রৌরব (কিস্তি ৩)

লীসা গাজী
Published : 5 Feb 2009, 05:26 AM
Updated : 5 Feb 2009, 05:26 AM

(কিস্তি ২-এর পর)

লাভলী লক্ষ্য করলো মেয়েটা পিছন দিকে তাকিয়ে মাথা হেলিয়ে আসছি বলেই দৌড় দিলো লাল মাফলারের দিকে।

( — একটা লোক ভালো মনে আপনের সঙ্গে কথা বলতে চায়, কথা বলেন। এত ভয় পাচ্ছেন কেন?)

— চিনি না জানি না, আন্দাজে কী কথা বলবো? ভয় পাবো না, যদি ছিনতাইকারী হয়?

( — জন্মে শুনছেন ছিনতাইকারী আলাপ পরিচয় করে ছিনতাই করতে আসছে? আর আপনে ঢাকার রাস্তায় কখনও বার হইছেন যে মানুষ চিনবেন? লোকটা হয়তো দুইটা রসের কথাও বলতে চাইতে পারে।)

—————————————————————–
– আমার মাথার ভিতরে একটা লোক আছে খুব যন্ত্রণা করে, তার সাথে মাঝে মধ্যে কথা বলি। আপনে কিছু মনে কইরেন না।

লাভলীর কথায় ছেলেটা লাজুক হাসলো, যেন মাথার ভিতরের লোকের ব্যাপারটা সে বুঝে ফেলেছে। কী একটু ভাবলো, তারপর সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে বেঞ্চের যে কোনায় লাভলী বসেছে তার অন্য কোনায় জড়োসরো হয়ে বসলো। লাভলী আর ছেলেটার মাঝখানে নির্জন বেঞ্চ আর বাদামের ঠোঙ্গা পড়ে থাকে।

—————————————————————-

— লাল মাফলারের সাথে আমি রসের কথা বলতে যাবো কোন দুঃখে?

( — দুঃখ আপনের কম নাই আপুমনি, দুঃখ আছে। অবশ্য সে তর্কে গিয়া কোনো ফায়দা নাই। ঘটনা এখন যা ঘটবে চিন্তা করতেই মজা লাগতেছে।)

মেয়েটা আবার দৌড়ে ফিরে এলো। দৌড়াদৌড়ির চোটে বেচারা হাঁপাচ্ছে। কথা বলতে গিয়ে দম হারিয়ে ফেলছে। শিউলি ফুলের মালা তিনটার বদলে এখন মাত্র একটা কব্জিতে ঝুলে আছে। বাকি দুইটার কী গতি হয়েছে কে জানে। মেয়েটা গেছে তো বেশিক্ষণ হয় নাই। মেয়েটা থুক করে এক দলা থুতু পায়ের কাছে ফেললো।

— আফা, হেই বেটা আপনের লগে কথা কইবো। ডাহুম? ওই দেখেন গাছের ছেমায়, এহন দেহা যায় পষ্ট।

( — আরে দেখেন না আপুমনি, পছন্দ হয় কি না?)

