কোরবানির অর্থনীতি ও কিছু ‍দিক বিচার

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 13 April 2011, 07:30 PM
Updated : 16 Oct 2013, 10:17 AM

ঈদের আগের রাতে রাজধানীর ফাঁকা রাস্তা দিয়ে রিকশায় ফিরতে ফিরতে দেখা গেল, লোকজন সদ্য কেনা গরুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে, কেউ কেউ প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে যাচ্ছে। সস্তায় গরু কিনেছেন তাদের অনেকে। দাম শুনে রাস্তার লোক বলাবলি করছে, 'গতকালের (অর্থাৎ সোমবারের) চেয়ে দাম অনেক কম'।

কোরবানির পশুর দাম বা ওজন নিয়ে নাকি কথা বলতে নেই। তবু লোকে বলে। কেউ তো আর ইচ্ছা করে ঠকতে চায় না। দক্ষ ক্রেতার ওপর তাই ভার দেওয়া হয় গরু-ছাগল কেনার। তারা দিনক্ষণ বুঝে হাটে যান। এ হাট থেকে সে হাটে ঘোরেন। 'হাসিল' এড়াতে এদের কেউ কেউ পথের পাশ থেকেও কিনে ফেলেন কাঙ্ক্ষিত পশুটি।

সোমবার ছিল ঈদের আনুষ্ঠানিক ছুটির শুরু, যদিও সেটি আসলে ছিল বিজয়া দশমীর ছুটি। চাকরিজীবীরা এদিন বাজারে গেছেন দল বেঁধে। অর্থশাস্ত্রে এটাকে বলে 'ডিমান্ড সাইড' শক্তিশালী হওয়া। এর প্রায় অনিবার্য পরিণতিতে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কোরবানির পশুর হাটেও এটি ঘটেছে এবার।

এর আগের দিন পর্যন্ত বেপারিরা নাকি অনেক ক্ষেত্রে কেনা দাম বা এমনকি লোকসানে গরু বেচে দিয়েছেন। ক্রেতারা 'ফেসটিভ মুডে' একযোগে হামলে পড়ার দিন সোমবারে এর কিছুটা উসুল নিতে সচেষ্ট হবেন তারা, এটাই স্বাভাবিক। অনেকে বলছেন, ওইদিন 'সিন্ডিকেটবাজি' হয়েছে গরুর বাজারে।

সিন্ডিকেটবাজির কথা আমরা অনেক ক্ষেত্রেই তুলছি, কিন্তু প্রমাণ দিতে পারছি না। বহু বিক্রেতা যে বাজারে একসঙ্গে পণ্য নিয়ে আসেন, সেখানে মোবাইল ফোনের এ যুগেও সিন্ডিকেটবাজি কিন্তু কঠিন। মার্কেট ফোর্স বা বাজারশক্তি বলে একটা ব্যাপার তো রয়েছে।

মহাসড়কে যানজটও সত্য। এসব অস্বীকার করা যায় না। যায় না বলে ঠিক এর পরদিনই, মঙ্গলবারে রাজধানী ও এদিককার হাটে ছিল গরুর ব্যাপক সরবরাহ। গরু যারা কিনে এনেছেন, তাদের তো শেষদিনের বাজারটা ধরতে হবে। দামও কমে এসেছে এতে।

যারা ঈদের আগের দিন দুপুরের পর হাটে গেছেন, তারা মোটামুটি জিতেছেন। তবে শর্ত আছে– তাদের হতে হবে দক্ষ ক্রেতা। দক্ষ ক্রেতা হয়েও সোমবার অনেকে 'বেশি দামে' গরু কিনতে বাধ্য হয়েছেন। তারা কিন্তু ভালো দাম দিয়েছেন নানা স্থান থেকে গরু নিয়ে আসা বেপারিদের।

এক ব্যাচ জুনিয়র ঢাবির অর্থনীতির এক ছাত্রকে জানি। সোমবার বেশি দামে গরু কেনার দলে রয়েছেন তিনি। বললেন, 'আয়ের পুনর্বণ্টনের যে ধারণা রয়েছে, তার কিছুটা প্রয়োগ ঘটিয়েছি আমি'! তিনি মনে করেন, গত কোরবানি ঈদে অনেকে লোকসান দেওয়ার পর এবার বেপারিরা মুনাফা করতে পারলেই ভালো হত। 'মধ্যস্বত্বভোগী' বলে তিনি এদের গাল দেওয়ার বিরুদ্ধে।

