জন স্টুয়ার্ট মিল: গণতন্ত্রের প্রবক্তা অথচ অনিচ্ছুক গণতন্ত্রী

Pramanik Jalal Uddin
Published : 31 Oct 2011, 07:09 PM
Updated : 31 Oct 2011, 07:09 PM

জন স্টুয়ার্ট মিল : গণতন্ত্রের প্রবক্তা অথচ অনিচ্ছুক গণতন্ত্রী

"সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর স্বৈরাচার, সংখ্যাগুরুর উপর সংখ্যালঘুর স্বৈরাচারের চাইতে বিন্দুমাত্র কম স্বৈরাচার নহে"–জে. এস. মিল

আধুনিক দর্শনের ইতিহাসে বিখ্যাত ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবাদী ও উপযোগবাদী দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নীতিবিদ ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল (জন্ম: ১৮০৬-মৃত্যু: ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দ) এক বিশেষ স্থান ও স্বাতন্ত্রের অধিকারী। তিনি দর্শন শাস্ত্রের পাশাপাশি নীতিশাস্ত্র ও রাষ্ট্রদর্শন-এর ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তার রাষ্ট্রদর্শনের মূল রূপরেখা তার বিখ্যাত 'অন লিবার্টি, 'রিপ্রেজেন্টেটিভ গভর্নমেন্ট', 'ইউলিটিটারিয়ানিজম' প্রভৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায়। তিনি প্রথম দিকে গণতন্ত্রের প্রতি যথেষ্ঠ আস্থাশীল থাকলেও পরবর্তিতে তার মতের পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে 'অনিচ্ছুক গণতন্ত্রী' হিসাবে পরিচিত হন।

তিনি তার মতের প্রথম দিকে গণতন্ত্রের প্রতি যথেষ্ঠ শ্রদ্ধাশীল থাকলেও তৎকালীন ইংলন্ড ও আমেরিকায় তিনি যে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বাস্তব চিত্র প্রত্যক্ষ করেন তাতে করে তার গণতন্ত্রের প্রতি সাবেক আস্থাকে টিকিয়ে রাখতে ব্যার্থ হন। এ্যলেক্সী ডি টকভিল তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'ডেমোক্রেসী ইন আমেরিকা'য় মার্কিন গণতন্ত্রের যে অপূর্ব বিশ্লেষণ প্রদান করেন মিল তার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।

ডি টকভিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করে যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন মিল ইংলন্ডের গণতন্ত্রেও ঠিক একই সম্ভাবনা দেখতে পান। এ কারণে তিনিও ডি টকভিলের সাথে সহমত ঘোষণা করে বলেন যে, "সাম্প্রতিককালে সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর স্বৈরাচার হচ্ছে বড় অভিশাপ এবং এ অভিশাপ সম্পর্কে গোটা সমাজের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।"

তিনি মনে করেন যে, প্রচলিত উদারনৈতিক গণতন্ত্রগুলিতে ত্র"টিপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার কারনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ক্রমবর্ধমাণ গতিতে অস্বীকার করা হচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বকে নিশ্চিত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার যে সংস্কারের সুপারিশ করেন তাতে গণতন্ত্রের সমতা নীতি কার্যত ব্যহত হয় এবং তিনি 'অনিচ্ছুক গণতন্ত্র' হিসাবে চিহ্নিত হন।

মিলের নিকট তথাকথিত উদারনৈতিক গণতন্ত্রের অপেক্ষা মানুষের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্রই ছিল অধিক মূল্যবান। কিন্তু তার মতে এই যে মানুষের স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে তা তখনই প্রতিফলিত হবে যখন মানুষ যথাযোগ্য প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে তার স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবে। আর এ কারনে তিনি সকলের বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্বকে সংখ্যাগুরুর স্বৈরাচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশেধক বলে গন্য করেন।

পার্লামেন্টে সংখ্যলঘুর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য তিনি টমাস হেয়ারের প্রস্তাবিত সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নীতি সমর্থন করেন। এ নীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিটি দল বা সম্প্রদায় যাতে তার স্বপক্ষে প্রযুক্ত ভোটের সংখ্যনুপাতে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে তা নিশ্চিত করা।

মিল গোষ্ঠী বা শ্রেণীস্বার্থের প্রভাবে পার্লামেন্টে একতরফা আইন প্রনয়ণের যে ত্র"টির কথা বলেছেন তা কোন স্বতন্ত্র ত্রুটি নয় বরং তা যথার্থ প্রতিনিধিত্বের অভাবজনিত ত্রুটির একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। সংখ্যলঘুরা যদি পার্লামেন্টে তার যোগ্য প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে সংখ্যগুরুর স্বৈরাচারী আচরণকে বাধা দেবার মত কোন উপায় থাকে না এবং স্বাভাবিক কারণেই সংখ্যাগুরুর মধ্যে এক তরফা আইন প্রনয়ণের প্রবনতা বৃদ্ধি পায়।

মিল যদিও বয়ঃপ্রাপ্তদের ভোটাধিকারের বিরোধী ছিলেন না তথাপি বিজ্ঞ-মূর্খ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকে সমান ভোটাধিকার প্রদানের নীতি সমর্থন করেন নি। সার্বজনীন ভোটাধিকার পূর্বে তিনি সার্বজনীন শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি আরো বলেন যে যারা কর প্রদান করে না, তাদের ভোটাধিকার থাকা উচিত নয়। তিনি বিজ্ঞ, বিচক্ষণ ও বিদ্বান ব্যক্তিরা যাতে তাদের মূল্যবান বিচার শক্তি দিয়ে সরকারের গুণগত উৎকর্ষ সাধন করতে সক্ষম হন তার জন্য তিনি শিক্ষিত ও বিদ্বান ব্যক্তির জন্য একাধীক ভোটের নীতি সমর্থন করেন। কিন্তু তিনি এখানে যেন শ্রেণীস্বার্থের উৎপত্তি না ঘটে সে জন্য তিনি বলেন যে, "যোগ্যতা থাকলে দরিদ্রতম ব্যক্তিটিও যাতে একাধিক ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন" মুক্তকন্ঠে তা ঘোষণা করেন।

বস্তুতঃ মিল প্রচলিত সংখ্যাভিত্তিক উদার গণতন্ত্রকে যথার্থ গণতন্ত্র বলে গন্য করেন না। তার মতে যেখানে কেবলমাত্র সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের স্বার্থ ও মতামতকে সমগ্র জাতির স্বার্থ ও মতামতের সাথে সনাক্ত করা হয়, সেখানে সত্যিকার অর্থে গনতন্ত্র থাকতে পারে না। এখানে যে গণতন্ত্র বিরাজ করে তা ভ্রান্ত গণতন্ত্র; যথার্থ গণতন্ত্র নয়।