দেখলে কী দোষ, শুধু মাথাটা পিছনে ঘুরালেই লাল মাফলারকে দেখা যাবে। সন্ধ্যা না, রাত না, দুপুরের সময়, কী আর হবে। ওকে তো আর সবার সামনে গলায় ছুরি বসাতে পারবে না। যদি হঠাৎ ভয় লাগেই তাহলে ওই মাথা-মালিশ লোকটাকে ডাকা যাবে, যার মাথা মালিশ করা হচ্ছে তাকেও ডাকা যেতে পারে। ওরা দুইজন তো এখন মালিশ-টালিশ বাদ দিয়ে ঠায় তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ব্যাপার ঘটছে বুঝতে পেরেছে বোধহয়। সুতরাং ইশারায় ডাকলেও কাজ হবে, পড়িমরি করে ছুটে আসবে। তাছাড়া আশেপাশেই জোড়ায় জোড়ায় অনেকেই বসে আছে, প্রেম করছে। বাদামওয়ালাও আছে নিশ্চয়ই, কাছে ধারে কোথাও। সাহস করে লাভলী এবার মাথাটা পিছনে ঘুরাতেই লাল মাফলারকে দেখে ফেললো। লাল মাফলার এখন আবার একটু এগিয়ে এসেছে, বেশ বোকা বোকা ভদ্র চেহারা। বয়সও মনে হচ্ছে ওর চাইতে অনেক কম। ওর চাইতে বয়স কম হওয়া অবশ্য কোনো বড় ব্যাপার না, অনেকেরই কম। আচ্ছা, এই লাল মাফলার ছেলেটা কেন ওর সাথে কথা বলতে চায়? লাল মাফলারকে এবার বেশ ভালো করে তাকিয়ে দেখলো লাভলী। ছেলেটার মধ্যে কেমন একটা গোবেচারা ভঙ্গি। লাভলী টের পেলো, ওর মন থেকে ভয় ভয় ভাবটা দূর হয়ে যাচ্ছে। লোকটা অপ্রস্তুত একটা হাসি দিয়ে আছে। গায়ে গলা বন্ধ খয়েরি রঙা সুয়েটার আর লাল মাফলার, কালো রঙের প্যান্ট, চুল ভালোই লম্বা — বাতাসের ঝাপটায় চোখে মুখে এসে পড়ছে। এই কারণে বয়স আরও কম লাগছে। কতো হবে বয়স — তিরিশ, বত্রিশ? নাকের নিচে সরু হালকা গোঁফ। লাল মাফলার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

( — পছন্দ হইছে, পছন্দ হইছে।)

— তোমার মাথা।

ছোট মেয়েটা ইতিমধ্যে কখন উধাও হয়ে গেছে লাভলী টের পায় নাই, বিস্মিত হয়ে ও তাকিয়ে দেখলো লাল মাফলার সাহেব এক পা দুই পা করে ওর বেঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছে। ওর এখন কী করা উচিৎ, সটান উঠে দাঁড়িয়ে উল্টা দিকে হাঁটা দেয়া উচিৎ, চীৎকার দেয়া উচিৎ, নাকি মুখ ঘুরিয়ে ফেলা উচিৎ। লাভলী অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, এই তিনটা উচিতের কোনোটাই ও করলো না বরং কিছু না ভেবেই ডান হাত দিয়ে কপালের চুলগুলি একটু ঠিকঠাক করে নিলো, দুই বেণীর একটাকে সামনে নিয়ে আসলো। বৃথাই চেষ্টা! এইসব করতে করতে ছেলেটা প্রায় বেঞ্চির কাছে চলে এলো। বেঞ্চির কাছাকাছি এসে ঘাড় ডানে বাঁয়ে ঘুরিয়ে আবারও আশপাশটা দেখে নিচ্ছে। এই ছেলের মতলবটা কী!

লাভলী হঠাৎ করে ভিতরে একটা তাড়া খেলো, এক দৌড়ে সেখান থেকে সরে পড়তে ইচ্ছা করছে ওর। দৌড়াতে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি পৌঁছে তবে দম ফেলবে! বিউটি অবশ্য এতে খুবই বিরক্ত হবে। কিন্তু আম্মা যখন এরকম হাঁসফাঁসের কারণ জিজ্ঞেস করবেন তখন ও কী উত্তর দিবে। ফরিদা খানম তখন ঠিকই নারিকেল কুরানির মতো কুরে কুরে ওর ভিতর থেকে সব খবর বের করে ফেলবেন; তারপর শেষ রাতের দিকে শিল পাটার শিল দিয়ে মাথায় একটা ছোট্ট বাড়ি দিবেন। কার্য হাসিল!

