সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র ‘হরিজন’ আসছে

জে জিয়া
Published : 13 July 2012, 12:07 PM
Updated : 13 July 2012, 12:07 PM

'হরিজন' একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রটি ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে সরকারি অনুদান পায়। বর্তমানে এর শুটিং ও এডিটিং-এর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। জীবন-নির্ভর এ চলচ্চিত্রটিতে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের হরিজন সম্প্রদায়ের জানা-অজানা ঘটনাবলী। তাদের জীবনের না দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না ছড়িয়ে আছে এই চলচ্চিত্রের পরতে পরতে। হরিজন সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রাকে তুলে ধরতে গিয়ে লেখক-নির্মাতা মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন গল্প সাজিয়েছেন এ ভাবেÑ দরিদ্র মঙ্গল হরিজন মিউনিসিপ্যালিটির একটি চাকরির জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তার স্ত্রী ভাগ্যলক্ষ্মী একটি বাজার ঝাড়– দিয়ে যা রোজগার করে তাতেই কোনো মতো সংসার চলে। তাদের কিশোরী মেয়ে রাণীকে পনের টাকা দিতে পারে না বলে স্বামী তাকে তাড়িয়ে দেয়। রাণী গর্ভবতী হয়। তার যখন প্রসবের সময় হয় তখন চলছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঝড় বৃষ্টি চলতে থাকে। সেই দুর্যোগ মাথায় নিয়ে মঙ্গল ডাক্তারের কাছে যায়। হরিজন পল্লীতে ডাক্তার আসে না। অবশেষে দেখতে হয় রাণীর করুণ মৃত্যু। মঙ্গলের সংসার জীবন আরোজড়াজীর্ণ হয়ে ওঠে। মঙ্গল যেন সমস্ত ব্যথাতুর হরিজন সমাজের প্রতিনিধি। তার জীবন-যাত্রা ভেদ করে হরিজন সমাজের বেদনার প্রকাশ ঘটে।

অন্য একটি গল্প বেড়ে ওঠে হরিজন পল্লীর আর একটি সংসার নিয়ে। তা হলো রবিডোমের সংসার। রবিডোম শহরের মর্গে লাশ কাটার চাকরি করে। সে রাতে নেশা করে লাশের সাথে কথা বলে। রবির একমাত্র মেয়ে রূপাকে সে ডাক্তার বানাবে বলে মর্গে পড়ে থাকা লাশের কাছে তার আকাক্সার কথা প্রকাশ করে। রূপা কলেজে যায়। তার বোধের বিকাশ ঘটে। সে তার পিতার আকাঙ্খা পূরনের জন্য এগুতে থাকে। কিন্তু বাধ সাজে তার নিজের চেতনা। তার বোধে বিধৃত হয় সে ডোমের মেয়ে বলে তার সাথে কারো বন্ধুতা হয় না। রূপা কোনো সহপাঠিকে একটা চকলেট দিলে সেটা অবজ্ঞায় পড়ে থাকতে দেখে। রূপা কল্পনায় তার জীবনসঙ্গীর সন্ধান পেতে চায়। সে ঘর বাঁধতে চায় অভিজাত সংসারের কারো সাথে। এমন সময় লম্পট কৈলাশের কু-নজরে পড়ে যায় রূপা। একসময় রূপা তার দ্বারা ধর্ষিত হয়। যা সমাজ সংসারের মানুষেরা জানে না। রূপা সেই যন্ত্রণা নিয়েই অবশেষে হরিজন পল্লীর একজন বয়স্ক যুবক হরির সংসারে চলে যায়। সে অন্তর দহনে দগ্ধ হয়। তার স্বপ্ন ভেঙে যায়। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে একসময় রূপার গতি থেমে যায়।

অন্য দিকে সংসার বিচ্ছিন্ন মেওয়া লাল তুলে ধরে আর একটি গোপন কাহিনী। সেই ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দশজন হরিজন শহীদ হলেন। মেওয়া সহ অন্য যারা জীবিত আছেন তারাও পাননি তাদের সম্মান এবং স্বীকৃতি। জীবন বিছিন্ন মেওয়া হৃদয়ের গহীনে গোপন দুঃখ নিয়ে তিলে তিলে নিজেকে বিসর্জন দেয়।

হরিজন চলচ্চিত্রে আছে কৈলাশের মত চরা সুদের ব্যবসায়ী মহাজন। আছে সুলেখার মত বারাঙ্গনা। মায়াবতী খেয়ালী। আছে চন্দ্রলাল, রঘু, ভুঁইমালি, দেবকির মত বহুমাত্রিক চরিত্র। আছে মিঠাইলালের মত হৃদয়স্পর্শী শিশু চরিত্র। সংবেদনশীল একজন সাংবাদিক চরিত্রও দর্শককে আকুল করবে। সবকিছু মিলিয়ে হরিজন সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার গভীরের কথা বলবার প্রয়াস পেয়েছে হরিজন চলচ্চিত্রে। এই চলচ্চিত্রের মাঝ দিয়ে মানব-সমাজের সুবিধা বঞ্চিত হরিজন সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটি চিত্র খুঁজে পাবে চলচ্চিত্র দর্শক।

দৃশ্য ধারণের েেত্রও নির্মাতা বাস্তবতার স্বার রাখেন। তিনি চলচ্চিটির বহু গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য ধারণ করেন ঢাকা ও টাঙ্গাইলের হরিজন পল্লীতে। হরি ও রূপা চরিত্রের বাস্তব প্রোপট চিত্রায়নের জন্য তিনশত শুয়োরের একটি পালে ঢুকে যেতে হয় পারফর্মারদের। যা ছিল ঝোঁকিপূর্ণ ও রোমহর্ষক। আকর্ষণীয় একটি দৃশ্যে রয়েছে দুটো পূর্ণ-বয়স্ক শুয়োরের লড়াই। যা ধারণ করাও ছিল একটি দুর্লোভ ঘটনা।

হরিজন চলচ্চিত্রে পারফরমেন্স করেন শতাধিক হরিজন নারী-পুরুষ। হরিজন সংগঠন 'বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদ' এবং হরিজন নারী-পুরুষ এই চলচ্চিত্র নির্মাণে লোকেশন নির্বাচন, কস্টিউম ব্যবহার এবং যথার্থ শুটিং উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন।

শ্রেষ্ঠাংশে রয়েছেন : রোকেয়া প্রাচী, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, নবাগতা নির্জনা, আব্দুর রহমান কিনা, শাহিদ খান, মাহমুদ সাজ্জাদ, ইকবাল বাবু, আর্জুমান্দ আরা বকুল, মির্জা আফরিন, শুভরাজ ও মামুনুর রশীদ। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন মুনা আক্তার, পুলক হায়দার, রেজাউল রাজু, মিতুল, সুমন হরিজন, প্রেম বাবু, রোকেয়া, ছন্দা, আনিস, আবদুস ছাত্তার, সুমন, সুচিতা, স্বপন দাশ, এম এ হামিদ প্রমুখ। এবং শিশু মিঠাই লালের চরিত্র রূপায়ন করে সৃষ্টি মির্জা।

গান : হরিজন চলচ্চিত্রে সংযোজিত হয়েছে বহুমাত্রিক ছ'টি গান। মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেনের কথায় তিনটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা, মমতাজ, ডুয়েট গেয়েছেন এন্ডু কিশোর ও কনক চাঁপা। গান তিনটির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেন ঝংকার। এবং সাইফুল ইসলামের কথায় একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন বাঁধন। গানটির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেন শেখ মিলন। হরিজন চলচ্চিত্রটি এ বছরেই মুক্তির লক্ষ্যে কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।