চুম্বন: বিজ্ঞান কী বলে

অভিজিৎ রায়
Published : 3 May 2011, 05:09 AM
Updated : 14 Feb 2014, 05:24 AM

প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ তরে।

প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন।

হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে

মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ 'পরে।

তোমার নয়ন পানে ধাইছে নয়ন,

অধর মরিতে চায় তোমার অধরে।

'দেহমিলন' নামে চতুষ্পদী কবিতার শুরুতে কবিগুরু উপরের যে চরণগুলো লিখেছেন, তা যেন প্রেম-ভালোবাসার একেবারে মোদ্দা কথা– 'অধর মরিতে চায় তোমার অধরে'! সত্যই তো। চুমুবিহীন প্রেম– যেন অনেকটা লবণহীন খিচুড়ির মতোই বিস্বাদ!

তাই ভালোবাসার কথা বললে অবধারিতভাবেই চুমুর কথা এসে পড়বে। ভালোবাসা প্রকাশের আদি এবং অকৃত্রিম মাধ্যমটির নাম যে চুম্বন– সে বিষয়ে সম্ভবত কেউই দ্বিমত করবেন না। কাজেই কেন কবিগুরুর কথামতো আমাদের অধর মরিতে চায় অন্যের অধরে– তার পেছনের বিজ্ঞানটি না জানলে আমাদের আর চলছে না। গত বছর বিডিআর্টসে একটা লেখা লিখেছিলাম'ভালোবাসার বিজ্ঞান'নামে। আমি সে লেখায় বলেছিলাম-–

''কবিগুরু যখন 'সখি ভালোবাসা কাহারে বলে?' বলে গানে গানে প্রশ্ন করেছিলেন কিংবা শেক্সপিয়র তাঁর নাটকের সংলাপ লিখেছিলেন, what 'tis to love? বলে, তখন কি তাঁরা একবারের জন্যও ভাবতে পেরেছিলেন তাঁদের এই প্রশ্নের উত্তর অপেক্ষা করছে তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে? বিবর্তন মনোবিজ্ঞানসহ বিবর্তনের বিভিন্ন শাখা থেকে পাওয়া প্রান্তিক জ্ঞানের বদৌলতে প্রেমের এক সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কিন্তু দেওয়া সম্ভব। কিছুদিন আগেও আমরা ঢালাওভাবে বলে দিতাম ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা নেই, বিজ্ঞান ভালোবাসার কোনো ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম ইত্যাদি। সেই দিন আর নেই। বিজ্ঞান এখন চোরের মতো সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছে ভালোবাসার গোপন কুঠুরিতে।''

আমি ২০১২ সালে একটা বই-ই লিখে ফেলেছিলাম 'ভালোবাসা কারে কয়' নামে [১]। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল শুদ্ধস্বর থেকে। ডারউইনীয় বিবর্তন এবং বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা বাংলায় সম্ভবত প্রথম বই ছিল এটি। তবে আজকের আলোচনা আরেকটু গভীরে। ভ্যালেনটাইনস ডে সামনে রেখে আমাদের আজকের আলোচনা ভালোবাসার চিরন্তন অভিব্যক্তি 'চুম্বন' নিয়ে।

বাঙালি, আফগানি, জাপানিজ, মালয় থেকে শুরু করে পশ্চিমা সংস্কৃতি– সব জায়গাতেই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চুম্বন পাওয়া যাবে। সংস্কৃতিভেদে চুম্বনের তারতম্য আর ভেদাভেদ আছে ঠিকই– কোথাও প্রেমিক প্রেমিকাকে কিংবা প্রেমিকা প্রেমিককে চুমু খায় গোপনে, কোথাও-বা প্রকাশ্যে, কারও চুম্বন শীতল, কারওটা-বা উদগ্র, কেউ ঘাড় কাত করে চুমু খায়, কেউ-বা খায় মাথা সোজা রেখে। কিন্তু চুম্বন আছেই– মানবসভ্যতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে [২]। তাই চুম্বনের বিবর্তনীয় উৎসটি আমাদের জানা চাই।

আর শুধু মানুষই নয়, অনেকে জেনে হয়তো অবাক হবেন, চুমুর অস্তিত্ব রয়েছে এমনকি অন্যান্য অনেক প্রাণির মধ্যেই [৩]। ইঁদুর, কুকুর, বিড়াল, পাখি থেকে শুরু করে শিম্পাঞ্জি, বনোবোসহ বহু প্রাণির মধ্যেই চুম্বনের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেছে। এ সমস্ত প্রাণিদের কেউ-বা চুমু খায় খাদ্যবিনিময় থেকে শুরু করে আদর-সোহাগ বিনিময়, এমনকি ঝগড়া-ফ্যাসাদ মেটাতেও। বিজ্ঞানী ফ্র্যান্স ডি ওয়াল তার প্রাইমেট সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণায় দেখিয়েছেন, চুম্বনের ব্যাপারটা মানবসমাজেরই কেবল একচেটিয়া নয়, আমাদের অন্য সকল জ্ঞাতিভাই প্রাইমেটদের মধ্যেও তা প্রবলভাবেই দৃশ্যমান।