অচেনা ছেলের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, কী কথা বলতে হয় ওর আসলেই জানা নাই। লাভলী সোজা হয়ে গুছিয়ে বসে ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করছে।

অনেকক্ষণ ধরেই তো সোজা হয়ে বসে আছে, লাল মাফলারের আসতে এতো দেরি হচ্ছে কেন? সে তো এসেই পড়েছিলো। যখন লাভলী নিশ্চিত যে ছেলেটা আসছে না ঠিক তখুনি পিছন থেকে, একেবারে বলা যায় ওর ঘাড়ের ওপর থেকে আলতো খুক খুক আওয়াজ শুনতে পেলো। ও তাও চলৎশক্তিহীন হয়ে বসে রইলো। এবার আরও একটু জোরে গলা খাকারি দেয় লাল মাফলার। লাল মাফলারই তো, পিছন ফিরে এখন যদি ও অন্য কাউকে দেখে!

— আমাকে কিছু বলবেন?

( — বাহ! আনাড়ি হিসাবে শুরুটা খারাপ হয় নাই, আপুমনি।)

প্রশ্নটা শুনে লাল মাফলারের কাশির দমক বেড়ে গেলো। প্রচণ্ড বেগে কাশতে শুরু করেছে। নিজেকে সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে সে। শীতের নরম রোদে তার ফাটা ঠোঁট চোখে পড়লো লাভলীর। কোনো রকমে থুতু ফেলে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকালো ছেলেটা — কেমন আড়ষ্ট হয়ে এতোটুকুন হয়ে গেছে। সেই মুহূর্ত থেকে লাভলীর পুরো ব্যাপারটা ভালো লাগতে শুরু করলো। একটু আগের অস্বস্তি, ভয় আর অসহায়তা কোথায় উবে গেছে। চট করে উপর আর নিচের ঠোঁট জোড়া চেটে নিলো।

( — কথা বলেন না কেন, আপনের দিকে তাকায়ে খাবি খাইতেছে দেখেন না?)

— আপনে আমাকে কিছু বলবেন?

— না, মানে আপনি একা দেখে কথা বলতে আসলাম।

একটা বাক্য বলতে গিয়ে লাল মাফলারের ঘাম বের হয়ে গেছে। সে যত্ন করে প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল আর ঘাড় মুছলো। রুমালটা ধবধবে সাদা। এমন সাদা যে রোদের নরম আলোতেও জ্বলে উঠেছে।

ইশ, এতো পরিষ্কার রুমালটা বরবাদ হয়ে গেলো, মনে মনে ভাবছে লাভলী। লোকটার সাথে কথা বলার জন্য আর কতোক্ষণ ঘাড় ঘুরিয়ে রাখবে বুঝতে পারছে না। এরই মধ্যে ঘাড়ে চিন চিন ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। লাভলী দেখলো পাশের বেঞ্চির মাথা-কান মালিশ করানো লোকটা কৌতূহলের চোটে বেঞ্চ থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছে। ধ্যাৎ, আর কাঁহাতক ঘুরে থাকা যায়, লাল মাফলারের কথা বলতে ইচ্ছা হলে সামনে এসে দাঁড়াবে। লাভলী আস্তে ধীরে আবার সোজা হয়ে বসলো। ছেলেটা আবারও বার দুয়েক খুক খুক করে থেমে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ আর কোনো শব্দ শোনা যায় না, ছেলেটা আছে না চলে গেছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎই একটা ভারি নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ টের পেলো পিছনে, আর সাথে সাথে লাভলীর ভিতর থেকেও একটা গভীর শ্বাস বেরিয়ে এলো কোনো রকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া।

লাল মাফলার শব্দহীন ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে বসেছিলো লাভলী, ছেলেটার জুতাজোড়া নজরে এলো, ঝট করে মাথা তুললো আর চোখাচোখি হয়ে গেলো ছেলেটার সঙ্গে।

( — এতক্ষণে চার চোখের মিলন হলো! আমার ধৈর্য টৈর্য সব যাইতে বসছিলো।)

— চুপ করবা?

— আমাকে বলছেন?

