ঈদ-উল-ফিতর: কিছু স্মৃতি কিছু কথা

মোস্তফা তোফায়েল
Published : 25 July 2014, 06:54 AM
Updated : 25 July 2014, 06:54 AM

ঈদ সামনে । ঢাকা থেকে রংপুর যাবো, কিন্তু আশংকা হচ্ছে বাসের টিকেট পাওয়া যাবে না। কিন্তু যেতে তো হবেই! নিজ বাড়িতে গিয়ে ঈদ উদযাপন করতে হবে আমাকে, আমার মতো বহু লক্ষ মানুষকে, যারা ঢাকা থেকে চারদিকে ছুটবেন; কেউ বাসে, কেউ ট্রেনে, কেউ লঞ্চে করে। ভেগান্তি থাকবে, ভোগান্তির প্রথম, দ্বিতীয় পর্যায় থাকবে, কারো কারো জন্য থাকবে ভোগান্তির একেবারে শেষ পর্যায়। তারা হয়তো বীরভোগ্যা বসুন্ধরায় বীরোচিত ভ্রমণের নীল-নকশা ঠিকভাবে করতে না পারার ফলশ্রুতিতে ভোগান্তির উৎকর্ষ পর্যায় মেনে নিতে বাধ্য হবেন; তারা বাড়ি পৌঁছতেই পারবেন না, পথেঘাটেই ঈদের নামাজ পড়বেন। ঈদে গ্রামের বাড়ি ফিরতেই হবে, এবং চরম দুর্ঘটনার সম্ভাবনা মাথায় নিয়েও তা করতে হবে। আগে আমি বাড়িতে বসে বসে বিশ্লেষকের ভূমিকায় শুধু খেদোক্তি করতাম ওই সব হতভাগ্য বাস-ট্রেন-লঞ্চযাত্রী বাড়িমুখীদের প্রতিঃ আহা, ক্রেইজটা কেন? গ্রামের বাড়ি গিয়েই ঈদ করতে হবে–এই উন্মাদনা কেন? ঢাকার মানুষ কি ঈদ করে না ? ঢাকায় থেকে কি ঈদ করা যায় না? এবার আমি নিজে এই ভুক্তভোগী। আমার মন এরই মধ্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। দেশের বাড়ি রংপুর থেকে ফোনের পর ফোন আসছে। কেউ কেউ আগেভাগেই ঢাকা থেকে রংপুর-কুড়িগ্রাম পৌঁছেছেন; তারা মোবাইল কলে বার বার তাগিদ দিচ্ছেন, কবে আসবেন, কবে রওয়ানা হচ্ছেন? বাস বা ট্রেনের টিকেট এখনো পাই নি!
"আমি হেথা কাঁদি একা নিয়ে বঞ্চিত হৃদয়খানি!
আকাশে উড়িছে বকপাঁতি, বেদনা আমার তারই সাথী"!
গ্রামের বাড়িতে আমার ঈদের মাঠে প্রথম যাওয়া ১৯৬২ সালের দিকে। মামাদের কোলেপিঠে শিশুকাল পেরিয়েছি আমি । মামাদের সাথেই ঈদের মাঠে গিয়েছি। মাথায় ছিল কাগজের টুপি; সেই টুপিতে লাল-নীল কাগজের নক্শা ছিল, পরণে ছিল পা-জামা, গায়ে ফুল-হাতা জামা। সেটা পাঞ্জাবি ছিল না, বেশ মনে আছে। তবে, একজন মামানি খুব আদর করে গায়ে পাউডার ছড়িয়ে দিয়েছেন, মুখে তিব্বত স্নো মাখিয়ে দিয়েছেন, চোখে সুরমা লাগিয়ে দিয়েছেন। মামাদের কেউ একজন নাকের ডগায় ও ডান হাতের আঙুলে আতর লাগিয়ে দিয়েছেন; সে আঁতরের তীব্র মৌ-মৌ গন্ধ বাতাসে ভূর-ভুর করে ভাসছিলো, পরিবেশ মুখর হয়ে উঠেছিল; ঈদের আনন্দ দেহ ও মনকে একাকার করে দিয়েছিল! সাত গ্রামের লোক মিলে ঈদের বড়ো জামায়াত হতো হাই স্কুল মাঠে।

