নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতনে নন্দকুমারের ভূমিকা (পর্ব-২)

মাহফুজুল ইসলাম
Published : 22 Oct 2014, 05:01 PM
Updated : 22 Oct 2014, 05:01 PM

বৃটিশ সাংবাদিক লিওনার্দো মোজলে রচিত " The Last Days of British Raj " গ্রন্হটি  পাক – ভারত – বাংলাদেশ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি উল্লখযোগ্য সংযোজন । এই বইটি এতই সমাদৃত যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায় স্হান করে নিয়েছে । লেখক জীবনের অনেকটা সময় ভারতে কাটিয়েছেন এবং সাংবাদিকতা সূত্রে উপমহাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন । এই বইটির প্রারম্ভেই  উপমহাদেশের জনগন নিয়ে কয়েকটি মন্তব্য করেছেন । মন্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন – " এই রকম রাজনৈতিক আবেগ প্রবন জাতি তিনি পৃথিবীর কোথাও দেখেননি । সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই কানকথা শুনেই যে কোন কথাকে বিশ্বাস করে আন্দোলনে অংশগ্রহন করা পৃথিবীর একমাত্র জাতি হলো উপমহাদেশের জনগন ।" এই সাংবাদিকের মন্তব্য আসলেই সঠিক । ইংরেজ ও দেশীয় হিন্দু রাজারা চক্রান্ত করে নবাব সিরাজ – উদ – দৌলার পতনের মাধ্যমে বাংলার আকাশে যে দুশো বছরের ব্রিটিশদের শাসনামল প্রতিষ্ঠিত হলো তার জন্য কি শুধু মীরজাফর দায়ী ছিল ? একজন মাত্র ব্যক্তি কি একটি সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিতে পারে ? আমরা একবিংশ শতাব্দিতে বাস করেও সত্য ইতিহাস জানতে পারলাম না । নন্দকুমারের নেতৃত্বে একদল দেশীয় হিন্দুরাজা ও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজন এমনভাবে মিথ্যা কল্প কাহিনী ছড়াল যে সমস্ত দোষ গিয়ে পড়ল মীরজাফরের উপর আর মীরজাফর জাতীয় বেঈমান হিসেবে সবার কাছে ধরা পড়লেন ।

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে মুসলিম সম্রাটদের ফ্যাসাদ ছিল কিন্তু বানিজ্য শুল্ক নিয়ে । ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সব রকমের বানিজ্য শুল্ক মওকুফ করে দিয়েছিলেন কিন্তু সম্রাট শাজাহান । এই বানিজ্য শুল্ক রহিত এই ধারার সূত্রপাত হয়েছিল কিন্তু তৎকালীন রাজধানী দক্ষিন ভারতের বোরহানপুরে সম্রাট শাজাহানের দরবারে । আর এই বোরহানপুরই হলো মুসলমান সাম্রাজ্য পতনের উৎসস্হল । অনেক ঘটনার পর ১৬১৬ খৃষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের এক ফরমান বলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুরাট বন্দরে গোলা বারুদের কারখানা স্হাপন করে । এর বার বছর পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয় এবং শাজাহান পিতৃ সিংহাসনে আসীন হন । এর পাঁচ বছর পর সম্রাট শাজাহান সপরিববারে রাজধধানী বোরহানপুরে আগমন করেন । বোরহানপুর ছিল প্রাকৃৃতিকভাবেই খুব সুন্দর । আর এখানেই অন্কুরিত হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্হাপনের ইতিহাস – সেটি ছিল ১৬৩৩ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের এক সন্ধ্যায় । আকাশে চাঁদ ছিল কিন্তু গরম ছিল অনেক । হাঁপিয়ে উঠেছিল শাহাজাদি জাহানারা । মনের উদভ্রান্ততা দূর করার জন্য জাহানারা হেরেমের বারান্দা থেকে বেরিয়ে এসে প্রবেশ করে বাবুর্চিখানায় । বাবুর্চিদের কাজ বন্ধ হয়ে যায় । জাহানারা বাবুর্চিদের হাত থেকে লাকড়ী কেড়ে নেয়ে মুরগীর গোস্ত ভুনতে শুরু করেন । বাবুর্চিরা চলে যায় , মশালের আলো জ্বলছে । সবার দৃষ্টি জাহানার দিকে, চুলার আগুন যে বাইরের দিকে বেরিয়ে এসেছিল সে দিকে কারও খেয়াল নেই । বৈরী আগুন শাহাজাদীর কাপড়ে লেগে যায় । সবাই হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং শাহাজাদী আতন্কে নিজ কামরায় প্রবেশ করে । এই দৃশ্য দেখে জাহানারার ধাত্রী সৌতি বেগম দৌড়িয়ে গিয়ে সুরাহির পানির ঝাপটায় আগুন নিভিয়ে ফেলে দ্রুত দরা বন্ধকরে দেন । দগ্ধ বস্ত্র অপসারন করে শরীর আচ্ছাদন করে দেন ।