একটু থমকে যায় লাভলী, তারপর খুব সহজভাবে বললো, "না, আপনাকে না।"

এই অপ্রত্যাশিত আর অদ্ভুত আলাপচারিতার পর দু'জনেই চুপ হয়ে যায়। লাল মাফলার আবারও আশপাশটা দেখে নেয়। তাকে চুপ করতে বলে নাই তাহলে কাকে বললো। দ্বিধায় পড়ে যায় ছেলেটা। লাভলীর অস্বস্তি বোধ হওয়া আবার ফিরে আসে। এটা সে কী করলো, মাথার ভিতরের লোকটার সাথে কথা বললো, একেবারে অপরিচিত এই ছেলেটার সামনে? এখন যদি ছেলেটা ভাবে ওর মাথায় গণ্ডগোল আছে। দেখতে খারাপ! আবার মাথাও খারাপ!! এই দুই জিনিস এক সাথে থাকলে সেই মানুষের সাথে কে কথা বলে! এখন যদি ছেলেটা বাপ বাপ বলে পালায় তাকে কি আর দোষ দেয়া যাবে?

— আমার মাথার ভিতরে একটা লোক আছে খুব যন্ত্রণা করে, তার সাথে মাঝে মধ্যে কথা বলি। আপনে কিছু মনে কইরেন না।

লাভলীর কথায় ছেলেটা লাজুক হাসলো, যেন মাথার ভিতরের লোকের ব্যাপারটা সে বুঝে ফেলেছে। কী একটু ভাবলো, তারপর সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে বেঞ্চের যে কোনায় লাভলী বসেছে তার অন্য কোনায় জড়োসরো হয়ে বসলো। লাভলী আর ছেলেটার মাঝখানে নির্জন বেঞ্চ আর বাদামের ঠোঙ্গা পড়ে থাকে।

আচ্ছা, ওর হচ্ছেটা কী আজকে? মাথার ভিতরের লোকটার কথা ও বিউটিকেও বলে নাই। একবারেই যে বলে নাই তা অবশ্য সত্যি না। বলেছিলো মনে হয়, কিন্তু বিউটি কোনো আগ্রহ দেখায় নাই। লোকটা কে, কেন, কীভাবে মাথার ভিতরে ঢুকলো এইসব কিছুই সে জানতে চায় নাই। জানতে চাইলেও লাভ হতো না, কারণ ও-ই জানে না — অন্যদের জানাবে কীভাবে।

যদিও লাভলীর সময়টা স্পষ্ট মনে আছে, রাত সাড়ে চারটা, অ্যালার্ম ঘড়িটা ক্রিং ক্রিং করে বিরামহীন ডেকে যাচ্ছে শান্ত দুপুরের ভিক্ষুকের মতো। এখনি ফরিদা খানমও দরজায় কিল দিতে শুরু করবেন, যখন ঘুমজড়ানো চেতনার সঙ্গে ও বলছে, সেহরি খাওয়ার জন্য উঠতে হবে, ঠিক তখন মাথার ভিতর থেকে লোকটা প্রথম কথা বললো, "আপুমনি, এতো রোজা রেখে লাভ কী, মটকা মেরে পড়ে থাকেন।"

কী ভীষণ ধড়ফড় করে উঠেছিলো ও; গায়ের প্রতিটা রোমকূপের খবর হয়ে গেছিলো। সেদিন তো বুঝতেই পারে নাই কথাটা কে বললো। ধরেই নিয়েছিলো স্বপ্ন দেখেছে। হ্যাঁ, স্বপ্নই হবে! লোকটার অস্তিত্ব মাথার ভিতরে নিশ্চিত করে টের পেলো রিয়াজের বিয়ের ঠিক একমাস দশ দিন পরে, আজ থেকে নয় বছর আগে।

— লোকটা কি সব সময়ই কথা বলে?

