মংপুতে রবীন্দ্র স্মৃতি রক্ষায় এক হই

চন্দন ভট্টাচার্য
Published : 4 Oct 2014, 12:08 PM
Updated : 4 Oct 2014, 12:08 PM

গিয়েছিলাম (৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪) দার্জিলিং-এর মংপুতে; রবীন্দ্রভবন দেখার ইচ্ছেয়। আমাদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে গোটা বাড়িটার সঙ্গে পরিচয় করালেন শ্রী শিশির রাউত, যিনি  'রবীন্দ্রভবনের ইন-চার্জ' বলে নিজের গর্বিত পরিচয় দেন। নেপালি মানুষটার কন্ঠস্থ কত-কত কবিতা, নিখুঁত সুরে গাইতে লাগলেন কত যে রবীন্দ্রসংগীত কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে! কিন্তু তার মুখে এক স্থায়ী বিষন্নতা।

'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' পড়া বা না-পড়া অনেক মানুষই জানেন, রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চার বার এসেছেন এখানে। প্রত্যেকবার থেকেছেন দীর্ঘ সময়, তার প্রচুর লেখার উৎপাদনকেন্দ্র মংপু। এই বাড়িতেই কাটিয়েছেন শেষের আগের জন্মদিন মৈত্রেয়ী দেবীর আতিথ্যে আর প্রচুর পাহাড়ি মানুষের ভালোবাসায়।

কিন্তু শিশিরবাবুর মতে, নির্মাণটিকে ঠিকঠাক রাখা বড় অসম্ভব হয়ে উঠছে দিন দিন। না জিটিএ, না রাজ্য সরকার, কারুরই দায়িত্বে নেই এমন মূল্যবান ঐতিহাসিক আবাস।


রবীন্দ্রভবন


রবীন্দ্রভবনে কবির লেখার ঘর

ঠিক মুখোমুখি রয়েছে যে গভর্নমেন্ট কুইনাইন ফ্যাকট্রি (১৮৬৪ সালে তৈরি), তার পরিচালকেরা একজন মালিক বহাল করেছেন বাড়ি-বাগান সাফসুতরো রাখার কাজে আর রবীন্দ্র-মিউজিয়াম দেখাশোনা করেন এই যে মিস্টার রাউত (দর্শকদের জন্যে বরাদ্দ সময় সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১২টা দুপুর দেড়টা থেকে ৪টা), তাকে কারখানা কর্তৃপক্ষ দিচ্ছেন মাসে খুব সামান্য মাসোহারা; যা দিয়ে শিশিরবাবুর সংসারের দায় কোনও মতেই মেটে না। কারখানাটাও নিজেই দুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের আগ্রহ স্বাভাবিক কারণে আর আগের মতো নেই।


রবীন্দ্রভবনের ইনচার্জ শিশির রাউত

রাউত মশাইয়ের মুখেই শুনলাম, ১৯৫৪ সালে মৈত্রেয়ী দেবীর উদ্যোগে এই বাড়ি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রমকল্যাণ দপ্তর দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। তারা ছিলেন ২০০০ সাল পর্যন্ত। এখানে তখন দপ্তরের পরিচালনায় স্থানীয় ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাচের স্কুল, সেলাই স্কুল ইত্যাদি চলত। তাদের জন্যে ব্যবস্থা ছিল ক্যারাম বা টিটি খেলারও। ২০০০ সালে তখনকার নগর উন্নয়ন দপ্তরের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়িটিকে মিউজিয়াম বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেইভাবে সংস্কার-প্রক্রিয়া চলে। স্থানীয় মানুষ, সরকারি কুইনাইন ফ্যাকট্রি — এদের নিয়ে গড়া হয় কমিটি। তখন থেকে আজ ১৪ বছর শ্রী শিশির রাউত মিউজিয়ামের দায়িত্বে। কিন্তু, শিশিরবাবুর মতে, ওই সময় থেকেই রবীন্দ্রভবনের রক্ষণাবেক্ষণের আর্থিক দায়িত্বে নিয়মিতভাবে আর কেউ থাকল না। কাজেই কোনও অসুবিধেয় পড়লে সরকারি অফিসে ছুটোছুটি আর ধরাধরির একশেষ হতে হচ্ছে।

