তাহেরা হত্যাকাণ্ড কি ধামাচাপা পড়ে যাবে?

মোস্তাফিজ ফরায়েজী
Published : 21 Dec 2014, 05:02 PM
Updated : 21 Dec 2014, 05:02 PM

অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের মতো ধামাচাপা পড়ে গেল তাহেরা হত্যার ঘটনাও। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানায় কয়েকদিন আগে ঘটেছিল এক নিকৃষ্ট হত্যাকাণ্ড যে হত্যাকাণ্ডটি তাহেরা হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। কয়েকজন তরুণ তাহেরা নামক এস এস সি পড়ুয়া এক বালিকাকে ধর্ষণ করে হত্যা করে। শুধু হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি পশুরা, তারা সেই মৃতদেহের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এরকম নির্মম হত্যাকাণ্ড সচেতন আলমডাঙ্গাবাসিরা মেনে নিতে পারে নি। এজন্য আলমডাঙ্গাবাসিরা তাহেরা হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের মধ্যে ছিল আলমডাঙ্গার ইতিহাসে সর্বোবৃহৎ মানববন্ধন, টি এন ও অফিস ঘেরাও, মিছিল ইত্যাদি। এছাড়া তাহেরা হত্যাকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে যে ঝড় এখনো থামেনি। তাহেরা হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে কবি রাহিম আজিমুল এক মর্মান্তিক কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি নিচে দেওয়া হলো।

পড়িতে ছিল তাহেরা বাসায় ছিলনা কেউ,
বাবা-মা গ্রামে গেছে, যেতে চেয়ে ছিল সেও।
এসএসসি পরীক্ষার্থী, পড়ার অনেক চাপ,
বাবা-মা যাওয়ার ক্ষণে লেগেছিল খারাপ।
নরপিশাচরা তখন বাসায় ঢোকে ভিন্ন মতলব,
প্রেমেতে দেয়নি সাড়া বকাটেদের ক্ষোভ।
ঝাপিয়ে পড়ে অবলার বুকে কুকুর বেশ,
ধর্ষণ করে তারা না করিল শেষ।
আর্তনাদ করে তাহেরা বাঁচতে দাও মোরে,
ধর্ষণ শেষে তারা নাহি গেল সরে।
"আমাকে ছেড়ে দাও আমাকে বাঁচতে দাও"
নরপিশাচরা ক্ষত-বিক্ষত করল বুক হাত পাও।
অবশেষে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলালো ফ্যানে,
তাহেরার আর্তনাদ বেজে উঠে বিবেকের কানে।
কেপে উঠে আকাশ বাতাস কেপে উঠে মাটি,
সব শেষ! জড়াতে হল পরিকে খেজুরের পাটি।

তাহেরাকে নিয়ে আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায় ঠিক তখন থেকে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের মতো তাহেরা হত্যাকাণ্ডকেও ধামাচাপা দেবার পায়তারা শুরু হয়। অবশেষে ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে পুলিশ-প্রশাসন-সরকার মিলিত হয়ে তাহেরার মরদেহের পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট দেওয়া হয় যাতে বলা হয়েছে, তাহেরা আত্মহত্যা করেছে, যা এলাকাবাসীর কাছে কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

এ থেকে স্পষ্ট যে তাহেরা হত্যাকাণ্ড ধামাচাপার জন্য অনেক টাকার লেন দেন ইতিমধ্যে উপর মহলে হয়ে গেছে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, এত কিছুর পরও দেশের মিডিয়াগুলো খুব ভালোভাবে নিউজটা ফোকাসে আনে নি আবার নারীদের অধিকার নিয়ে যারা কথা বলে তারাও এগিয়ে আসে নি। অথচ দিনের পর দিন ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও সব ঘটনাই ধ্মাচাপা পড়ে যায়। এ বিষয়টাকে মাথায় রেখে আমি একটি ছোট প্রবন্ধ লিখেছিলাম যার নাম "আমি তাহেরা বলছি।" তাতে আমি যা লিখেছিলাম।

"জন্মালাম, বড় হলাম, ক্লাস টেনে পড়তাম, আমাকে খুবলে খুবলে খাওয়া হলো, তারপর মরে গেলাম, আমি তাহেরা বলছি। না, ঢাকা থেকে নয়, দেশের এককোণের শহরতলী থেকে। না, আমি ভিকারুন্নেচ্ছাতে পড়তাম না, পড়তাম আলমডাঙ্গা পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ে, তাই পত্রিকায় ঘটা করে কেউ কিছু লেখে নি। আচ্ছা ঢাকার মানুষের জীবনের দাম বুঝি অনেক বেশী?

গ্রেফতার হয় নি কেউ। এত্ত বড়ো মানববন্ধন হলো আমাকে নিয়ে, আমার বন্ধু বান্ধব সবাই আসলো, আসলো সচেতন মহল, যেন জেগে উঠলো ছিচকে শহরতলীটা, কই দেশ তো জাগলো না। আমি কি দেশের কেউ নই! ওহ, আচ্ছা! আমি তো সাগর-রুনী নই। আমিতো সাধারণ এক মেয়ে ছিলাম। আমার জীবনের আর দাম কি?

আমি আমার কথা বলছি না, শত শত তাহেরার কথা বলছি। আমি আমার হত্যার বিচার চাই না, আমার ধর্ষণের বিচার চাই না। আমি চাই শত শত তাহেরার হত্যার বিচার, চাই শত শত তাহেরার ধর্ষণের বিচার।
আমি তাহেরা বলছি।"

এখনো তাহেরাকে নিয়ে আন্দোলন চলছে। এখনো মানুষ তাহেরাকে নিয়ে আলোচনা করছে। এখনো আলমডাঙ্গার সচেতন মহলেরা তাহেরা হত্যার বিচার চাই। তাহেরা হত্যার বিচার না হলে, কতদিন আলমডাঙ্গাবাসিকে তাহেরার লাশ বয়ে বেড়াতে হবে তা কারো জানা নেই। আর কত তাহেরা আলমডাঙ্গায় ধর্ষিত হবে কিংবা এদেশে ধর্ষিত হবে তাও জানা নেই। তবে আলমডাঙ্গাবাসিরা গুনতে থাকবে প্রতিটি তাহেরার লাশের সংখ্যা, দেশবাসি গুনুক আর নাই গুনুক। তাহেরা আলমডাঙ্গার মানুষের হৃদয়ে বারবার ফিরে আসবে থমথমে এক নিঝুম রাত হয়ে। আলমডাঙ্গাবসিরা একদিন বলবে, আমরা জেগেছিলাম কিন্তু দেশবাসি আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায় নি, নারীবাদী সংগঠনগুলো আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায় নি, প্রশাসন-সরকার সঠিক দায়িত্ব পালন করে নি, তবু আমরা লড়ে গেছি। তাই হতাশার কিছু নেই, আলমডাঙ্গাবাসিরা জাগতে শিখেছে।