সীমানার ওপারে…

জাকির হোসেন রাজু
Published : 10 Jan 2018, 11:12 AM
Updated : 10 Jan 2018, 11:12 AM

বাংলাদেশের সীমানার বাইরে বাংলাদেশের ইউনিয়ন। হ্যাঁ, আমি তিনবিঘা করিডোর দিয়ে দহগ্রাম-অঙ্গরপোতা ছিটমহলে যাওয়ার কাহিনী শোনাবো। লালমনিরহাট জেলাধীন পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তবর্তী ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ছিটমহল দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা। আপনারা বলবেন, আরে ভাই, ছিটমহল সমস্যার তো সমাধান শেষ। তাহলে?

আসলে দহগ্রাম-অঙ্গরপোতা আসলে ছিটমহল সমস্যার বাইরের ব্যাপার। এটি একটি স্বতন্ত্র ভূমি যার ভিতর দিয়ে ভারতের এবং বাংলাদেশের আলাদা দুটি রাস্তা আছে। ইন্দিরা-মুজিব সীমান্ত চুক্তি ১৯৭৪ অনুযায়ী, তিনবিঘা করিডোর বাংলাদের চিরস্থায়ী ইজারা পায়, যার আয়তন ০.০১৫ বর্গকিলোমিটার এবং বিনিময়ে ভারতকে দেয় দক্ষিণ বেরুবাড়ী, যার আয়তন ৭.৩৯ বর্গকিলোমিটার। তাহলে কি দাঁড়ালো? তিনবিঘা করিডোর কার? কে তার মালিক? কে দেখভাল করে? বাংলাদেশ? কিন্তু না সবকিছুই করে ভারত, নামে শুধু আমরা ইজারা নিলাম। আমাদের বিজিবি থাকে বাইরে বেশ কিছুটা দূরে আর ভিতরে সব বিএসএফ, আর তাদের ব্যবহার যে খুব নিচু জাতের সেটা নিশ্চই বলে দিতে হবে না! পুরা তিনবিঘা করিডোর কাটাতারে ঘেরা, শুধু দুই বিপরীত দিকে বাংলাদেশ এবং ভারতের (গেট নেই) দুটি রাস্তার মুখ খোলা থাকে।

১৯৭৪ সালে চুক্তি অনুসারে, বাংলাদেশ সাথে সাথেই দক্ষিণ বেরুবাড়ী ভারতের কাছে হস্তান্তর করে। যদিও ভারত তিনবিঘা করিডোর বাংলাদেশের কাছে রাজনৈতিক কারণে হস্তান্তর করেনি। এটি হস্তান্তরে ভারতের সাংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের অনেক বিরোধিতার পর ২০১১ সালে ভারত পূর্ণভাবে এটি বাংলাদেশকে দেওয়ার বদলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ইজারা হিসাবে দিয়েছিল এই শর্তে যে, একই সময়ে দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। কাণ্ডটা দেখে মনে হয়, মামা বাড়ির আবদার!

২০১১ সালের পর থেকে এখন ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে, কিন্তু সেখানেও শর্ত প্রযোজ্য। আর সেটা হল, যেখানে ভারতের যানবাহন দিব্যি চলে যাচ্ছে কোন বাধা বিঘ্ন ছাড়াই, সেখানে আমাদের নেমে হেটে যাওয়া লাগে। যে জমি আপনি অতি উচ্চ মূল্যে ইজারা নিলেন সেই জমিতেই আপনার কোন কতৃত্ব নেই, নেই কোন অধিকার। আমি মনে করি এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমিকতা কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ করে যে, আসলেই কি আমরা ভারত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? যাইহোক, ২০১১ সালে তা-ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদক্ষেপে ২৪ ঘন্টা যাতায়াত এর সুফল তো ভোগ করছে অবহেলিত মানুষজন, যেখানে আগে ১ ঘন্টা পরপর করিডোর দিয়ে বাংলাদেশীদের যাতায়াতের সুযোগ দেয়া হত এবং ৯০ এর দশকের আগে তো যোগাযোগ করার সুযোগ ছিলনা বললেই চলে।

তিন বিঘা করিডোরে লেখক

এবার একটু চোখ ফেরাই অন্যদিকে। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল পাটগ্রাম উপজেলার একটি স্বতন্ত্র ইউনিয়ন 'দহগ্রাম ইউনিয়ন' হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ আগস্ট এখানে ইউনিয়ন পরিষদের শুভ উদ্বোধন ঘটে। কিন্তু এই দহগ্রামের প্রায় ২২,০০০ মানুষের জন্য মাত্র ১০ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল আছে। নেই কোন কলেজ, মাত্র চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় (জাতীয় তথ্য বাতায়ন)।

আমরা যখন দহগ্রাম অতিক্রম করছিলাম তখন অনুভব করতে পেরেছিলাম কত যুগ ধরে অবহেলার শিকার এই জনপদ। কত ভঙ্গুর তাদের জীবনব্যবস্থা! আশার কথা হল বর্তমান সরকার বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে এখানকার টেকসই উন্নয়নের জন্য। তবে ভারতের বিমাতা সুলভ আচরণ অগ্রহণীয় বলে আমি মনে করি।

সবশেষে বলতে চাই, আপনি যদি কখনো উত্তরবঙ্গে যান তাহলে দহগ্রাম আর তিনবিঘা করিডোর ঘুরে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আসুন। কিন্তু মনে রাখবেন, করিডোরের ভেতর অযথা দাঁড়ানো যাবেনা। কারণ বিএসএফ গুলো বেজায় পাজী!

তথ্যসূত্রঃ
১. জাতীয় তথ্য বাতায়ন http://dahagramup.lalmonirhat.gov.bd/site/page/60174366-18fd-11e7-9461-286ed488c766
২. উইকিপিডিয়া bn.m.wikipedia.org/wiki/তিনবিঘা_করিডোর

লেখক-

জাকির হোসেন রাজু

বিএসএস, এমএসএস (চলমান), সমাজকল্যাণ ও গবেষণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়