লেখকের পাঠক বিভ্রান্তি!

ইমদাদ হক
Published : 11 Feb 2017, 06:38 PM
Updated : 11 Feb 2017, 06:38 PM

ঘড়ির কাঁটা তখন রাত চারটার ঘরে। এই রাতের বেলাতেও বেজে ওঠে মোবাইল ফোনটা। অপরিচিত নম্বর। ঘুমের ঘোরেই কেটে দেই। আবার ফোন। আবারও কাটি। আবারও কল। চরম অনিচ্ছায় ফোনের সবুজ বাটনে চাপ দেই।

ঘুমের আদ্রতা ভেদ করে কি আর কথা বেরোয়? কোনো মতে গলা দিয়ে বের হয়,

: হ্যালো…।
: হ্যালো শুভ্র। এটা শুভ্রর নম্বর নয়? হ্যালো…।
: জ্বী, শুভ্র বলছি। বলেন, আগে পরিচয়টা দেন। এত রাতে ফোন করেছেন?
: শুভ্র, আমি শমসের (নামটা ছদ্মই ব্যবহার করতে হলো। তিনিও এই শহরেই থাকেন। এখন মাঝে মাঝেই দেখা হয়।)। তোমার ফ্রেন্ড, আরে তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
: ফ্রেন্ড? তাও আবার বেস্ট ফ্রেন্ড? আমি স্যরি। ঘুমালাম ঘন্টাখানেক আগে ভাই। বলেন তো আপনার নামটা। মনে করতে পারছি না।
(ঘুমের ঘোরেই ভ্রুঁ কুঁচকে উঠে। মায়াদয়াহীন শহরে বাস করি। আশেপাশে যারা থাকেন, ভদ্রতা আর দুর্বলতা খুঁজে বেড়ান। সুযোগ পেলেই রড আর পাইপের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করেন। কঞ্চিয়ালা বাঁশ। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। আধো ঘুম-আর জাগরণ। ভাবনাগুলোও এক্বাদোক্বা খেলা শুরু করে। এ দিক ওদিক বেয়াড়া ছুটাছুটি করেও ভদ্রলোক শমসেরকে বের করতে পারি না। স্মৃতির মানসে ছিল কি কখনো? থাকলেও মনে হয় তাতে জং ধরে গেছে। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ ধুলাবালি। বুড়িগঙ্গার পচাপানিও আছে। এর নিচে চাপা পড়লে উদ্ধার করা কঠিন। মনের আঙিনায় তাকে খুঁজেই পেলাম না।)

: আরে ভাই, ওই যে, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে দেখা হয়েছিল। চার বছর আগে। সালমান তারেক শাকিল পরিচয় করে দিয়েছিল। সে সময় তোমার নম্বরটা সেভ করেছিলাম। পরে অবশ্য তোমার সঙ্গে আর কথা হয়নি। দেখাও হয়নি মনে হয়। যাই হোক, কত দিন তোমাকে মনে করি। তুমি এখন অনেক বড় সাংবাদিক। খুঁজে পেতে কত কষ্ট হলো। নম্বরটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমরা তো ফেসবুকেও আছি। ফেসবুকে নক করি, উত্তর দাও না। পরে অনেক কষ্ট করে নম্বরটা জোগাড় করে ফোন দিলাম।
: ও আচ্ছা। ফেসবুকে সাড়ে তিন হাজার ফ্রেন্ড। মনে হয় সাড়ে তিনশকেও ঠিক মত চিনি না, মনে করতে পারি না। ঘুরে ফিরে দেখি ওই কয়জনেরই আপডেট শো করে। তা বসিও না নিয়মিত। যাই হোক, কষ্ট হচ্ছে আসলে মনে করতে। তা বলেন। এত রাতে ফোন করেছেন।