কেউ কি কবুতরের চুমু খাওয়া দেখেছেন? ওরা ঘরের চালে একেবারে উপরে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট আংটার মতো করে আটকিয়ে দেয়। তারপরে বিশেষ ছন্দে উঠানামা করে মিনিটখানেক। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে একে বলে 'নালিভাঙা'। তারা বলে, ''কবুতর নালি ভাঙছে, বাচ্চা হবে" [৪]। কিসিং গৌরামি (kissing gourami) নামে এক ধরনের মাছ আছে, যাদের মধ্যেও চুম্বন ব্যাপারটা বেশ প্রচলিত। যারা অ্যাকুরিয়ামে গৌরামি মাছ পালেন, তারা প্রায়শই এদের চুম্বনলীলা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

তবে কিসিং গৌরামিদের চুম্বন আসলে 'সত্যিকার' চুম্বন নয়। এদের চুম্বন এক ধরনের দ্বন্দ্বযুদ্ধের স্বরূপ, যার মাধ্যমে তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে; আর সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপারটা চুম্বন হিসেবে প্রতিভাত হয়। কুকুর, বিড়াল এবং পাখিদের মধ্যে মুখ দিয়ে অবলেহন (licking) এবং পরিচ্ছন্নতা (grooming) নির্দেশক অনেক কিছু করতে দেখা যায়, যা অনেক সময়ই অনেকের কাছে ভুলভাবে চুম্বন বলে মনে হতে পারে। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে মানুষের মধ্যে চুম্বনের ক্ষেত্র অনেকটাই ভিন্ন।

তাহলে মানবসমাজে চুম্বনের শুরুটা কোথায়, আর কীভাবে? বলা আসলেই মুশকিল। তবে ১৯৬০ সালে ইংরেজ প্রাণিবিজ্ঞানী ডেসমন্ড মরিস প্রথম প্রস্তাব করেন যে, চুম্বন সম্ভবত উদ্ভূত হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাইমেট মায়েদের খাবার চিবানো আর সেই খাবার অপরিণত সন্তানকে খাওয়ানোর মাধ্যমে। শিম্পাঞ্জি মায়েরা এখনও এভাবে সন্তানদের খাওয়ায়, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও ব্যাপারটা ঠিক এভাবেই এবং এ কারণেই তৈরি হয়েছিল। মনে করা হয় খাদ্যস্বল্পতার সময়গুলোতে যখন সন্তানকে খাবার যোগাতে পারত না, তখন অসহায় সন্তানকে প্রবোধ দিতে এভাবে মুখ দিয়ে খাবার খাওয়ানোর ভান করে সান্ত্বনা দিত স্নেহবৎসল মায়েরা।

এভাবেই একটা সময় চুম্বন মানববিবর্তনের একটি অংশ হয়ে উঠে, এর পরিধি বৃদ্ধি পায় সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থেকে প্রেমিক-প্রেমিকার রোমান্টিকতায়, যার বহুবিধ অভিব্যক্তি আমরা লক্ষ্য করি মানবসমাজের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে, আনাচে-কানাচে, নানাভাবে।

তবে আজকের দিনের চিরচেনা তীব্র রোমান্টিক প্রেমের সঙ্গে চুম্বনের জৈববৈজ্ঞানিক তথা বিবর্তনীয় উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের বের করতে হবে চুমু খাওয়ার এই মাধ্যমটি সম্পর্ক তৈরি এবং টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে কোনো ধরনের বাড়তি উপযোগিতা কখনও দিয়েছিল কিনা এবং এখনও দেয় কিনা। এ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন।

যেমন, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী গর্ডন জি গ্যালোপের (Gordon G. Gallup) গবেষণা থেকে জানা গেছে, চুম্বন মানবসমাজে মেটিং সিলেকশন বা যৌনসঙ্গী নির্বাচনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে [৫]। বিশেষ করে 'প্রথম চুম্বন' ব্যাপারটা রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ হিসেবে অনেকের জীবনেই উঠে আসে বলে মনে করা হয়। সাধারণত প্রথম প্রেম কিংবা প্রথম যৌনসঙ্গমের মতো প্রথম চুম্বনের ঘটনাও প্রায় সবাই হাজারো ঘটনার ভিড়ে মনের স্মৃতিকোঠায় সযত্নে জমিয়ে রাখে স্থায়ীভাবে। মহাকবি কায়কোবাদের একটা চমৎকার কবিতা আছে প্রথম চুম্বন নিয়ে–

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

যবে তুমি মুক্ত কেশে

ফুলরাণী বেশে এসে,

করেছিলে মোরে প্রিয় স্নেহ-আলিঙ্গন!