ছেলেটার প্রশ্নে অপ্রস্তুত বোধ করলো লাভলী। হঠাৎ কেমন গুটিয়ে গেলো। পুরো ব্যাপারটাই খুব খাপছাড়া ঠেকছে, যেন ওর জীবনে এইসব ঘটছে না আদৌ। এই যে দুপুর বেলা পার্কে বসে থাকা, বাদাম খাওয়া, পাতা ঝরার টুপটাপ শব্দ, শুকনো পথের চিহ্ন, টুকরো টাকরা কথা আর হাসির অস্পষ্ট ঝিলিক, এই যে এক হাত দূরে একটা সম্পূর্ণ অচেনা ছেলের বসে থাকা। নিজের অজান্তেই লাভলী নিজেকে চিমটি কেটে আনমনে উফ্ করে ওঠে।

( — আপুমনি, আপনের ব্যাপারটা আমি বুঝতেছি না, একজন ভদ্রলোক ভালো মনে আপনের পাশে এসে বসছেন, দুইটা সুখ-দুঃখের কথা বলবেন, আর আপনে ডুব মারছেন ফালতু চিন্তায়।)

— লোকটা কি এখন আপনের সাথে কথা বলছে?

লাল মাফলার তো সাংঘাতিক!

— না, না কেউ আমার সাথে কথা বলতেছে না, আমি এমনি বলছিলাম। আপনে নাকি পানিওয়ালা মেয়েটারে বলছেন, আমাকে কী বলবেন…। কী বলবেন?

— কিছু বলবো না, দূর থেকে দেখলাম আপনে হেঁটে এই বেঞ্চে এসে বসলেন। অন্য কোনোদিকে তাকালেন না। যেন এই বেঞ্চে এসেই আপনি সব সময় বসেন। আমি ভাবলাম আমি যে কারণে আসছি আপনি সেই।

— আপনে কী কারণে আসছেন? — আর আমি কে?

একটু থেমে লাভলী প্রশ্নটা শেষ করে আর তাতেই ছেলেটা কুঁকড়ে যায়। লাল মাফলারের চেহারা সাদা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এবার সে সত্যি সত্যি পালাতে পারলে বাঁচে। মাথা নিচু করে চোরের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এখন যদি সাট করে সরে পড়ে আশ্চর্য হবে না ও।

মাথার ভিতরের লোকটা সশব্দ হাসিতে ফেটে পড়ে। অপ্রত্যাশিত এই হাসির শব্দে কাপ থেকে চা ছলকে পড়ার মতো লাভলী বেঞ্চি থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো। ও নিশ্চিত হাসির শব্দটা ছেলেটা শুনেছে। কারণ হাসি শুরু হতেই সে চমকে লাভলীর দিকে তাকালো, তারপর আবার মাথা নিচু করে ফেললো। এই জীবনে আর মাথা তুলবে বলে মনে হচ্ছে না। আর তক্ষুনি লাল মাফলারের জন্য খুব মায়া লাগলো ওর। এই মায়ার সাথে ওর ভালোই পরিচয় আছে। আর সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই ওর ভয় করলো, কারণ এই মায়া সর্বনাশ করে ছাড়ে। লাল মাফলারকে এখন আরও অল্প বয়সী লাগছে। জড়তায় তার ঠোঁটজোড়া পর্যন্ত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

(– আপুমনি, ধরা খাইছে, দেখেন না কেমন কাহিল অবস্থা।)

— আপনে যা বলতে চান বলতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।

— না, মানে আমার বিরাট ভুল হয়েছে, আমি সরি। আমার এখন উঠে চলে যাওয়া উচিৎ… আপনি আজকের কথা মনে রাখবেন না প্লিজ।

— কী ভুল হইছে, কোন কথা মনে রাখবো না?

(– আরে বললাম না আপুমনি, ধরা খাইছে, কঠিন ধরা।)

বেশ জোরের সাথে এদিক ওদিক মাথা ঝাঁকালো লাভলী। যেন প্রবল ঝাঁকি দিয়ে মাথা থেকে লোকটাকে ফেলে দিতে চায়। "আর একটা কথাও না…!"