সত্যিই তো, কৃষক বা খামারিদের কাছ থেকে শহরে-বন্দরে গরু নিয়ে আসা এ বেপারিরা না থাকলে কী হত? এত গরু-ছাগল কোরবানি দিতাম কীভাবে? কীভাবেই বা বছরের পর বছর সংগৃহীত হত এত পশুর চামড়া? সারা বছরের চামড়া সংগ্রহের একটা বড় অংশই আমরা পাই কোরবানি ঈদের সময়টায়।

চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও রফতানিতে আমরা কিন্তু ভালো করছি। যে পরিমাণ চামড়া সংগৃহীত হচ্ছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যবহারও করতে পারছি না। সেগুলো হচ্ছে রফতানি। রফতানি না করে তা দিয়ে আরও বেশি চামড়াজাত পণ্য বানাতে পারলে সেটি বড় ঘটনা হয়ে উঠবে অর্থনীতিতে। কর্মসংস্থান ও আয় বাড়বে এ খাতে।

কে না জানে, প্রতিবেশি দেশ বিশেষত ভারত থেকে কোরবানির হাটে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গরু ওঠে। অনেকে ভুল করে বলি, এগুলো আমদানি হয়! প্রকৃতপক্ষে ভারতে রফতানি নিষিদ্ধ এ পণ্যটি চোরাপথে আসে এখানে। সীমান্তের এপারে একটি অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় বৈধ করে এগুলো পাঠানো হয় দেশের ভেতরে।

চরম ভারতবিরোধী লোকজনও এর বিরোধিতা করে না। তারা ভালো করে জানে, কোরবানির হাটে ভারতীয় গরু ঠিকমতো না উঠলে এর দাম যাবে বেড়ে। দেশে উৎপাদিত ছাগলের দামেও পড়বে এর প্রভাব। তারা জানে, প্রতিদিন মাংসের চাহিদাও অনেকখানি পূরণ হচ্ছে সীমান্তপথে আসা গরুর কারণে।

গোমাংসের দাম মোটামুটি স্থিতিশীলও রয়েছে এজন্য। দেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন পরিস্থিতিও ঠিকঠাক রয়েছে প্রতিবেশি দেশের গরু আসছে বলে। হুণ্ডিতে বা স্বর্ণে যেভাবেই পরিশোধ করা হোক, এজন্য আমরা ভালো দাম দিচ্ছি তাদের। এ ক্ষেত্রেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। সীমান্তে তারাই মূলত গুলি খেয়ে মরছে বিএসএফের। এ বড় নিষ্ঠুর সত্য।

দেশের ভেতরও কোরবানির হাটে তোলার জন্য গরু তৈরি করাটা বেড়েছে। কসাইকে সরবরাহের জন্যও গরু মোটাতাজাকরণ চলছে দেশে। এ কাজে নিয়োজিতদের বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে ওঠে নানা অভিযোগ। এর সত্যাসত্য নির্ণীত হয় না অনেক সময়।

খাদ্যপণ্য তৈরি ও সরবরাহে গোলমাল করতে আমরা যেন অভ্যস্ত হয়ে না পড়ি, সেটি নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। ব্যবসায়ী, বিশেষত তাদের সমিতিরও দায়িত্ব রয়েছে। সেটি মূলত নৈতিক। সরকারের দায়িত্বটা আইনি। তারা ব্যবসা করবেন না, ব্যবসা ঠিকমতো পরিচালিত হওয়াটা নিশ্চিত করবেন।

যেসব কারণে আমরা তাদের ভোট দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাই, এটি হল তার একটি। সরকারের কাজ বিভিন্ন রকম মাংসের দাম বেঁধে দেওয়া নয়, এর দাম যেন সহনীয় থাকে, সেটি নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে সরকার নিশ্চয়ই পারে ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশেই গরু-মহিষ উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলে আমাদের একটি দফতর রয়েছে। এটিকে লোকে আজকাল আর ছোট করে দেখে না। এক সময় দেখত, গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারত না বলে। একটি বিজনেস ডেইলি মাঝে খবর দিয়েছিল, চাষের মাছ উৎপাদনে আমরা নাকি নাম করেছি বিশ্বে। তারপরও সত্য যে, ভারত ও মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণ মাছ আনি আমরা। বিধিবদ্ধ উপায়েই তা আমদানি হয়ে থাকে।

এভাবে গরু আমদানি করা গেলে এর দাম বেশি না কম পড়ত, সেটি সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবেন। মিডিয়ায়ও এ নিয়ে কথা হয় কম। কিন্তু সত্যটা স্বীকার করে নিয়ে আমাদের কি উচিত নয় গরু-মহিষের উৎপাদন বাড়ানো?