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন?

প্রথম চুম্বন!

মানব জীবনে আহা শান্তি-প্রস্রবণ!

কত প্রেম কত আশা,

কত স্নেহ ভালোবাসা,

বিরাজে তাহায়, সে যে অপার্থিব ধন!

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

হায় সে চুম্বনে

কত সুখ দুঃখে কত অশ্রু বরিষণ!

কত হাসি, কত ব্যথা,

আকুলতা, ব্যাকুলতা,

প্রাণে প্রাণে কত কথা, কত সম্ভাষণ!

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

সে চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রেম-সম্ভাষণ,

অতৃপ্ত হৃদয় মূলে

ভীষণ ঝটিকা তুলে,

উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!


তবে কায়কোবাদ প্রথম প্রেমের মাহাত্ম্য নিয়ে যতই কাব্য করুন না কেন, বাস্তবতা একটু অন্যরকম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্রেড ছাত্রদের উপর গবেষণা চালাতে গিয়ে গবেষকেরা দেখেন, অন্তত ৫৯ ভাগ ছাত্র এবং প্রায় ৬৬ ভাগ ছাত্রী স্বীকার করেছে যে তাদের জীবনে 'প্রথম চুম্বন'-এর পরপরই সঙ্গীর প্রতি আগ্রহ রাতারাতি উবে গেছে। এমন নয় যে সেই সব চুমু আসলেই 'খুব খারাপ' ছিল। কিন্তু প্রথমবার চুম্বনের পরই তাদের সবার মনে হয়েছিল, কোথায় যেন মিলছে না– সামথিং ইজ নট রাইট!

কিন্তু কেন এমন হয়? সেটাই ব্যাখ্যা করছেন বিজ্ঞানীরা। আমরা যে আগের অংশে ফেরোমোন এবং MHC জিনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম, দেহজ গন্ধের মাধ্যমে সেখানকার ভালোবাসার সংকেতগুলো পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে। ঠিক এমনটাই ঘটে চুম্বনের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ চুমুর মাধ্যমে সঙ্গীর বংশগতীয় কমপ্যাটিবিলিটির খোঁজ পায় মানব মস্তিষ্ক। অর্থাৎ সোজা বাংলায়, সঠিক চুমু মানসিকভাবে সঠিক যৌনসঙ্গী খুঁজে নিতে সহায়তা করে।

চুম্বনের পর যদি কায়কোবাদের মতো সেই 'আহা শান্তি-প্রস্রবণ' কিংবা 'ভীষণ ঝটিকা তুলে, উন্মত্ততা, মাদকতাভরা অনুক্ষণ' আসে আপনার কাছে, তাহলে বুঝতে হবে আপনার মস্তিষ্ক ইঙ্গিত করছে আপনার সঙ্গী বংশগতীয়ভাবে আপনার জন্য সঠিক। আপনার জৈবিক দেহ আপনার সঙ্গীর দ্বারা নিরুপদ্রপভাবে গর্ভধারণ করার জন্য নির্বাচিত হয়েছে! আর যদি চুম্বনের পর মনে হয় 'কোথায় যেন মিলছে না', তাহলে বুঝতে হবে যে, আপনার সঙ্গীর MHC জিনের বিন্যাস আপনার জন্য কমপিটেবল নয়।

তবে চুম্বনের রসায়নে নারী-পুরুষে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অধ্যাপক গ্যালোপ এবং তার সহকর্মীরা ১০৪১ জন কলেজ ছাত্রছাত্রীর উপর গবেষণা চালান। তাদের গবেষণা থেকে পাওয়া গেছে, তীব্র চুম্বন পুরুষদের জন্য আবির্ভূত হয় যৌনসম্পর্ক সূচিত করার পরবর্তী ধাপ হিসেবে। অন্যদিকে মেয়েরা চুম্বনকে গ্রহণ করে সম্পর্কের মানসিক উন্নয়নের একটি সুস্থিত পর্যায় হিসেবে [৬]।