— আপনাকে বললে আপনি কষ্ট পাবেন, আমি যাই। ছেলেটা সটান উঠে দাঁড়ালো আর লম্বা লম্বা পা ফেলে উল্টোমুখী হাঁটা শুরু করলো। উঠে দাঁড়ানোর তাড়ায় লাল মাফলারটা ঘাড় থেকে চকিতে পড়ে গেলো। সাথে সাথে লাভলীর ভিতরে হাহাকার ছড়িয়ে পড়লো। বেঞ্চি থেকে পড়ি কী মরি নেমে লাল মাফলারটা হাতে নিলো।… কী নরোম আর আরাম!

( — এতো ভাবতেছেন কী আপুমনি, ডাক দেন, ডাক দেন…।)

মাথার ভিতরের লোকটার গলাও অদ্ভুত মরিয়া শোনালো।

— এই যে শুনেন… আপনের মাফলার।

ছেলেটা ঘুরে দাঁড়ালো, লাভলীও দাঁড়িয়ে — হাতের মুঠোয় লাল মাফলার, গায়ে জড়ানো শাল খসে পড়েছে — দুই বেণী আর কামিজের লম্বা ঝুল ওকে আরো মাটির কাছাকাছি এনে দিলো, চোখের হাহাকার দৃষ্টি কি ধরা পড়লো, নইলে ছেলেটা এতো সহজ ভঙ্গিতে ফিরে এলো কেন? নাকি, ছেলেটা জানতো পিছন থেকে সমস্ত প্রত্যাশা নিয়ে এইভাবে তাকে ডাকা হবে, সেজন্যই কি সে ইচ্ছা করে উঠে দাঁড়াবার সময় লাল মাফলার পথে ফেলে দিলো? কে জানে? এই প্রশ্নের জবাব কোনোদিন পাওয়া যাবে না।

লাভলী শক্ত মুঠিতে লাল মাফলার ধরে রইলো। কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। হাবে-ভাবে তাই মনে হয়। ছেলেটা এগিয়ে এসে লাভলীকে পিছনে ফেলে বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো। লাভলী বোকার মতো লাল মাফলার হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। এক সময় ও ধীরে এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চির কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। বসবে কি বসবে না মনস্থির করতে পারছে না। হঠাৎই শীতের দমকা হাওয়া ওকে আমূল নাড়িয়ে দিলো। নিজেকে এতো পলকা আর কখনও লাগে নাই। চকিতে বেঞ্চিটা ধরে ফেললো। একটা ঝাল মুড়িওয়ালা আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। সে এসে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই লাল মাফলার চোখ বাঁকিয়ে চলে যেতে ইঙ্গিত করলো। ঝালমুড়িওয়ালা কোনো কথা খরচ না করে ওদের সামনে থেকে দ্রুত সরে পড়লো। লাভলীর কেন যেন মনে হলো ঝালমুড়িওয়ালা লাল মাফলারকে ভয় পায়।

— বসেন।

— বাসায় যাবো।

— আপনার বাসা কোথায়?

— আমার বাসা…

— থাক্, বলার দরকার নাই।

লাভলী বেঞ্চিতে বসে পড়লো আর লাল মাফলারটা বেঞ্চির মাঝখানে রাখলো। এই কাপড়ের টুকরাটাই ওদের দু'জনের মাঝখানে যতি চিহ্ন হয়ে পড়ে রইলো। নিজের অজান্তেই লাভলী মাথা নিচু করে ভাবতে থাকে ও কেন বসলো, কী কথা বলবে, এই ছেলে ওর কাছে কী চায়, রমনা পার্কের দীঘিটা ঘিরে এই ছেলের হাত ধরে হাঁটলে কেমন লাগবে…। এত অল্প সময়ের মধ্যে তাও ভেবে ফেললো।

ফিরে আসার পর লাল মাফলারকে আর চেনা যাচ্ছে না। তার আগের জড়তা, ঠোঁট কাঁপাকাঁপি, লাজুক চাউনি এইসবের কিচ্ছু অবশিষ্ট নাই। এত দ্রুত কোনো মানুষ পাল্টে যেতে পারে? নাকি আগের হাব-ভাবই ভান ছিলো, সবই কোনো জটিল নাটকের অভিনয়কৌশল। লাল মাফলারটাকে খুব সহজে হাতে তুলে নিলো ছেলেটা আর এলোমেলো ভাঁজ করে কোলের উপর রাখলো। তারপর বেমক্কা একটা প্রশ্ন করলো যার জন্য লাভলী মোটেই তৈরি ছিলো না, এমনকি মাথার ভিতরের লোকটা পর্যন্ত না।

— আপনি কি আমার সাথে যাবেন?

