মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 6 May 2015, 08:50 AM
Updated : 6 May 2015, 08:50 AM

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান মহোদয় কয়েক দিন আগে বলেছেন, "সকল নারীর কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।" তাঁর এ ক্ষমাপ্রার্থনার প্রধান কারণ ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মেয়েদের উপর নগ্ন হামলা। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কী হিংস্রতা, হীনমন্যতা ও নগ্নতা আমাদের মনের গহীনে বাসা বেঁধেছে; কী ঘৃণ্য মানসিকতা আমাদের পেয়ে বসেছে ভাবতেও বিস্ময়বোধ করি। এ ঘটনায় পদদলিত হয়েছে আমাদের দীর্ঘদিনের সভ্যতা; লাঞ্ছিত হয়েছে মানবিকতা। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো জরুরি।

এমন তো হবার কথা নয়। এ দেশ ও জাতি চিরকাল মায়ের চরণতলে সন্তানের বেহেস্ত ভেবে জীবন পরিচালিত করেছে। 'ও মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি' বলে যারা গান ধরেছে, সেই জনপদের সন্তানেরা মেয়েদের এমন অমর্যাদা করবে ভাবতেও লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে।

আমরা মেয়েদেরকে সম্মান করি বলেই ১৯৯২ থেকে ২০১৫ অবধি (দুবছর বাদে) বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর আসন অলংকৃত করে আছেন নারীরা। মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে দ্রতগতিতে। নারীদের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭১.৮ বছর, পুরুষদের চেয়ে যা বেশি। কন্যাশিশুদের শিক্ষাঙ্গনে ভর্তির হার ৭৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। গ্লোবাল জেন্ডার ইনডেক্স, ২০১৪ অনুসারে লিঙ্গবৈষম্য নিরসনে ভারত, পাকিস্তান, নেপালের চেয়ে অনেক উর্ধ্বে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, 'রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।'

'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১' প্রণীত হয়েছে। অনুমোদিত হয়েছে, 'নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন, ২০০০', 'মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলপত্র, ২০০১' এবং 'পারিবারিক নির্যাতন (প্রতিরোধ ও সংরক্ষণ) আইন, ২০১০'। নারী ও শিশু বিষয়ক পৃথক মন্ত্রণালয় হয়েছে যারা 'বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন' বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে আমাদের অহঙ্কার। বর্তমানে জীবন ও রাষ্ট্রের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নারীর পদচারণায় মুখর হয়নি। সত্যি কথা বলতে কী, দেশের বাস্তবতা হচ্ছে, কন্যাসন্তানের জন্ম হলে পরিবারের সদস্যদের মুখ কালো হয় না। মাছের মুড়োটা বর্তমানে কন্যাসন্তানের পাতেও পড়ে, শুধু পুত্রসন্তানের জন্য তা নির্ধারিত নয়।

মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন হচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ। পথ চলতে গিয়ে কোনো নারী পিছনে পড়ে গেলে সভ্যতা হচ্ছে তাকে সামনেে এগিয়ে দেওয়া। যানবাহনে পুরুষদের দাঁড়িয়ে মেয়েদের বসার জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে আমাদের ভব্যতার অঙ্গ, যা একদিনে আসেনি। আমাদের সাহিত্যে, গল্প, উপন্যাস, নাটকে এবং লোকগীতি ও যাত্রামঞ্চে এমন শিক্ষাই বিকশিত হয়েছে। মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শন হচ্ছে আমাদের জাতীয় চরিত্রের অঙ্গ। যদি কোনো মা, বোন বা কন্যা অপমানিত হয়, সমাজ তার প্রতিকার করে, বয়োজ্যেষ্ঠরা শাসন করে প্রকাশ্যে। কিন্তু এবার বৈশাখের সংঘবদ্ধ আক্রমণ এক বেদনার চিত্র– অকল্পনীয় ও অভাবনীয় এক দৃশ্যপট– যা আমাদের চিরায়িত শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন।

সাধারণভাবে মানুষ স্বভাব-চরিত্রে, বাক্যালাপে, আচরণে মায়ের দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়ে থাকে। মায়ের শাসন সন্তানরা স্নেহ হিসেবে গ্রহণ করে। মনের কথা মায়ের কাছে বলে অপকটে। প্রাচীন ঋষি চার্বাক মুনির মতে, মানুষ তার ত্বক, মাংস ও রক্ত পায় মায়ের কাছ থেকে এবং অস্থি, স্নায়ু ও মজ্জা পায় পিতার নিকট থেকে। সন্তানের প্রতি পিতার তুলনায় মায়েরা অধিক স্নেহশীল, মমতাময়ী ও যত্নবান হয়। কন্যাসন্তানেরা পিতার প্রতি এবং পুত্ররা মায়ের প্রতি অধিক অনুগত হয়ে থাকে। ছেলেমেয়েদের বিপদে-আপদে মায়ের মনই সবার আগে জানতে পারে, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে।

বিখ্যাত অভিনেত্রী সোফিয়া লোরেনের ভাষায়:

"A mother always has to think twice, once for herself and once for her child."