গ্যালপের গবেষণায় আরও দেখা গেছে, চুম্বনের ব্যাপারটা ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিভাত হয়। মেয়েদের কাছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণই শুধু নয়, অধিকাংশ মেয়ে চুম্বন ছাড়া এমনকি সঙ্গীর সঙ্গে যৌনসম্ভোগে অস্বীকৃত হয়। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এতখানি প্রকট নয়। ছেলেদের কাছে একটা সময় পর চুমু খাওয়া না-খাওয়া তেমন বড় হয়ে উঠে না। চুমু-টুমু না খেয়ে হলেও কোনো 'আকর্ষণীয়' মেয়ের সঙ্গে যৌনসম্ভোগ করতে পারলে ছেলেদের জন্য তাতেই সই! সমীক্ষায় দেখা গেছে কেউ 'গুড কিসার' না হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের চেয়ে অধিক সংখ্যক ছেলেরা তার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়।

মেয়েদের জন্য চুম্বন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পেছনে কিছু বিবর্তনীয় কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। বিবর্তনের পথিকৃৎ চার্লস ডারউইন তার 'যৌনতার নির্বাচন' তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে খেয়াল করেছিলেন যে, প্রকৃতিতে প্রায় সর্বত্রই মেয়েরা সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে খুব বেশি হিসেবী, সাবধানী আর খুঁতখুঁতে হয়ে থাকে। ব্যাপারটি জীববিজ্ঞানে পরিচিত 'নারী অভিরুচি' (female choice) হিসেবে। ডারউইনের সময়ে ডারউইন ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করলেও এই নারী অভিরুচির পেছনের কারণ সম্পর্কে তিনি কিংবা তাঁর সমসাময়িক কেউ ভালোভাবে অবহিত ছিলেন না।

কিন্তু পরবর্তীকালের জীববিজ্ঞানী এবং বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায় এর পেছনের কারণটি আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যেতে শুরু করে। বিশেষত বিখ্যাত সামাজিক জীববিজ্ঞানী রবার্ট ট্রিভার্সের ১৯৭২ সালের গবেষণা এ ব্যাপারে একটি মাইলফলক [৭]। ট্রিভার্স তার গবেষণায় দেখান যে, প্রকৃতিতে (বিশেষত স্তন্যপায়ী জীবের ক্ষেত্রে) সন্তানের জন্ম এবং লালনপালনের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি শক্তি বিনিয়োগ করে। গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম দেওয়া, স্তন্যপান করানোসহ বহু কিছুতে মেয়েদেরই সার্বিকভাবে জড়িত হতে হয় বলে মেয়েদের তুলনামূলকভাবে অধিকতর বেশি শক্তি খরচ করতে হয়।

ভবিষ্যৎ জিন বা পরবর্তী প্রজন্ম রক্ষায় মেয়েদের এই অতিরিক্ত বেশি শক্তি খরচের ব্যাপারটা স্তন্যপায়ী সকল জীবদের জন্যই কমবেশি প্রযোজ্য। জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে parental investment বা 'অভিভাবকীয় বিনিয়োগ'। মানুষও একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হবার পরেও নির্দ্বিধায় বলা যায় মেয়েরাই অভিভাবকীয় বিনিয়োগের সিংহভাগে জড়িত থাকে। যেহেতু পুরুষদের তুলনায় নারীদের অভিভাবকীয় বিনিয়োগের সিংহভাগে জড়িত থাকতে হয়, তারা যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে হয়ে উঠে অধিকতর হিসেবী এবং সাবধানী। বিবর্তনীয় পথপরিক্রমায় মেয়েরা সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে অধিকতর সাবধানী হতে বাধ্য হয়েছে; কারণ অসতর্কভাবে 'দুষ্ট সঙ্গী' নির্বাচন করলে অযাচিত গর্ভধারণ সংক্রান্ত ঝুট-ঝামেলা পোহাতে হয় নারীকেই।

ডেভিড বাস তার Human Mating Strategies শীর্ষক গবেষণাপত্রে সেজন্যই লিখেছেন [৮]–

''বিবর্তনীয় যাত্রাপথে যে সকল মেয়েরা হিসেবী কিংবা সাবধানী ছিল না, তারা খুব কমই প্রজননগত সফলতা (reproductive success) অর্জন করতে পেরেছে। কিন্তু যারা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শয্যাসঙ্গী নির্বাচন করতে পেরেছে, যেমন যৌনসঙ্গী নির্বাচনের সময় গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করেছে তার সঙ্গী সঙ্গমের পরই পালিয়ে না গিয়ে তার সঙ্গেই থাকবে কিনা, বাবা হিসেবে তার ভবিষ্যৎ সন্তানের দেখভাল করবে কিনা, সন্তান এবং পরিবারের পরিচর্যায় বাড়তি বিনিয়োগ করবে কিনা ইত্যাদি– সে সমস্ত সতর্ক মেয়েরাই সফলভাবে প্রজননগত উপযোগিতা উপভোগ করতে পেরেছে।''

