যে কথা কখনো কাউকে বলিনি!

Pramanik Jalal Uddin
Published : 17 May 2012, 11:06 AM
Updated : 17 May 2012, 11:06 AM

বয়স ষোল কি সতের। হঠাৎ করে শরীর ও মন কেমন যেন পাল্টে যেতে লাগল। শরীরে যেমন অনেক পরিবর্তন এলো তেমনি মনেও রং ধরলো। মোটেও স্বাস্থ্যবান ছিলাম না। রোগা পাতলা শীর্ণ চেহারা তার উপর আবার শ্যামলা বরণ। আকারে ছোট ছিলাম বলে স্কুলের বন্ধুরা আমাকে 'লিলিপুট' বলে ডাকতো। তখন স্কুলের সিলেবাসে 'গ্যালিভার ট্রাভেল্স, পড়ানো হতো। আমি তখন পরিণত হলাম লিলিপুট চরিত্রে। কেউ আমাকে স্কুলের ছাত্রীদের সামনে লিলিপুট বলে সম্বোধন করলে ভীষণ লজ্জা পেতাম। ঈশ্বরের কাছে রাতদিন প্রার্থনা করতাম একটু লম্বা হওয়ার জন্যে। কিন্তু আমার প্রার্থনা তার দরবারে বোধ হয় পৌঁছাতো না। তাই বাধ্য হয়েই শরীর চর্চায় মনোনিবেশ করলাম। মামাবাড়ির পাশের এক লিচু গাছের ডাল ধরে গোপনে অনেকক্ষণ ধরে ঝুলে থাকতাম। বন্ধুদের মুখে শুনেছিলাম লোহার রিং দড়িতে ঝুলিয়ে সেখানে কিছুক্ষণ ঝুলে থাকলে নাকি লম্বা হওয়া যাবে। কিন্তু লোহার রিং আর দড়ি পাব কোথায়? তাই লিচু গাছের নিচু ডাল ধরে খুব সকালে মামাবাড়ির কেউ জেগে উঠার আগে ঝুলতে লাগলাম লম্বা হওয়ার জন্য। স্কুলে যত শরীর চর্চার আইটেম শেখানো হতো বাড়ীতে তার বেশী বেশী প্রাকটিস করতে লাগলাম। গুনে গুনে উঠ-বোস করতাম, বুক ডাউন দিতাম যদি একটু লম্বা আর স্বাস্থ্যবান হওয়া যায়। খুব গোপনে এগুলো করতে হতো কারণ মামাবাড়ির লোকজন আমার এসব দেখলে হাসাহাসি করতে পারে। তবুও যেন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। ছোট ছিলাম বলে রোজ সকালে স্কুলেএ্যাসেম্বলীর সময় আমাকে লাইনের সামনে দাড়াতে হতো। কারণ লাইন শুরু হতো ছোট থেকে বড়তে। আমি লাইনের পিছনে লুকিয়ে থাকতাম। কিন্তু শরীর চর্চা শিক্ষক ঠিক খুঁজে খুঁজে আমাকে রোজ লাইনের প্রথমে দাড় করিয়েই ছাড়তো। স্কুলের মেয়েদের সামনে ভীষণ লজ্জা লাগত।

শরীরের সাথে সাথে চেহারার দিকেও এসময় আমার নজর পড়লো। শ্যামলা বরণ বলে নিজের চেহারা যেন নিজেরই ঠিক পছন্দ হচ্ছিলো না। বারবার আয়নায় মুখ দেখতাম আর ভাবতাম কিভাবে নিজের বরণটাকে আরেকটু ফর্সা করা যায়। সিদ্ধান্ত নিলাম মেয়েদের মত কিছু প্রসাধন সামগ্রী মাখলে কেমন হয়? মন্দ না। পাশের হাট থেকে স্নো ও পাউডার কিনে এনে গোপনে মামাদের চোখ এড়িয়ে মাখতে লাগলাম। সুফল পেলাম। কিছু দিনের মধ্যে দেখলাম মুখের বরণ কিছু কিছু করে উন্নতি হচ্ছে। আমি স্নো-পাউডার ব্যবহারের মাত্রা আরও বাড়াতে লাগলাম। সকালে স্নো-পাউডার মেখে দুপুরে আয়নার সামনে নিজেকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতাম কতটা ফর্সা হলাম। বেশ এগুচ্ছিলো দিনগুলি। কিন্তু হায়! কিছু দিনের মধ্যে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটা কেমন যেন কালো হয়ে যাচ্ছে। মুখের চারপাশে সদ্য গজিয়ে উঠা কালো লোমগুলি মুখের উজ্জ্বল ভাবটি ম্লান করে দিচ্ছে। প্রচণ্ড ভাবনায় পড়ে গেলাম। কি করা যায়? অনেক ভেবে মুখের লোমগুলো (সদ্য গজানো গোঁফ-দাড়ি) কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু কিভাবে কাটবো? আগে কখনো গোঁফ-দাড়ি কাটি নি। সেলুনে যাব? না, সেখানে যাওয়াটা ঠিক হবে না। ছোট বলে যদি ফিরিয়ে দেয়। শেষে নিজে নিজে কাটার সিদ্ধান্ত নিলাম। স্কুল থেকে ফেরার পথে লুকিয়ে দোকানে যেয়ে একটা একটাকা দামের দাড়ি কাটার ব্লেড কিনলাম। মামাবাড়িতে এসে কখন কোখায় কিভাবে গোঁফ-দাড়ি কাটবো সারারাত শুয়ে শুয়ে তার প্লান করতে লাগলাম। পরদিন শুক্রবার হওয়াতে সেদিন তা কাটার সিদ্ধান্ত নিলাম।