অন্যদিকে, অ্যারিস্টটল যেমন বলেছেন:

"Mothers are fonder than fathers of their children because they are more certain, they are their own."

আমাদের উৎকণ্ঠা হচ্ছে, কেন এমন দৃশ্য অবলোকন করতে হল বৈশাখের প্রথম দিনে? আনন্দ উৎসবের মহাসমারোহের মাঝে আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হল এমন হিংস্রতা, সভ্যতা পদদলিত করার নির্দশন যা আসলে জাতির অহঙ্কারে কলঙ্কলেপন। একসঙ্গে বিশ থেকে পঁচিশ জন পুরুষ মেয়েদের উপর নগ্ন আক্রমণ করল প্রকাশ্যে– যাদেরকে দেখলে শিক্ষিত বলে মনে হয়– এমন শিক্ষা ও অমানবিক মানসিকতার জন্ম হল কেন এবং কীভাবে? ইন্টারনেটে অবাধ পর্নোগ্রাফি কি এ জন্য দায়ী? অথবা শৈশব-কৈশোরের পারিবারিক শিক্ষায় দৈন্যতা বা শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতার অবক্ষয় অথবা ছাত্ররাজনীতিতে অতিরিক্ত ও বেপরোয়া সাহস ও অর্থবিত্তের সুযোগ কি অপরাধীদের মানবতা ভুলুণ্ঠিত করতে ইন্ধন যুগিয়েছে?

আজ যে ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, বাংলাদেশের ইতিহাসে এমনটি কোনোদিন হয়নি। এমন ভয়াবহ নৈতিকতার অবক্ষয়– আইনের প্রতি– সমাজ ও পরিবারের শাসনের প্রতি এ হচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন এবং শিক্ষাব্যবস্থার অবনতির নিদর্শন। শুধু আইন প্রয়োগ করে তাদের শাস্তি চাইলে চলবে না, দেখতে হবে কী কারণে এমন অবক্ষয় ঘটল। এমন আচরণের কারণ এবং উৎস নিয়ে গবেষণা চালাতে হবে নিবিড়ভাবে যেন এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। পুলিশি ব্যবস্থা হচ্ছে সাময়িক সংশোধনের উদ্যোগ বা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ। যুবসমাজের মানসিকতা পরিবর্তনের পথে এ প্রচেষ্টা দীর্ঘমেয়াদী কোনো প্রতিকার নয়। এ জন্য প্রয়োজন সমাজ সংস্কার।

নারী সংগঠনগুলোর জোরালো দাবি, 'নিরাপদ নগরী, নির্ভয় নারী' শুধুমাত্র শ্লোগান হিসেবে ভাবলে চলবে না; ভাবতে হবে এ হচ্ছে আমাদের সভ্যতা ধরে রাখার উদ্যোগ এবং তার বাস্তবায়ন হচ্ছে স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যে মায়ের হাত দোলনা দোলায়, যে বোন ভাইয়ের জন্যে প্রাণান্ত, যে কন্যা পিতার গলা জড়িয়ে ধরে, যে বধুয়া ভালোবাসায় সিক্ত করে হৃদয়মন– সে হবে লাঞ্ছিত– তাও জনারণ্যে– সভ্যসমাজ তাকিয়ে সে দৃশ্য দেখবে– প্রশাসন হবে নিরব দর্শক– এ হতে পারে না, এমনটি চলতে দেওয়া যায় না।

মেয়েদের অসম্মান সমাজের অবক্ষয়ের নিদর্শন। যে ছেলে প্রকাশ্যে নারীনির্যাতনকারী, সে তার গৃহেও হিংস্র এক দানবরূপে আর্বিভুত হতে পারে। এমন লেখাপড়া জানা ছেলেরা রাষ্ট্রের যে কোনো দায়িত্ব পেলে দুর্বৃত্তায়ন হবে তাদের চলার সাথী। তারা সমাজকে করবে কলুষিত, রাষ্ট্রের জন্য হবে বিপদজনক। তাই রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য এ হচ্ছে এক অশনি সংকেত। এমন পরিস্থিতির সুরাহা করতে হবে শুধু পুলিশি ব্যবস্থায় নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এবং সকলে একযোগে।

প্রতিবাদ হতে হবে প্রতি পরিবারে, শিক্ষাঙ্গনে, প্রতি ঘরে, প্রতি জনে। সংশোধনের কার্যক্রম শুরু করতে হবে এখনই। পাশাপাশি, দুর্বত্তদের শাস্তি প্রদানের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। হিংস্রতা যেন কিছুতেই প্রশ্রয় না পায়, অপরাধের পুনরাবৃত্তিতে সাহস না যোগায়।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব।