শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধে ও শিক্ষার উন্নয়নে ঘোষিত নীতিমালাই কি যথেষ্ট?

Pramanik Jalal Uddin
Published : 28 June 2012, 05:54 PM
Updated : 28 June 2012, 05:54 PM

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ঘোষিত নীতিমালায় যা বলা হয়েছে, তা শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধ ও শিক্ষার উন্নয়নে কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখবে, সেটা নিয়ে যে কারোর মনে যথেষ্ট সংশয় থাকতে পারে। কারণ ভাল শিক্ষার নামে বর্তমানকালে দেশে যে পরিমাণ শিক্ষা বাণিজ্য শুরু হয়েছে, তাতে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর এই পদক্ষেপ সাগরে গোষ্পদ তুল্য ও এটি একটি বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ মাত্র। রোগের অনেকগুলো উপসর্গের মধ্যে, কোন একটি বিশেষ উপসর্গকে নিরাময়ের উদ্দেশ্যে, ওষুধ খেলে যেমন রোগটি পুরোপুরি সারে না, তেমনি শিক্ষা বাণিজ্য নামক মহারোগের একটি উপসর্গকে দূরীভূত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিলেও, তাতে করে যে দেশ থেকে শিক্ষা বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ হবে এমনটি ভাবা সঙ্গত নয়।

একটি জাতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মূল্যায়নে শিক্ষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ভাল মানের শিক্ষা যেমন জাতির উন্নয়নে ভাল ভূমিকা রাখতে পারে তেমনি মানহীন, বিশৃঙ্খল ও বাণিজ্যিক শিক্ষায় জাতি পিছিয়ে পড়তে পারে এবং সুনাগরিক সৃষ্টিতে শিক্ষা ব্যর্থ হয়। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও শিক্ষা যে রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, সে বিষয়ে কারো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। আর প্রয়োজনীয় মান অর্জন করতে ব্যর্থ শিক্ষার দ্বারা রাষ্ট্র বা জাতির সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল করার চিন্তা করা অসম্ভব।

স্বাধীনতা উত্তর বাঙালী জাতির শিক্ষার ব্যবস্থায় কতকগুলো বিশৃঙ্খলা অনেকদিন থেকে চলে আসছিল, তাতে অন্যান্য সাংবিধানিক মৌলিক চাহিদার মত শিক্ষাও দিনে দিনে বাণিজ্যের বেসাতি পরিণত হয়েছে। শিক্ষা বাণিজ্য নামক রোগে হালে অনেক নতুন নতুন উপসর্গ যুক্ত হয়ে রোগটিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে। স্বাধীনতা উত্তর কালে দেশে অনেক নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ করে গত দুই যুগে যে পরিমাণ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও পাবলিক/প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাতে অনেক এলাকায় বর্তমানের শিক্ষার্থীর অনুপাতের চেয়েও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেশী বলে মাঝে মাঝে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও সে প্রতিষ্ঠানগুলোর মান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে গুণ যে কমে যায় তা জানা কথা। দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলেও সংখ্যার সাথে গুণ যে পাল্লা দিয়ে বাড়তে পারে নি, তার আমরা প্রমাণ পাই ছাত্র ভর্তির সময় গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠানে ভর্তি যুদ্ধ দেখে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যায় কোন সমস্যা নেই সমস্যা যা আছে তা হল তার মানে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানে কেন এত ঘাটতি, তা বিতর্ক সাপেক্ষ হলেও সরকারের নীতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই যে ঘাটতি আছে তা সহজে বোঝা যায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক সহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে এ বিষয়ে কিছুটা দায়ী করা যেতে পারে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে, যে কোন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও নিয়মনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও নীতিমালা দ্বারা পরিচালনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সে নীতিমালার কতটুকু বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে থেকে শুরু করে অদ্যাবধি শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। তারা যে শিক্ষানীতিগুলো প্রণয়ন করেছেন তার যথেষ্ট সমালোচনা ছিল এবং অনেক শিক্ষানীতির বাস্তবায়নের আগেই তা পরিত্যক্ত হয়। শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে সব চেয়ে দুঃখজনক কথা হল, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে তখন সে দলের রাজনৈতিক মত ও আদর্শের সাথে মিলিয়ে শিক্ষানীতি প্রণয়নে চেষ্টা করেছে, তাতে প্রণীত শিক্ষানীতি দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে না পারায়, তা পরবর্তীতে স্বাভাবিকভাবে অন্য ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক বর্জিত হয়েছে। জাতি এভাবে শিক্ষানীতির পর শিক্ষানীতি পেয়েছে কিন্তু সার্বজনীন ও যুগোপযোগী শিক্ষানীতির অভাবে এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়াতে, জাতি শিক্ষা ক্ষেত্রে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নি। সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে সে সর্ষে দিয়ে যে ভূত তাড়ানো তো যায় না তা সহজে অনুমেয়।