কাজেই ট্রিভার্সের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবজগতে প্রজাতির প্রজননগত সাফল্য এবং সফলভাবে প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার মূলে রয়েছে সেই প্রজাতির নারীদের সতর্ক careful mate choice বা 'সঙ্গীনির্বাচনী অভিরুচি'।

কাজেই যৌনসঙ্গীর ব্যাপারে নারীদের সতর্ক থাকতে হয়; কারণ ভুল সঙ্গী নির্বাচনের মাশুল হতে পারে ভয়াবহ। অন্তত একজন নারীর জন্য চুম্বন হয়ে উঠে সঙ্গী বাছাইয়ের একটি অবচেতন প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সে নির্ণয় করতে চেষ্টা করে তার সঙ্গী তার ভবিষ্যৎ সন্তানের অভিভাবকীয় বিনিয়োগে অবদান রাখবে কিনা কিংবা তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ (committed) কিনা ইত্যাদি [৯]। আর আগেই বলা হয়েছে, চুমুর মাধ্যমে MHC জিনের মধ্যকার ভালোবাসার সংকেতগুলো পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে। পুরুষের লালাগ্রন্থিতে যে সমস্ত যৌন হরমোনের উপস্থিতি থাকে, সেটার উপাত্তই চুমু বিশ্লেষণের জন্য বয়ে নিয়ে যায় মস্তিষ্কে।

চুম্বনের রসায়নে নারী-পুরুষে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও একটি বিষয়ে মিল পাওয়া গেছে। চুম্বন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে– নারী-পুরুষ উভয়েরই। মনোবিজ্ঞানী উইন্ডি হিল এবং তার ছাত্রী কেরি উইলসনের গবেষণা থেকে জানা গেছে, চুম্বনের পরে দেহের কর্টিসল (cortisol) হরমোন– যার পরিমাণ মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে বৃদ্ধি পায় বলে মনে করা হয়– তার স্তর লক্ষ্যণীয়ভাবে কমে আসে। এ থেকে বোঝা যায় যে, রোমান্টিক চুম্বন আমাদের মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকতে সহায়তা করে।

কাজেই বেশি করে চুমু খান, ভাতের উপর চাপ কমান।

🙂

তথ্যসূত্র:

[1] অভিজিৎ রায়, 'ভালোবাসা কারে কয়', শুদ্ধস্বর, ২০১২;

[2] অবশ্য চুম্বন ব্যাপারাটি সংস্কৃতি নির্বিশেষে সর্বজনীন (কালচারাল ইউনিভার্সাল) কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিছু গবেষক দেখেছেন যে মানবসমাজের সব জায়গায় চুম্বনের প্রচলন নেই। ডাচ বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার নাইরোপ তার একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, ফিনিশ একটি গোত্রে একসঙ্গে নগ্ন হয়ে স্নান করার প্রচলন আছে, কিন্তু চুম্বনের নেই। অনেক জায়গায় চুম্বনকে ঘৃণিত প্রথা বলেও মনে করা হয়। কিন্তু এই স্বল্প কয়েকটি সংস্কৃতি বাদ দিলে মানবসমাজের মোটামুটি সবাই চুম্বন ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত;

[3] "How animals kiss and make up", BBC News, October 13, 2003;

[4] মুক্তমনায় আমার 'সখি, ভালোবাসা কারে কয়, তৃতীয় পর্ব'-তে (চুম্বনের বিজ্ঞান) ড. নৃপেন সরকারের প্রাসঙ্গিক মন্তব্য;

[5] Susan M. Hughes, Marissa A. Harrison and Gordon G. Gallup, 'Sex Differences in Romantic Kissing Among College Students: An Evolutionary Perspective', Evolutionary Psychology, 2007, 5 (3): 612-631;

[6] Chip Walter, 'Affairs of the Lips: Why We Kiss', Scientific American Mind, February 2008;

[7] R.L. Trivers, 'Parental investment and sexual selection, In B. Campbell (Ed.), Sexual selection and the descent of man: 1871-1971 (pp. 136-179)', Chicago: Aldine, 1972;

[8] David Buss, 'Human Mating Strategies', Samfundsokonomen, 4, 47-58, 2002;

[9] Chip Walter, 'Affairs of the Lips: Why We Kiss', Scientific American Mind, February 2008.