মাঠে পৌঁছে দেখি, বট-পাইকের নিচে, উঁচু পাড়ে, প্রধান মাওলানা শাহ্ মোঃ খবির উদ্দীন ও সহকারী মাওলানা আমার নানাজী মৌলভি মোঃ ফজলে রহমান সাহেব বসে আছেন। নামাজের বেদীমূলকে ইসলামীমতে বলা হয় মিম্বার; সেই মিম্বার বা উঁচুস্তম্ভ ইমাম সাহেবদের নেতৃত্বের প্রতীক; মিম্বারের পাশে দুই প্রধান গুরুজন ভাব-গম্ভীর, শান্ত-সৌম্য ব্যক্তিত্বের অলৌকিক মহিমার দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়ে তেলাওয়াত-খুৎবা পাঠ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলেন। ষাটের দশকের ঈদগাহ মাঠের ঈদ জামায়াতের যে আলাদা ভাব-লোক, আলাদা আমেজ, ইমাম সাহেবদের প্রতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল, গাঢ় বিশ্বাস ছিল, তাঁদের কথা গুরুত্ব দিয়ে মর্যাদা দিয়ে শোনার মানসিকতা ছিল। প্রবীণ, বিদ্বান, বয়োজ্যেষ্ঠ ও সমাজনেতা ব্যক্তিগণ সমীহের পাত্র ও মান্যজন–এটা জনগণ উপলব্ধি করতো। এর ফলে, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ঐক্যবোধের ইতিবাচক দিকটি সুরক্ষিত ছিল।

আমি স্মরণ করছি, ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজের ইমাম সাহেব শাহ মোঃ খবির উদ্দীন সাত গ্রামের সমবেত জনগণের কাছে আবেদন করেছিলেন একটি সম্মতির জন্য। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে শুধু আরবী ও বাংলা শেখার জন্য চলে-আসা পুরাতন আমলের মাদ্রাসাটিকে তিনি আধুনিক ইংলিশ হাইস্কুলে পরিবর্তন করতে চান। তিনি জনগণের কাছে হাইস্কুল শিক্ষার সমসাময়িক উপযোগিতার কথা তুলে ধরেন, সময়ের চাহিদার সাথে সাথে চলমান বেকার সমস্যা সমাধানের পথ খুলে যাবে কিভাবে, তার অর্থনীতিসম্মত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। উপস্থিত হাজার হাজার সাধারণ লোক বিপুল করতালি , 'নারায়ে তাকবির' 'আল্লাহু আকবার ' প্রভৃতি ধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সানন্দসম্মতিতে তাঁকে ভূষিত করেন । ১৯৬৪ সাল থেকে মাদ্রাসাটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় এবং দশ গ্রামের হাজার হাজার তরুণ যুবকের আধুনিক মাধ্যমিক শিক্ষা উপহার দিতে থাকে। তারা সরকারি বেসরকারি চাকুরি পেতে শুরু করে, বহুসংখ্যক পরিবার আর্থিক দারিদ্র্যদশার কবল থেকে মুক্তি লাভ করে।

আমার মনে পড়ে, ঈদের জামায়াতের শ্রদ্ধেয় দ্বিতীয় ইমাম মৌলভী মোঃ ফজলে রহমান ঈদের নামাজ শেষে আরবী ও ফার্সী ভাষায় খুৎবা পাঠ করেন। আরবী ও ফার্সী ভাষায় পঠিত খুৎবার বাংলা তর্জমা থাকতো সংক্ষিপ্ত আকারে, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ ও বিতরণ। যাকাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ আমি তখনই পেয়েছিলাম। আমার যতটুকু মনে পড়ে, যাকাতের বিধান তিনি নিম্নরূপ বর্ণনা করেন:
মুসলিম, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়ষ্কের সম্পদের ওপর যাকাত ফরজ (বাধ্যতামূলক)। অমুসলিম, পাগল ও অপ্রাপ্তবয়স্কের সম্পদের ওপর যাকাত ফরজ (বাধ্যতামূলক) নয়।