এই ঘটনা দ্রুত শাহী মহলে ছড়িয়ে পড়ে এবং সংবাদ পেয়ে পিতা শাজাহান যথাস্হানে উপস্হিত হয়ে মা হারা কন্যার অবস্হা প্রত্যক্ষ করে বিচলিত হয়ে পড়েন । খবর পেয়ে শাহী হেকিম যে দাওয়াই দেন তা কয়েকদিন ব্যবহার করেও ফল না পেয়ে শাহাজাদীর দুঃসহ যন্ত্রনায় পিতা শাজাহান আরও বিচলিত হয়ে পড়েন । এমতাবস্হায় উজীর আসাদ খাঁ বিনয়ী কন্ঠে বাদশাহকে অনুরোধ করেন সুরাট বন্দর থেে বিদেশী হেকিম আনার জন্য । বিদেশী হেকিম আনার জন্য বাদশাহ হুকুম জারি করলেন এবং দূত পাঠালেন সুাট বন্দরে বিদেশী হেকিম নিয়ে আসার জন্য । এ সময় হোপওয়েল বানিজ্য জাহাজ সুরাট বন্দরেই ছিল । ১৬৩৪ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই জাহাজে ছিলেন ডাক্তার গেব্রিয়েল বাউটন । এই গেব্রিয়েল বাউটনই জাহানারার চিকিৎসা করতে থাকেন । রোগ মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত শাহী মেহমান খানায় ডাক্তার গেব্রিয়েল বাউটনকে থাকার জন্য সম্রাট শাজাহান নির্দেশ দেন । তিন সপ্তাহ চিকিৎসা করার পর  জাহানারা সুস্হ হয়ে উঠেন । মা হারা কন্যা সুস্হ হয়ে উঠায় পিতা শাজাহান আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেন এবং বিদেশী ডাক্তারের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে হেকিমকে ইনাম দেবার জন্য সকাল দশটায় ডাক্তার গেব্রিয়েল বাউটনকে দরবারে আসার আহবান জানান ।

গেব্রিয়েল বাউটন দোভাষীর সাহায্য নিয়ে সম্রাট শাজাহানের কাছে পুরস্কার নয় এক বিশেষ ধরনের আব্দার করলেন । যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল । তার  আব্দারে সভাষদ ও শাজাহান চমকে উঠেছিলেন । ডাক্তার নিজের জন্য না চেয়ে ইংরেজ জাতি যাতে বিনা মাাশুলে বাংলায় ব্যবসা করতে পারে তার জন্য লিখিত অনুমতি চাইলেন আর সামান্য এক খন্ড ভূমিও চাইলেন যাতে একটি কুঠি বানিয়ে ইংরেজ জাতি কোম্পানি গঠন করে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারে । অঙ্গীকারাবদ্ধ সম্রাট শাজাহান ১৬৩৪ খৃষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারীতে বাংলায় বিনা মাশুলে ব্যবসা করার অনুমতি দেন কিন্তু কুঠি বানানোর জন্য ভূমি দেননি । ফরমানে উল্লেখ ছিল বাংলার পাশে পিপুলাই বন্দরে কুঠি বানানো যাবে তবে সুবে বাংলার সুবেদারের ইজাজাৎ মোতাবেক । এ সময় বাংলার সুবেদার ছিলেন আজিম খাঁ । আজিম খাঁ সম্রাট শাজাহানের বিয়াই ছিলেন ।

ডাঃ বাউটন কুঠি  তৈরীর বিষয় নিয়ে ঢাকায় আগমন করেন সুবেদার আজিম খাঁর দরবারে । কিন্তু আজিম খাঁ জলদস্যু দমনে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে তিনি বাউটনকে সময় দিতে পারছিলেন না। বাউটনকে মেহমান খানায় অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল কিন্তু ডাঃ বাউটনের পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না ।  ফিরে গিয়েছিলেন সুরাটে তার কর্মস্হলে । ১৬৩৯ খৃষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন শাহজাদা সাসুজা । সাসুজা সুুবেদার নিযুক্ত হয়েই ঢাকায় আগমন করে কয়েকদিন অবস্হান করে বুড়িগঙ্গা নদীর জোয়ার ভাটা দেখেন । কিন্তু এ অঞ্চলের আবহাওয়া ও অধিবাসীদের আচার আচরণে সন্দেহ হওয়ায় তিনি রাজমহলে রাজধানী স্হানান্তর করেন । ১৬৪০ খৃষ্টাব্দে ভাগীরথি গঙ্গা বেয়ে বাউটন ভাগলপুর জেলার রাজমহলে উপস্হিত হন । এই সময়ে প্রধান বেগম পিয়ারা বানু অসুস্হ হয়ে পড়ে এবং বাউটনের চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করেন । এর ফলে সাসুজা দারুন আনন্দিত হন । আর এই সুযোগেই ডাঃ বাউটন তার সুপ্ত মনোবাসনা পূরণ করতে সক্ষম হন । সাসুজা বাউটনকে পিপুলাই বন্দরে কুঠি তৈরীর অনুমতি দিয়েই থেমে থাকেননি । বাউটনকে হুগলির চন্দন নগরের দক্ষিনে ভাগীরথি গঙ্গার তীরে ভদ্রেশ্বর লাগোয়া আর একটি কুঠি তৈরী সহ বারুদের কারখানা স্হাপনের অনুমতি দিয়ে ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন করেছিলেন । ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রণ শক্তির সূচনা হয় এখান থেকেই ।