যখন-যেমন-তখন-তেমন ভিত্তিতে ২০০৬ সালে স্থানীয় সাংসদের এমপি ফান্ডের টাকায় কিছু সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হয়। ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল ঝড়ে দুটো গাছ ভেঙে পড়েছিল। ফলত, বাড়ির ডানদিকের বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডিএম অফিসে বলে-কয়ে সুবিধে হচ্ছিল না। তারপর যেই জানা গেল, মন্ত্রী আসবেন ২২ শ্রাবণ, ঠিক তার পাঁচদিন আগে তড়িঘড়ি সারিয়ে দেওয়া হল। রবীন্দ্র ভবনের উঠোনে একটা ফলকে পড়লাম উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তরের চেষ্টায় বাড়ির ভেতরে বিদ্যুতায়ন ও বাগানে আলো লাগানোর কথা। এটা কবে হল, সময়ের উল্লেখ নেই।


রবীন্দ্রভবন

রবীন্দ্রভবনের গুরুত্বপূর্ণ নথি রক্ষণের কাজও পিছিয়ে যাচ্ছে টাকার অভাবে। কিছু মূল ফটোগ্রাফ (রথীন্দ্রনাথের ডিজাইন-করা কাঠের চেয়ারে বসে কবি লিখছেন ইত্যাদি) বা ১৯৩৯ সালের ২৮ মে'র ন্যাশানাল হেরাল্ড সংবাদপত্রের কপি, নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। পর্যটকের মরশুম যে সময়টায়, তখন অনেকেই এইসব ক্ষয়িষ্ণু বস্তু ধরা-ছোঁয়া করতে থাকেন, একা শিশিরবাবুর পক্ষে সম্ভব হয় না সবাইকে ঠেকানো।

এই প্রসঙ্গে জানানো দরকার, রবীন্দ্রভবনেই একটা গ্রন্থাগার রয়েছে এরিয়া লাইব্রেরি নামে। তার লাইব্রেরিয়ান দীপেন তামাং জিটিএ-র বেতনভোগী কর্মচারি। তিনিও একমত, মিউজিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণ আর তার  ইন-চার্জের পরিশ্রমের বিনিময়মূল্য- এই দুটোর ব্যবস্থা করা একান্ত দরকার।


রবীন্দ্রভবনের বারান্দা

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী অনেকবার পাহাড় সফর করেছেন।  তিনি মংপুতে এসেছেন তিনবার এবং শিশির-দীপেনদের বক্তব্য হল, রবীন্দ্রভবন নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করবেন বলে কথাও দিয়েছেন। তারা আরও বলছেন, কালিম্পং-এ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-জড়ানো বড়িটার অবস্থা নাকি এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, আইনের বাধা না থাকলে মংপুর রবীন্দ্র-মিউজিয়ামের দায়িত্বও নিতে পারে জিটিএ। যেহেতু এই বাড়িরই আরেক অংশের পরিচালনা তারা আগে থেকেই নিয়োজিত আছে। শুধু দরকার, এ ব্যাপারে তাদের একটু উদ্বুদ্ধ করা।


রবীন্দ্রভবনের ইনচার্জ শিশির রাউত

ভ্রমণের সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, পাহাড়ের সাদাসিধে নাগরিকেরাও একটা পরিহাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে, প্রশাসনের সব কর্তাই এখানে এসে উন্নয়নের নানান আইডিয়া বিলোতে থাকেন, কিন্তু সেবকের করোনেশন ব্রিজ পেরনো মাত্র ভুলে যান সব প্রতিশ্রুতি।


রবীন্দ্রনাথের শোয়ার ঘর


রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় লিলিফুল, যাকে ওখানে গ্রাউন্ড লিলি বলে

শিশিরবাবু এমন তির্যক কোনও মন্তব্য করেননি আমাদের কাছে। কাজের ফাঁকে নিজের মনে গাইছিলেন, "জানি না কোথায় জাগো ওগো বন্ধু পরবাসী/কোন নিভৃত বাতায়নে/সেথা নিশীথের জলভরা কন্ঠে/ কোন বিরহিণীর বাণী তোমারে কী যায় বলে…।"

রবীন্দ্রভবনের মূল্যবান সঞ্চয় বাঁচিয়ে রাখতে আপাতত কবির স্বদেশী বন্ধুদের একজোট হওয়া খুব দরকার।