গৃহায়ণ ও শিল্পায়নের চাপে গোচারণভূমি কমে এসেছে আমাদের। কৃষিজমিই তো কমে আসছে দ্রুত। এ অবস্থায় অগত্যা খামারে গরু-মহিষ উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে হবে। উন্নত জাত চাই এবং হ্যাঁ, মহিষের উৎপাদন বৃদ্ধিও প্রয়োজন। কোরবানির পশুর হাটে না থাকলেও কসাইয়ের কাছে এর কদর রয়েছে। কসাইকে আমরা দোষ দিতাম না, যদি তারা গরু-মহিষ আলাদা করে বেচতেন। এ ক্ষেত্রেও সরকার, বিশেষত স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা দেখতে চাইব।

গরু-মহিষের মাংস আলাদা বিক্রির ব্যবস্থা করা গেলে মহিষও মর্যাদা পাবে। মহিষের জাত উন্নয়নে প্রচেষ্টা গ্রহণের একটি খবর মাঝে দেখতে পেয়েছিলাম। ভালো জাতের ছাগল উৎপাদন বৃদ্ধিতেও মনোযোগ চাই। মহিষ ও ছাগলের দুধ আলাদাভাবে বিক্রির উদ্যোগও নিতে হবে। এগুলোর মাংস ও দুধ কি পুষ্টিহীন, নাকি খাওয়ার অযোগ্য? এ লক্ষ্যে প্রচারণাও কিন্তু পরিলক্ষিত হয় না। তাতে কে কীসের মাংস আর দুধ খাচ্ছেন, ঠিকমতো জানতে পারছেন না সেটা।

কাবাব নাকি ভালো হয় মহিষের মাংস দিয়ে। দামে কিছুটা সস্তা বলেও কাবাবে বা রেস্তোরাঁয় এর ব্যবহার বেশি। এত যে মিষ্টি উৎপাদন বেড়েছে দেশে আর তাতে বেড়েছে ছানার ব্যবহার, সে ক্ষেত্রে মহিষের দুধ কি ব্যবহৃত হচ্ছে না? এতে দোষের কিছু নেই। দোষ রয়েছে স্বচ্ছতা না থাকাটায়।

স্বচ্ছভাবে আমরা একটা নীতি গ্রহণ করতে পারি যে, আগামী চার-পাঁচ বছরে অন্তত কোরবানির হাটের সিংহভাগ গরু যেন দেশেই উৎপাদন করতে পারি। প্রতিবেশি দেশ থেকে ছোট গরু আসার পর এখানে ব্যাপকভাবে মোটাতাজাকরণ হলেও কর্মসংস্থানের দিক থেকে সেটি অর্থবহ হবে।

আমাদের নীতিনির্ধারকরা প্রায়ই বলেন, গ্রামের লোক যেন শহরে এসে ভিড় না করে, তা নিশ্চিত করতে গ্রামেই এদের সুখ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এ কথাটা বেশি করে বলেন। বিএনপিও মনে হয় না এ বিষয়ে আপত্তি করবে।

কৃষিতে স্বনির্ভরতা অর্জনে আওয়ামী লীগ সরকার যে পথ দেখিয়েছিল, পরবর্তী মেয়াদে বিএনপি কিন্তু তা অনুসরণ করেছে। প্রাণিসম্পদ উন্নয়নেও একে অপরকে অনুসরণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার বদল হলেও আমরা দেখতে চাইতে পারি 'নীতির ধারাবাহিকতা'।

কোরবানির হাটে তোলার জন্য গরুর লালন-পালন বাড়ুক দেশে। নীতিগত সহায়তা জুগিয়ে এ ক্ষেত্রে ব্যয় কমানোর ব্যবস্থা করা হোক। নইলে প্রতিবেশি দেশ থেকে গোসম্পদ 'আমদানি'র প্রবণতা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সেটি কমবে না। ওই কাজে বিনিয়োগ বরং বাড়বে।

