ব্যাংক বৃত্তান্ত ও ইবাদত বন্দেগির সারকথা

ইমদাদ হক
Published : 15 Jan 2017, 04:14 PM
Updated : 15 Jan 2017, 04:14 PM

তখন ঘড়ির কাঁটা ১২টা ৪০ এর ঘরে। স্বভাবসুলভ ফোন দিলাম মামুন ভাইকে (মামুন ভাই, সমকালের বিজনেস রিপোর্টার, এই ফোনটা এমনি এমনি, কখনো সখনো কাজে, প্রয়োজনে বা ফাও আলাপ জমাতে; তিনি যে ফোন পেয়ে উল্লসিত হন, মোটেও তা নয়; বরং খুব বিরক্ত হোন, এ বিরক্তির যে কোনো শেষ নেই, তা হয়তো তিনিও বুঝেন; কিন্তু তিনি আমারে খুব পছন্দও করেন। )।
– হ্যাঁ ইমদাদ, বলো (রিসিভ করেই, যেটা তাঁর স্বভাব)।
– মামুন ভাই, আপনি কই।
– এই যে, জনতা ব্যাংকের পরিকল্পনা কমিশন শাখায়।
– কি করেন।
– এই একটু কাজে আসছি। আচ্ছা ইমদাদ, রাখি হ্যাঁ ( এটা তাঁর ফোন কেটে দেয়ার লক্ষণ, প্রায়ই কথার মাঝে আচ্ছা রাখি হ্যাঁ, বলেই লাইনটা কটাস করে কেটে দেন।)
– আচ্ছা। আমি আসছি।

ঘটনার আরো ২০ মিনিট পরে গেলাম ব্যাংকে। মুখ কালো করে ভাই আমার বসে।
– কি করেন মামুন ভাই।
– বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাবো। বসে আছি।
– বসে আছেন কেন। পাঠান।
– হুম।
– হুমম কি। অনলাইনে টাকা পাঠাতে মাত্র পাঁচ মিনিট লাগে।
– হুমম।

আবারো হুম শুনে আগ্রহ দমে গেলো। ফাও প্যাঁচাল শুরু করলাম। গেলো আরো ১০ মিনিট। অবশেষে ভাই আমার উঠলেন। হাতে রাখা জমা স্লিপ দেখালেন দু'একজন অফিসারকে। অফিসাররা তো মহা ব্যস্ত। কোনো মতে দেখে দুখে মহা বিরক্তি সহকারে জানালেন, স্লিপ লেখা ঠিক আছে।

মামুন ভাইয়ের মুখের কালি আর কমে না। গেলো আরো ১০ মিনিট।

– ভাই, কি করেন। খিদা লাগছে। চলেন খেয়ে আসি।
– না, দাঁড়াও। টাকাটা জমা দিয়ে আসি।
– তাহলে দিচ্ছেন না কেন।

এবার বিরক্ত হলেন মামুন ভাই।
– সামনের দিকে তাকা।
– কই তাকাবো।
– ক্যাশ কাউন্টারে।
– হুম। তাকালাম।
– কি দেখিস।
– কিছু না। ফাঁকা। দুইটা চেয়ার। দুইটাই ফাঁকা।
– তাহলে টাকাটা জমা দেবো কার কাছে।
– ওরা কই গেছে।
– নামাজ পড়তে গেছে।
– দুইজনই? একটি ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টার ফাঁকা রেখে সবাই নামাজী হয়ে গেলেন? তাও, নামাজ পড়তে না হয় সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট লাগতে পারে। তাই বলে এক ঘন্টা ধরে তারা নামাজে মনোযোগী?
– তাহলে কি দেখছিস। পুরো দেশেরই একই অবস্থা। কোন সেক্টরটিতে দায়বদ্ধতা আছে?
– হো হো। ফিক করে দিলাম হেঁসে।

বড় ভাই আমার বিজ্ঞের মত দেশের দুরাবস্থা বর্ণনা করে গেলেন। ততক্ষণে ঘড়িতে বেলা ১টা বেজে ৪০। আমি এটা সেটা বলে সময়টা টেনে লম্বা করি। মামুন ভাই আরো বিরক্ত। বিরক্ত ব্যাংকে জমা হওয়া আমাদের মতো আরো দুই ডজন খানেক মানুষ।

হঠাৎ মামুন ভাই সোফা থেকে উঠে গেলেন। আমিও হুড়মুড় করে দাঁড়িয়ে গেলাম। তাঁকে অনুসরণ করি। তিনি সোজা দরজা ঠেলে ঢুকলেন সহকারি ম্যানেজারের রুমে।

– ভাই, আমি ১২টা ৪০ থেকে এখানে ওয়েট করছি, টাকা জমা দেবো বলে। আপনার দুইজন ক্যাশিয়ারই নামাজে গেছেন। তাদের ফেরার কোনো নাম নাই। একটা ব্যাংকে, সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার দুপুর বেলা এমন কান্ড ঘটতে পারে? আপনি এসব দেখেন না?

মামুন ভাইয়ের কথার ঝাঁজ বুঝতে পারলেন ভদ্রলোক। তড়িঘড়ি করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মামুন ভাইকে নিয়ে গেলেন বিশেষ এক কাউন্টারে। সেখানকার ভদ্র মহিলা ক্যাশিয়ার আবার টেবিলের উপর ভাত তরকারির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। কি আর করা। ভদ্রলোক দৌড়ে গেলেন আরেক অফিসারের কাছে। অনুরোধ করলেন, দ্রুত এই টাকাটা জমা দেয়ার ব্যবস্থা করতে। ততক্ষণে ২ টা বাজতে ৫ মিনিট বাঁকি। আমি সোফায় এসে দেখি, ভদ্রলোক ক্যাশিয়াররা ফিরেছেন। ফিরেই ঘর ভর্তি সেবাগ্রহণে ইচ্ছুক জনতার দিকে একটুও তাকালেন না। এটাতে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। বসে গেলেন ভাতের প্লেট নিয়ে।

একজন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
– টাকা উঠাবো।

খেঁকিয়ে উঠলেন একজন ক্যাশিয়ার।
– দেখেন না, খেতে বসেছি।
– কিন্তু আমি তো আধা ঘন্টা ধরে বসে আছি।
– ভাই, আপনাদের জন্য কি ইবাদত বন্দেগী, খাওয়া দাওয়াও করা যাবে না? (উল্টা খেঁকি।)

ধর্ম বলে কথা। ভদ্র লোক চুপ।

ততক্ষণে মামুন ভাই সহকারী ম্যানেজারের সহযোগিতায় টাকাটা জমা দিতে পেরেছেন। ঘড়িতে তখন বাজে ২ টা ১০ মিনিট। মানে, জনতা ব্যাংকে টাকা জমা দিতে লেগে গেলো পুরো এক ঘন্টা ৪৫ মিনিট, তাও ম্যানেজারের সহযোগিতায়, মামুন ভাই সাংবাদিক বলে। এমন অবস্থায় সাধারণ জনগণের ভোগান্তি কেমন হতে পারে?