সকাল থেকেই আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য স্থান খুঁজতে লাগলাম। আমি যে ঘরে থাকি সেখানে আমার সাথে মামারাও থাকেন তাই ঘরে দাড়ি কাটার উপযুক্ত স্থান বলে মনে করলাম না। আরেকবার ভাবলাম দোতলার রেলিং-এ বসে কাটলে কেমন হয়? না, সেটাও নিরাপদ নয়, মামাবাড়ির কেউ দেখে ফেলতে পারে। মামাবাড়ির পাশেই বিশাল জঙ্গল। কেউ প্রয়োজন ছাড়া সেখানে যায় না। মোটামুটি দাড়ি কাটার জন্য নিরাপদ স্থান বলে বিবেচনা করলাম। ঠিক দুপুর বেলা সবার অগোচরে একটা আয়নার ভাঙ্গা টুকরা সংগ্রহ করে জঙ্গলের মধ্যে অতি সর্তপনে ঢুকে পড়লাম পাছে কেউ আমাকে দেখে না ফেলে।

জঙ্গলের গভীরে একটা ডোবার ধারে স্থান নির্ধারণ করে বসে পড়লাম। আর লক্ষ্য করতে লাগলাম কেউ আমাকে দেখে ফেলছে কি না। লুঙ্গির খুট থেকে ব্লেডটা বের করে মাটিতে রাখলাম। আয়নাটা বামহাত দিয়ে মুখের সামনে ধরলাম। ডানহাত দিয়ে প্যাকেট থেকে ব্লেডটা খুলে মুখে লাগিয়ে উপর থেকে নিচের দিকে টানতে লাগালাম। কট-কট শব্দে মুখের কয়েকটা লোম কেটে এলো। কিন্তু মুখে প্রচণ্ড ব্যথা হলো। শুকনো মুখে দাড়ি কাটছিলাম। তাই বোধ হয় ভাল কাটছিলো না আর ব্যথা পাচ্ছিলাম। ভাবলাম, মুখে পানি দিলে কেমন হয়? দাড়িগুলো ভিজে হয়তো নরম হয়ে কাটবে ভাল। পানির খোঁজ করতে লাগলাম। কিন্তু ভাল পানি পাই কোথাই? পুকুর সেত অনেক দূর। অগত্যা যে ডোবার পাশে বসেছিলাম তার ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পানি মুখে অনেকক্ষণ ঘষে জোরে জোরে ব্লেড চালাতে শুরু করলাম। এবার বেশ ভাল কাটছে। আরো জোরে মুখে ব্লেড চালাতে শুরু করলাম। অর্ধেক দাড়ি কাটা হয়েছে। আমার বোধ হয় হাত কাঁপছিলো। কিছুক্ষণ পর টের পেলাম মুখে অসংখ্য রক্তের ধারা নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। রক্ত দেখে প্রচণ্ড ভয় পেলাম। আয়নায় ভালভাবে দেখলাম মুখে গোটা দশেক কাটা চিহ্ন। হাতের আঙ্গুল দিয়ে টিপে অনেক চেষ্টা করলাম রক্ত থামাবার। কিন্তু কিছুতেই তা থামছে না। কিছুতেই না………..

আমি মরিয়া হয়ে মুখের ক্ষতগুলি হতে রক্ত বেরুনো বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। বারবার ডোবার পচা পানিতে মুখ ধুলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখি আবারও রক্ত বেরুচ্ছে। প্রচণ্ড ভয় পেতে লাগলো। ভাবলাম রক্ত বেরুনো কখনো যদি বন্ধ না হয়! তখন মাথায় একটা বুদ্ধি এলো, গ্রামের অনেক মানুষকে দেখেছি কোন স্থান কাটলে কাঁচা দূর্বাঘাস চিবিয়ে লাগিয়ে দিতে। আমি আমার কাটা ক্ষতে দূর্বাঘাস লাগানোর জন্য তার সন্ধানে লেগে পড়লাম। কিন্তু তা পায় কোথায়? অনেক সন্ধান করে জঙ্গলের পার্শ্বে পতিত এক জমিতে তা পেলাম। আমি কিছু চিবিয়ে থেঁতো করে যেই মুখে লাগালাম কখন মনে হলো আমার মুখটা যেন আগুনের গোলায় পুড়ে যাচ্ছে! প্রচণ্ড জ্বলুনি হতে লাগলো। আমি তখন প্রায় পাগলপ্রায়। আমি জঙ্গলের মধ্যে জ্বলুনির চোটে উদ্দেশ্যবিহীন দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলাম। একে তো দাড়ি কাটতে গিয়ে কাটা ক্ষতের জ্বলুনি তারপরে আবার দূর্বাঘাসের রসের জ্বালাপোড়া। এ যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিট!
ঘণ্টা খানেক পর জ্বলুনি কিছুটা কমলে ক্ষতবিক্ষত মুখটা আয়নায় দেখলাম। ওমা! এখনো তো দেখছি অর্ধেক মুখ দাড়ি রয়ে গেছে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে আবারও দাড়ি কাটতে লেগে পড়লাম। এবার কিছুটা আস্তে-সুস্থে দাড়ি কাটতে লাগলাম। এবার আর তেমন কোন অসুবিধা হলো না।

দাড়ি কাটা যখন শেষ হলো তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। আমি দ্রুত মামাবাড়ির দিকে অগ্রসর হলাম। অগ্রসর হতেই রাস্তায় দূরসম্পর্কের এক নানীর সাথে দেখা। সে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসতে-হাসতে কিছু না বলে চলে গেল। বুকের মধ্যে ছাঁৎ করে উঠলো! আমি লুঙ্গির খুট থেকে ভাঙ্গা আয়নার অংশটা বের করে মুখের উপর ধরলাম। একি! আমার তো গোঁফ-দাড়ি কেটে মুখের গড়নই বদলে গেছে। আমি তো আর নিজেকে নিজে চিনতে পারছিলাম না। ক্ষতচিহ্নে ভরা দাড়ি কাটা মুখ সবাইকে কেমন করে দেখাব তার চিন্তায় পড়লাম। আবার আয়নাটা নিজের মুখ ধরলাম। না, এ পোড়া মুখ কাউকে দেখানোর নই। লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচতে আবারও জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় নিলাম কিছু সময় ভাববার জন্যে। অনেক ভেবে তখন বাড়ি না ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাবলাম আর কিছুক্ষণ পরে সন্ধ্যা হবে, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে অন্ধকারে বোধ হয় আমার মুখের দিকে কেউ লক্ষ্য করবে না। সন্ধ্যা লাগানোর জন্য জঙ্গলের মধ্যে এদিক-ওদিক উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরতে লাগলাম। দুপুরে খাওয়া হয়নি, ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে। জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড ক্ষুধায় আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। হয়তো একটু ঘুমিয়েছিলাম। মাগরিবের আজানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। জেগে দেখি একটু একটু করে আঁধার নামতে শুরু করেছে। বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।

অনেক কষ্টে সবার চোখ এড়িয়ে মামাবাড়িতে প্রবেশ করলাম। বারবার দেখতে লাগলাম আমাকে কেউ দেখছে কি না। সফল হলাম। আমি সোজা গিয়ে আমার পড়ার টেবিলে হারিকেন জ্বালিয়ে বাধ্য ছেলের মত পড়ার অভিনয় করতে লাগলাম। হারিকেনের জোর একটু কম দিলাম যাতে অল্প আলো হয় এবং আমার কাটাছেড়া দাড়িকাটা মুখটা যেন কেউ দেখতে না পায়। ভাগ্য ভাল যে সে সময় মামারা কেউ বাড়িতে ছিল না। আমি খেতে যাওয়ার জন্য মামীর ডাকের অপেক্ষা করতে লাগলাম আর জোরে জোরে পড়তে শুরু করলাম যাতে মামী শুনতে পেয়ে খাবার জন্য আমাকে ডাকে। ক্ষুধায় তখন প্রায় মরি মরি অবস্থা।

অবশেষে খাবারের ডাক পড়লো। আমি দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে আবার থমকে দাঁড়ালাম। মুখের ক্ষতচিহ্নগুলোর উপর হাত বুলালাম। আর ভাবতে লাগলাম মামী যদি আমার দাড়ি কাটা মুখটা দেখে ফেলেন? ভারি লজ্জা লাগবে। আবারো মামীর ডাক শুনতে পেলাম। এবার কোন কিছু না ভেবে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে এগুলাম।
রান্নাঘরে মামী আমাদের জন্যে ভাত বেড়ে অপেক্ষায় ছিলেন। আমি ঘরে ডুকতেই দুপুরে না খাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। আমি অনেক মিথ্যা বলে কাটিয়ে দিয়ে খাবার খেতে লাগলাম। বুক দুর-দুর করে কাঁপছে। যদি মামীর কাছে ধরা পড়ে যায়? ভীষণ লজ্জা লাগবে। আমি যত সম্ভব মামীর দিকে না তাকিয়ে দ্রুত খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু আমি কিছুক্ষণের মধ্যে টের পেলাম মামী আমার মুখের কি যেন খোঁজার চেষ্টা করছেন। হারিকেনের সামান্য আলোতে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। আমি তখন খুব ভয়ে ভয়ে খাবার বন্ধ করে মামীর মুখের দিকে ভয়ে-ভয়ে তাকালাম। এবার মামী হারিকেনে কিছুটা দম দিয়ে আমার মুখের কাছে ধরলেন। তারপর কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ফিক করে হেঁসে বললেন "তুমি দাড়ি কেটেছো?"
মামীর কথা শুনে আমি এর কোন উত্তর দিতে পারলাম না। মাথা নিচু করে শুধু লজ্জায় মরে যেতে লাগলাম…………..

কুল কর্তৃপক্ষের ঘোষণায় তখন সবে মাত্র স্কুলে প্যান্ট-শার্টের প্রচলন হয়েছে। এর আগেও সৌখিন পরিবারের ছেলেরা কেউ কেউ প্যান্ট-শার্ট পরতো, তবে বাধ্যবাধকতা ছিল না। মায়ের কাছে জেদ ধরে নতুন প্যান্ট-শার্ট তৈরি করে পরতে শুরু করলাম। পরতে গিয়ে বিপত্তি বাধলো। লুঙ্গি ছেড়ে নতুন প্যান্ট ধরেছি, কিন্তু পায়ে স্পঞ্জের সান্ডেল। ঠিক যেন মানায় না। বন্ধুরা পরনে ইংলিশ স্থান আর পায়ে বাংলাস্থান বলে রাগাতে লাগল। ওদের কি আর বলবো, সত্যিই শার্ট-প্যান্টের সাথে পায়ে স্পঞ্জ স্যান্ডেলে ঠিক মানাতো না। বাড়ি এসে আবারও মায়ের সাথে চামড়ার জুতার জন্য জেদ শুরু করে দিলাম। দু'এক সন্ধ্যা অনশনের পরে মা আমার দাবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার হাতে একশো বিশ টাকা দিয়ে আমার অনশন ভাঙ্গালেন। আমি টাকা পেয়ে যেন আসমানের চাঁদ হাতে পেলাম। কিন্তু সমস্যায় পড়লাম, জুতা কেনা হবে কোথা থেকে আর কেইবা কিনে দেবে? তখন আমাদের গ্রামের হাট-বাজারে চামড়ার জুতা-স্যান্ডেল পাওয়া যেত না। বাবা-চাচাদের বলে কয়ে রাজী করাতে পারলাম না। অবশেষে নিজেই জুতা কিনতে শহরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। এর আগে কখনও একা একা শহরে যায় নি। বড় ভয় করতে লাগল। কিন্তু জুতা কেনার প্রচণ্ড আনন্দে তা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে রইলাম।