মানুষ ও আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে পশু কোরবানি কী হারে বাড়ছে, সেটি তো খালি চোখেই দেখা যায়। এ সময়ে শহর-বন্দরে গরু-ছাগল প্রসেস করার লোকের চাহিদাও বেড়ে উঠছে দ্রুত। নিজের হাতে এসব কাজ সেরে ফেলার প্রবণতা কমছে বৈকি।

সেটি এক দিক থেকে ভালোই। কসাইসহ একশ্রেণির লোক মাংস কাটাকাটিতে নিয়োজিত হয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করছে। অবস্থা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, ঈদের পরদিনও তাদের অনেকের ডাক পড়ে। দক্ষতার উন্নয়ন প্রয়োজন এদেরও। তাহলে আমরা আরও বেশি হারে ত্রুটিমুক্তভাবে খসানো চামড়া পাব।

এ অঞ্চলের গরুর চামড়ার মান ভালো। গোসম্পদ উন্নয়নে এদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। পর্যাপ্ত মাংস ও মানসম্মত চামড়া দুটোই চাই আমরা। যেসব দেশ ভালো মানের চামড়াজাত পণ্য তৈরি করে, তারাও চামড়া নিচ্ছে আমাদের দেশ থেকে।

গরুর মাংস পেলেও চামড়া অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে ধরে রাখতে পারি না আমরা, বিশেষত কোরবানির সময়ে। এ ক্ষেত্রেও ভালো ব্যবস্থাপনা থাকা চাই সরকারের। সীমান্তবর্তী প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সতর্কতাও এ সময়ে জরুরি। গরুর দাম কমে গেলে, বেশি কোরবানি হলে চামড়ার দাম অনেক সময় কিন্তু পড়ে যায়।

ট্যানারিগুলো চাইবেই কম দামে গরু-ছাগলের চামড়া পেতে। স্থানীয় পর্যায়ে চামড়া সংগ্রহকারী ও পরবর্তী ক্রেতাদেরও মুনাফা হওয়া চাই। নইলে গরুর বেপারির মতোই ব্যবসায় তারা উৎসাহ হারাবেন।

গেল বার কম দামে গরু বেচতে বাধ্য হয়েও এবার রাজধানীসহ বড় বড় শহরে কম পশু তোলেননি তারা। ঈদের দিনও তাদের একাংশ গরু-ছাগল বিক্রি করবেন। কতটা ভালো দাম পাবেন তারা, সেটি নির্ভর করছে চাহিদার ওপর। এজন্য কত টাকা খাটিয়েছেন, তার ওপর নয়।

গরুর বেপারিরা কি ভেবেছিলেন সামনেই জাতীয় নির্বাচন বলে বেশি বেশি বেচাবিক্রি হবে এবার? নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা ও উত্তেজনার খবর তাদের অজানা থাকার কথা নয়। তাহলে কি উৎসাহিত হয়েছিলেন বেশি রেমিট্যান্স আসার খবরে?

দেশেও আয় বেড়েছে মানুষের। একসময় ভাগে কোরবানি দিতেন, এমন অনেকে এখন আস্ত গরু দিচ্ছেন। গরিবের মাঝে মাংস বিলিবণ্টনও বেড়েছে। এর একাংশ কম দামে চলে যাবে রেস্তোরাঁয়।

এ সব কিছু মিলিয়ে কোরবানি ঈদে আয়ের পুনর্বণ্টন কতটা হল, সেদিকেই দৃষ্টি রাখতে হবে। চামড়ার দামের দিকেও দৃষ্টি রাখা দরকার এজন্য যে, এ থেকে অর্জিত টাকাটা পেয়ে আসছে সমাজের বঞ্চিতরা। এদের সংখ্যা কমাতে অবশ্য কার্যকর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই করতে হবে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গার্মেন্টসের মতো রফতানিমুখী চামড়াজাত পণ্য (যেমন, পাদুকা) উৎপাদন বাড়ানোর নাকি বিরাট সুযোগ রয়েছে আমাদের। গরু-মহিষ পালন বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি এদিকেও যেন থাকে সজাগ দৃষ্টি।