শিক্ষার উন্নয়নে ও মান বৃদ্ধিতে সার্বজনীন ও যুগোপযোগী শিক্ষানীতি পরে আসে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা। ভাল শিক্ষক যেমন ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্বশর্ত তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অণুকুল পরিবেশও ভাল শিক্ষক গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ যে মাঝে-মধ্যে বিঘ্নিত হচ্ছে, বা শিক্ষার অণুকুল পরিবেশ যে কখনো-সখনো থাকছে না, তা আমরা চোখ খুললেই দেখতে পাই। এক্ষেত্রে মন্দ রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে দায়ী করা যায়। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এতটাই খারাপ হয়েছে যে, শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার প্রভাব পড়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ, অনুদানভূক্তি সহ অন্যান্য কার্যক্রম রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ থাকে। যেখানে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুনীতির মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষকের বদলে অল্প যোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয় সেখানে ভাল শিক্ষক ও শিক্ষার কথা ভাবা দুরাশা মাত্র। এক্ষেত্রে বর্তমানে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (অনুদানভূক্ত) শিক্ষক হতে হলে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চাকুরী প্রত্যাশী শিক্ষককে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। কিন্তু এতেও যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের সমস্যা এখনো পুরোপুরি দূর করা হয় নি। সরকারী স্কুল/ কলেজের মত বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া পি.এস.সি বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার কথা মাঝে-মধ্যে বলা হলেও, এখনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে, তাতে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ও নিয়োগ বাণিজ্য কিছুটা হ্রাস করা সম্ভব হলেও পুরোপুরি বন্ধ করা যায় নি।

গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা না থাকার সুযোগে শিক্ষার মধ্যে অনেক বাণিজ্যিক উপাদান উপস্থিত হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির ফল স্বরূপ শিক্ষা বাণিজ্যের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে, শিক্ষার্থীরা সঠিক পাঠদান না পেয়ে কোচিং ও প্রাইভেট নামক বিকল্প শিক্ষার দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু লোভী শিক্ষক ও অসচেতন অভিভাবকদের দায়ী করা যায়। শিক্ষকরা কিছু টাকার লোভে শ্রেণীকক্ষে সঠিক পরিমাণে পাঠদান না করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বাজারে এনে দাড় করিয়েছে। এই বাজারে যার যত টাকা আছে সে তত বেশী শিক্ষা পাচ্ছে, আর যার টাকা নেই তাকে প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রতুল শিক্ষা নিয়ে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। এতে করে শিক্ষা তথা উচ্চ শিক্ষা কেবল সচ্ছল কিছু পরিবারের শিক্ষার্থীর মধ্যে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। যদিও দেশের আইন ও সংবিধানে সবার জন্য সমান শিক্ষা ও সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে কিন্তু প্রকারান্তরে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী অর্থাভাবে শিক্ষা বঞ্চিত হয়ে আরও পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় এই কোচিং ও প্রাইভেট নামক বিকল্প শিক্ষার দুষ্টক্ষত সৃষ্টিতে যে সকল শিক্ষক জড়িত তা কিন্তু নয়। মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষক এ বিষয়ে দায়ী, গোটা শিক্ষক সম্প্রদায় দায়ী নয়। কারণ কোচিং ও প্রাইভেটে খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষক জড়িত। কিন্তু বদনাম বইতে হচ্ছে সকল শিক্ষককে যা শিক্ষক সম্প্রদায়ের জন্য বিব্রতকর।

বাঙালী জাতি যদি শিক্ষা ব্যবস্থার কাছ থেকে ভাল মানের শিক্ষা পেতে চায়, তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে, সার্বজনীন শিক্ষানীতি ও শিক্ষা পরিকল্পনার পাশাপাশি শিক্ষাখাতে ব্যয় আরও বাড়াতে হবে। যদিও অন্যান্য খাতের তুলনায় আমাদের দেশে শিক্ষাখাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ থাকে, কিন্তু তা দেশের লোক সংখ্যার তুলনায় এবং উন্নত বিশ্বের শিক্ষায় বরাদ্দের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে যে, ভাল মানের শিক্ষা অর্জনে তা খুবই সামান্য। শিক্ষার উন্নয়নের জন্য এবং শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়নের স্বার্থে শিক্ষকদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশকে আরও ভাল করতে হবে। প্রকৃত মেধাবী ও সৎ ব্যক্তিদের এ পেষায় আনতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মন্দ রাজনীতির প্রভাব দূরীকরণের স্বার্থে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনীতিকে পৃথক করতে হবে। যদিও এককালে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি অনেক সুনাম কুড়িয়েছে কিন্তু বর্তমানে সে সুনাম ধরে রাখতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দলাদলি ও সংঘর্ষ শিক্ষার মান হীনতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক পরিবেশ রক্ষার খাতিরে দলাদলি ও সংঘর্ষ পরিহার করার লক্ষ্যে, রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড় ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা জরুরী।

ভাল ও মানসম্মত শিক্ষার লক্ষ্যে মাঝে-মধ্যে দু'একটা বিচ্ছিন্ন ভাল পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করার চিন্তা করা আর না করা সমান কথা। শিক্ষার মানের উন্নয়নের জন্য আজ দরকার যুগোপযোগী, ধারাবাহিক ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা দরকার। তবে শিক্ষার উন্নয়নে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ভাল শিক্ষক ও ভাল প্রতিষ্ঠানের।