আমাদের স্কুলের পাশ দিয়ে চলে গেছে শহরে যাবার ইটের এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা। কয়েক ঘণ্টা পরপর লক্কড়-ঝক্করমার্কা কয়েকটা বাস চলাচল করতে দেখেছি। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখে কিছু গুজে দিয়ে বাসস্টান্ডে পৌঁছে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর বাসের দেখা পেলাম। বাসে উঠেই ভয় আমাকে পেয়ে বসলো। একা একা শহরে নতুন যাচ্ছি। শহরের রাস্তাঘাট তেমন কিছুই চিনি না। তাছাড়া নানী-দাদিদের কাছ থেকে ছেলেবেলায় শুনেছি শহরে ছেলেধরাদের দল ওঁত পেতে থাকে। কাউকে একা পেলেই খপ করে ধরে ঝোলার মধ্যে পুরে নেয়। ভয় পাচ্ছি আবার খুশি হচ্ছি এই ভেবে যে, কিছুক্ষণ পরেই আমি একজোড়া নতুন জুতার মালিক হতে যাচ্ছি। মনের মধ্যে একপাশে আনন্দ আর অন্যপাশে ভয় যেন আমাকে দ্বিগুণ উত্তেজিত করে তুলছিল। হঠাৎ করে বাসটি ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেল। আমি প্রায় সিট থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম। তাকিয়ে দেখলাম লোকজন বাস থেকে নামতে শুরু করেছে। আমি কিছুক্ষণ ঠায় বসে রইলাম। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে বাসের কনডাক্টর জিজ্ঞাস করলো আমি কোথায় যাব। আমার গন্তব্যের কথা বলাতে আমাকে জানিয়ে দিল আমার গন্তব্যে আমি পৌঁছে গেছি। ভয়ে ভয়ে বাম থেকে নেমে দেখলাম অজস্র মানুষ এদিক-সেদিক যাচ্ছে-আসছে। অতগুলো অপরিচিত মানুষ জীবনে কখনও দেখি নি। বড্ড ভয় পেতে লাগল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে জুতার দোকান খুঁজতে লাগলাম।

কিন্তু কোথায় জুতার দোকান তা ঠিক জানি না। ভাবলাম গোটা শহরটা একবার হেঁটে-হেঁটে জুতার দোকান খুঁজে নেব। বাস থেকে নেমে সোজা পশ্চিমের বড় রাস্তায় চলা শুরু করলাম। পকেটে তখন একশো পনের টাকা। পাঁচ টাকা বাসের ভাড়া দিয়েছি। মাঝে-মাঝে পকেট টিপে দেখছিলাম পকেটমার তা মেরে দিল কি না। ঘণ্টা দুয়েক হাঁটার পর ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। শহর আর ফুরাতে চায় না। যেদিকে যায় সেদিকেই শুধু বিল্ডিং আর বিল্ডিং। অবশেষে রাস্তার ধারে এক দোকানে বসে কিছু খাবার খেয়ে দোকানিকে জুতার দোকানের কথা জিজ্ঞাস করলাম। দোকানদার কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কোথা থেকে আসছি তা জানতে চাইল। আমি গ্রাম থেকে এসেছি জেনে একটু দূরে একটা জুতার দোকানে পৌঁছে দিল। দেখলাম সাইনবোর্ডে বাটা লিখা। রাস্তা থেকে কাঁচের সোকেসে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন ডিজাইনের জুতা দেখে খুশিতে মন ভরে উঠল। কোন ছেড়ে কোনটা নেব। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমার মনের এ রকম অবস্থা দেখে বাটার কর্মচারী এগিয়ে এসে জানতে চাইল কোনটি আমার চাই। আমি পোটা তিনেক জুতা জোড়ার দিকে ইঙ্গিত করতেই জুতার ভিতর দাম লিখা দেখিয়ে যা বললো তা শুনে তো আমার হৃদকম্পন থেমে যাওয়ার যোগাড়! জুতাগুলোর দাম দু'তিনশোর মত! আমার কাছে তখন মাত্র একশো দশ টাকা। একশো বিশের মধ্যে বাসভাড়া দিয়েছি পাঁচ টাকা আর খাবার খেয়েছি পাঁচ টাকা, দশ টাকা এর মধ্যেই ফিনিশ। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। কি করবো ভাবছি, এ সময় আবারো কর্মচারী এসে জিজ্ঞাস করলো আমার কোনটি পছন্দ। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাস করলাম আমার পায়ের একশোর মধ্যে কোন জুতা আছে কি না? সে না বলে আমার কাছ থেকে চলে গেল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর দোকানের কর্মচারীর কাছ যেয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, একশোর মধ্যে কোন জুতা আছে কি? সে না জানিয়ে দিল, তবে………………