ঈদ উল ফিৎর এর একটি বিশেষ দৃশ্যের ভুক্তভোগী দর্শক আমি। বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত স্বনামধন্য ব্যক্তির আঙিনায় অবস্থিত একটি প্রতিষ্ঠানে আমি কর্মরত ছিলাম বর্তমান শতব্দীর শুরুর দিককার তিন বছর। ঈদ উল ফিতর উপলক্ষে সেই ধনবান ব্যক্তি দুঃস্থ মহিলাদের মাঝে শাড়ি ও দুঃস্থ পুরুষদের লুঙ্গি যাকাত দিয়ে থাকেন। আগের রাত থেকে লাইনে দাঁড়ানো লোকদের নিয়ন্ত্রণে স্বেচ্ছাসেবকবাহিনীর পাশাপাশি সরকারের পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করে থাকেন। শাড়ি-লুঙ্গি দান করার বিষয়টি বহু বছরের প্রচারে, এবং প্রচারের প্রযুক্তিগত প্রসারে অনেকটা রীতি বা রুটিনে পরিণত হয়ে গেছে। যাকাতের শাড়িলুঙ্গি বিতরণ ঈদ সামনে রেখে ধনবান লোকদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে নেওয়ার একটা সুযোগও এনে দেয়। সে-কারণে আগের রাত থেকে গরীব-দুঃস্থ-অসুস্থ মানুষদের লম্বা লাইনের দৈর্ঘ ও ভীড় একটা উপাদান। এ-উপাদান ঐ ধনবানদের আত্মপ্রসাদ দেয়, তার ঈদের আনন্দ উৎসবকে মহিমান্বিত করে। ভীড়ের চাপে, হুড়াহুড়ি ও গুড়াগুড়িতে দুঃস্থ ও অসুস্থদের অনেকের প্রাণপাত ঘটে। ঘটুক, কিন্তু ভীড় যতো বাড়বে, লোক যতো জমবে, শোরগোল যতো গগনবিদারী হবে, প্রচার ততো উৎকর্ষ পাবে। ধনবানের শাড়িলুঙ্গি দান হবে মহিমান্বিত! সমাজ ও জনগণ মেনে নেবে যে তিনি মহান। কিন্তু দানের সাথে প্রচার মোটিফ কি ধর্মীয় মূল্যবোধে সমর্থনযোগ্য? দানের কাজটা কি এরকম একঘেঁয়ে অরুচিসম্মত একটি উপায়ে না-করে বিকল্প কোনো সুন্দর, শৃঙ্খলাপূর্ণ, তৃপ্তিকর এবং নির্ঝঞ্ঝাট অথচ দানের মৌলিক চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষার মাধ্যমে করা যায় না? পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী, নিরীহ ও বেকার মানুষেরা, দুঃস্থ ও অসুস্থ লোকজন কি পুরনো সেই গলির আঁধারেই ধুঁকে মরবে? ইসলামধর্মে যাকাত একটি আর্থনীতিক বিধি বিধান, যা ধনী-গরিবের বৈষম্য কমিয়ে আনতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করা হয়। 'বিশ্বাস' শব্দটি আসছে এ কারণে যে ইসলাম ধর্মের অনুগতদের মধ্যে যারা নির্ধারিত মানদন্ড অনুসারে যাকাত প্রদান করতে সক্ষম, তাদের জন্য এটা 'বাধ্যতামূলক'। এই 'বাধ্যতামূলক' আজ্ঞাটির মধ্যেই ধনী-গরিবের, বিত্তবান-বিত্তহীনের আকাশ-পাতাল ব্যবধান কমিয়ে আনার প্রত্যয় লুকিয়ে আছে।

বাংলাদেশে 'যাকাত বোর্ড' নামে একটি সংস্থাও রয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে। 'যাকাত বোর্ড' বিজ্ঞপ্তি আকারে যাকাত তহবিলে যাকাত প্রদানের আহবান প্রচার করে থাকে। যতটুকু জানি, বাংলাদেশে 'যাকাত বোর্ডে'র কর্মকান্ড যাকাত তহবিলে যাকাত প্রদানের আহ্বানের মধ্যেই সীমিত। এই যাকাত বোর্ডের কার্যক্রম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রমের মতো ব্যাপক, সুপরিকল্পিত ও আর্থনীতিক নয়। আয়করদাতাদের প্রত্যেকের আয়কর নির্ধারণের নথি আছে, উকিল আছে, দায়বদ্ধতা আছে। যাকাতদাতাদের যাকাত নির্ধারণের নথি নেই, উকিল নেই, দায়বদ্ধতা নেই। ব্যক্তির নিজস্ব নৈতিকতাবোধের মধ্যেই তা আবর্তিত। ব্যক্তি যেহেতু ব্যক্তিগত নৈতিকতাবোধে প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে ভিন্ন, সুতরাং কোনো সমন্বয়, নিষ্ঠা, কর্তব্যবোধ, দায়বদ্ধতা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। প্রাতিষ্ঠানিকতা, যা সমস্যা সমাধানের মূলমন্ত্র এবং কল্যাণ প্রতিষ্ঠার আবশ্যকীয় শর্ত–সেই প্রতিষ্ঠানিকতা প্রতিষ্ঠায় যাকাত বোর্ড কাজ করছে, এমন কোনো লক্ষণ পরিষ্কার নয়। প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতিষ্ঠা ঘটিয়ে বিত্তবান ও বিত্তহীনের ব্যবধান কমিয়ে আনা সম্ভব; ভিক্ষুক বা মানবেতর জীবন যাপনকারীদের মানবতাসম্মত জীবনযাত্রায় নিয়ে আসা সম্ভব।

সিঁড়িওয়ালা ও বিড়িওয়ালারা ঈদের জামায়াতে এক সারিতে বসবে আর ঈদ শেষেই নেমে পড়বে অতলান্ত খাদে, নিঃসীম নর্দমায়, ভাসবে অসীম অফুরন্ত কান্নায়–তা কাম্য হতে পারে না। তিনশ পঁয়ষট্টি দিন পরে একদিনের আনন্দ উৎসবকে ঐ বৈষম্য একটি ফাঁপা অনুষ্ঠানেই রূপ দান করে, যার সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত পরিকল্পকদের।