সম-সাময়িক জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে ধর্ম ও ভাষার প্রভাব-১

Pramanik Jalal Uddin
Published : 23 March 2012, 06:33 PM
Updated : 23 March 2012, 06:33 PM

সাধারণভাবে জাতীয়তাবাদ বলতে এমন এক ধারণা বা পরিচয়কে বোঝায় যা একটা জনগোষ্ঠী ভিন্ন কোন জনগোষ্ঠী থেকে তারা তাদের পৃথক করে বা ভাবে। জাতীয়তাবাদের উপাদান অনেক। তার মধ্যে রক্ত বা বংশ, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি এক একটি অঞ্চলের মানুষকে একই সুতায় বেঁধেছে। জাতীয়তাবোধের মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ তাদের পরস্পরকে এক ও অভিন্ন ভাবতে শেখে।

যখন বিশ্বের কোন অঞ্চলের বেশীরভাগ মানুষ নিজেদের জাতীসত্ত্বার পরিচয়ে বলিয়ান হয়ে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে, তখন তারা এক স্বাধীন সত্ত্বায় পরিনত হয়েছে। যেমনটি হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। তৎকালীন বৃটিশ ভারতে স্বাধিকারের যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা ছিল বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ম প্রভাবিত। যদিও আন্দোলনের প্রথম ভাগে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের একটা ভূমিকা ছিলো কিন্তু তার অসহযোগ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পরিনতি লাভ করে 'দ্বি-জাতী তত্তে'¡ এবং তারই ভিত্তিতে ভারত, পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এ দুটি রাষ্ট্রের মানুষের ভাষাগত সাদৃশ্য তেমন ছিল না, ছিল বেশীরভাগ মানুষের ধর্মগত মিল। বিশেষ করে সাতচল্লিশের দেশ বিভাগে জাতীয়তাবাদের ধর্মীয় উপাদানটি অনেক বেশী সক্রিয় ছিল এবং তা প্রধান ভূমিকা পালন করে।

তৎকলীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বেশীরভাগ মানুষ মুসলমান ছিল বলে তারা ভূখন্ডগত দিক থেকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকলেও তারা তাদেরকে এক ভাবতে এবং এক রাষ্ট্রে বসবাস করতে দ্বিমত পোষণ করে নি। তারা দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর সাথে সাথে ভারত নামক রাষ্ট্রও জন্মলাভ করে মূখ্যত ধর্মের ভিত্তিতে। তাদের জাতীয়তাবাদেও ভাষাগত মিল তেমন ছিল না, যত না ছিল ধর্মগত মিল।

কিন্তু জাতীয়তাবাদের যে ধর্মীয় উপাদানের ভিত্তিতে তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষ এক জায়গায় দাঁড়িয়েছিল এবং পাকিস্তান নামক এক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলো, তা কিছু দিনের মধ্যে হুমকীর মুখে পড়ে যখন তৎকালীন পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর জুলুম-নির্যাতনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ অতিষ্ট হয়ে প্রতিবাদ করতে শুরু করে। তৎকালীন পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী জাতীয়তাবাদের অন্যতম উপাদান ধর্মের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে, আরেক উপাদান ভাষার উপর আঘাত করলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তখন প্রথম বুঝতে পারে যে, তারা তাদের ধর্মে এক হলেও পৃথক সত্ত্বা। তাদের ভাষা এক নয়। নতুন 'বাঙালী' জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটলো। এ নতুন জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল ভাষা। বাঙালীরা (যারা বাংলা ভাষায় কথা বলে) কেবল ভাষাগত সাদৃশ্যের জন্য একত্রিত হলো। এক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের ধর্মীয় উপাদানকে ছাপিয়ে ভাষাগত উপাদান প্রাধান্য লাভ করলো। মানুষের ধর্মীয় পরিচয় মায়ের ভাষার কাছে পরাস্ত হলো। ভাষার দাবীতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কিছু মানুষ ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করলো দৃঢ়তার সাথে। এবং সেই যে বাঙালী জাতীয়তাবাদ নবযাত্রা শুরু করলো শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেল বিশ্ববাসীর কাছ থেকে। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের কিছু মানুষ যারা ভাষার ভিত্তিতে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে এড়িয়ে, জাতীয়তাবাদের পুরোনো ধর্মীয় ভাবধারা আঁকড়ে ধরে অখন্ড পাকস্তানের সমর্থনে তৎকালীন পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীকে সমর্থন দিলে তারা ইতিহাসে বেঈমান-মীরজাফর হিসাবে অভিয়িত হয়।

বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পাকিস্তানের পুরানো সংবিধান বদলে এক নতুন সংবিধান লেখা হয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম প্রধান মূলনীতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্টিত হলো এবং জাতীয়তাবাদের অতি ধর্মীয় উপাদানগুলি কেটে-ছেঁটে এমন এক ভাবধারা প্রতিষ্ঠা পেল যা তৎকালীন বেশীরভাগ বাঙালীর প্রত্যাশিত ছিলো।