসমূহ পাঠকের মনযোগের ক্ষেত্র তৈরী করার উদ্দেশ্যে তৈরী করা গেল। তবু জেনে রাখা জরুরি যে, কবির স্বভাব ও 'পথসূত্র' এমন যে তার সকল বাঙ্গময় প্রকাশ একত্রে উপস্থাপন করলেও বইটির চরিত্র বদলায় না। অর্থাৎ শিরোনামগুলো সতঃসিদ্ধ কোন বর্গ তৈরী করে না, বরং কবিতার প্রাথমিক পাঠে যে বিষয় সহজে লক্ষণীয় তার সূত্র ধরে গড়ে তোলা হয়েছে মাত্র। এই কারিগরির ফলে পাঠকের গমন সহজতর হলে, বর্গীকরণ সার্থক হয়েছে দাবি করা যাবে।