: না মানে, একুশে বই মেলা তো শুরু হয়ে গেলো। আজ তিন দিন চলে গেলো। তাই আর কী।
: ও তাই? এবার মেলা কি ডে-নাইট? এই ভোর রাতেও আপনি কি স্টলে?
: আরে নাহ! তুমি দেখি এখনো মজা করো। একটা কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলাম।
: আচ্ছা। বলে ফেলুন ভাই। দেখি ঘুমের ব্যাটা আছে না গেছে। তাকে আনতে আবার বেগ পোহাতে হবে।
: আপনি মেলা কাভার করেন না?
: না ভাই। আপনি বলুন তো কি কথা। (মেজাজ চরমে উঠে)।
: আমি আসলে ছাইপাশের (একটি প্রকাশনার নাম) স্টলে বসি তো। আমি মেলায় থাকি প্রতিদিন। তাই আর কি। তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো চার বছর পর ফোন দিলাম।
: আচ্ছা বলেন ভাই। আমি এখনো মেলায় যাইনি। কবে যাবো, তাও জানি না। গেলে আপনাকে ফোন দেবো। নম্বরটা সেভ করে রাখছি।
: তুমি কি কাল আমার সঙ্গে দেখা করবে। খুব জরুরি দরকার।
: আচ্ছা, ফোনেই বলে ফেলুন না। মেলায় যেতে পারবো কি না বলতে পারছি না।
: কিন্তু শুভ্র, এটা জরুরি যে। দেখা করতেই হবে।
: বলেন না ভাই ফোনে।
: না ভাইয়া। তুমি ব্যস্ত থাকো জানি। প্লিজ, প্লিজ একটু দেখা করো। দশ মিনিটেই কথা হয়ে যাবে।
: আচ্ছা। চেষ্টা করবো। তবে মেলায় যেতে পারবো না। সকালে প্রেস ক্লাব বা শাহবাগ এলাকায় থাকিয়েন। এসে ফোন দেবো।
: না না। আসলে বিকাল তিনটার পর । অবশ্য রাত আটটার আগে হলেও হবে।
: জরুরি কি। ফোনেই বলেন। নয়তো আমার অফিসে আসেন।
: না না। কাল এসো। খুব জরুরি।

একটু কষ্টই করতে হলো। বিকালে অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। সময় বের করে পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে ফোন করলাম। দশ মিনিটের মধ্যে এলেন তিনি।
: চলো। বই মেলায়। তোমায় নিয়ে বই মেলায় যাই।
অনিচ্ছা সত্বেও গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। একটি স্টলের সামনে নিয়ে গিয়ে ঝটপট অর্ডার।
: দুইটা বই দাও তো। তাড়াতাড়ি।
: কিসের বই। কার বই।
বই নিয়ে শুরু করলেন অটোগ্রাফি। আমার নামে। আমার এক বান্ধবীর নামে। ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করেছেন যে নাম টি। হাসি মুখে বেশ এবার।
: এসো ফটো তুলি।

ফ্রান্স আর বলদ হয়ে গেলাম। চুপ করে তাকে অনুসরণ করছি।

খুশিতে বেশ গদগদ হয়ে বললেন-
: আমি আসলে অনেক ব্যস্ত। যাও। কথা হবে আবার। আসলে এটা আমার কবিতার বই। বেশ চলছে। খুব কাটতি। সবাই আসে। অটোগ্রাফি। ফটোগ্রাফি। অটোগ্রাফি।

দাঁতের দু'পাটি কেলিয়ে হাসলেন।
: আর হ্যাঁ, বই দুটির দাম সাড়ে তিনশ টাকা। টাকাটা দাও।
আবারও এক পশলা হাসি। কিছুই বলতে পারলাম না। বই বিক্রির ভাবনায় ব্রাশ করার কথা ভুলে গেছেন হয়তো। দাঁতগুলো হলুদই মনে হলো।

আধা ঘন্টার মধ্যেই ফেসবুকে ছবি। অনেক স্তুতি, সম্ভাষণ আর বিশেষণ; বই প্রকাশের কথা শুনে বেশ আগ্রহ নিয়ে গিয়েছি তার সঙ্গে দেখা করতে। কিনেছি তার বই। আমার মতো অনেকেই তার সঙ্গে ছবি উঠাচ্ছেন। তার কবিতা কিনছেন। একটু পর পর একেক জনের সঙ্গে ছবি, হাতে তার বই। হাস্যোজ্জ্বল লেখক প্রতিভা।

ফেসবুক থেকে লগ আউট করলাম শুধু।