— হ্যাঁ?

( — খাইছে!)

— আমার সাথে যাবেন, আমার ফ্ল্যাটে? — আমি একাই থাকি।

লাল মাফলারের বলার ধরনে এরকম অদ্ভুত প্রস্তাবও লাভলীর কাছে খুবই স্বাভাবিক শোনালো। যেন হরহামেশাই অচেনা মানুষজন ওকে তাদের বাসায় যেতে বলে আর এর মধ্যে বিন্দুমাত্র অপমানিত বা অস্বস্তি বোধ করার মতো কিছু নাই।

— আমাকে দুইটার মধ্যে বাসায় পৌঁছাতে হবে।

লাভলীর জবাবে ছেলেটা হেসে ফেললো, হাসির শব্দ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো বাতাস চিরে যায়। দূরে কারা যেন এই শীতের রোদে বাচ্চাদের সাথে করে পার্কে নিয়ে এসেছে। বাচ্চাদের হৈ চৈ-এর টুকরা-টাকরা গড়িয়ে চলে এলো ওদের কাছে। পৃথিবী আমূল বদলে গেলো। এ জগত ওর ভীষণই আটপৌরে, সিদাসাদা মনে হলো। ছেলেটার হাসিতে লাভলীর সঙ্কোচ কেটে যায়।

"দুইটার বেশি দেরি হলে আম্মা রাগ হবেন।" অল্প বয়সী মেয়ের গলায় ও কথাটা বলে।

— দু'টা তো অনেক আগে বেজে গেছে। এখন প্রায় আড়াইটা বাজে। আপনার আম্মা রাগ হলে কী করেন?

— আমাদের ঘরে ঢুকায়ে চাবি লাগায় দেন। অবশ্য আমাদের এখন আর অসুবিধা হয় না। আমাদের দুইজনের ঘরেই টেলিভিশন আছে। আমার চোদ্দ ইঞ্চি।

— আপনাদের দুইজনের মানে?

— আমার আর আমার বোনের।

— কতোক্ষণ চাবি লাগিয়ে রাখেন?

— ঠিক নাই। কখনও দুই তিন ঘণ্টা আবার কুনু সময় এক, দুই দিন। আম্মা চাবি খুলে খাবার দিয়ে যান, গল্পগুজব করেন, আমরা রাত্রে কী খাবো বা দুপুরে কী খাবো জিজ্ঞাসাবাদ করেন, কখনও পাশে বসে নাটক ফাটক দেখেন, তারপর আবার চাবি ঘুরায়ে চলে যান। একসময় আমরা টের পাই ঘর আর লক করা নাই। আমরা ঘর থেকে বার হই, আবার সব ঠিক। আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। আজকে বাসায় গেলে হয়তো চার পাঁচ দিন লক কইরা রাখবেন। লক করলে আম্মা দুই বোনের ঘরই লক করেন। বিউটি কিছু করুক বা আমি কিছু করি, যার কারণেই হোক না কেন দুইজনের ঘরেই চাবি পড়ে। ভালোই হয়, বাসার কাজ থিকা রেহাই পাওয়া যায়। কাপড় ইস্তারি করতে হয় না। খাই দাই আর টিভি দেখি। কেউ বাসায় বেড়াইতে আসলে আম্মা আলগোসে আমাদের দরজা খুইলা দেন। আমরা স্বাভাবিক ঘোরাফেরা করি আবার চইলা গেলে ঘরে ঢুকে যাই। আমাদের বাসায় বেশি লোকজন আসেও না। তাছাড়া তখন আমরা দুই বোনই খুব রূপচর্চা করি। মাথায় ডিম দেই, মেনদি দেই, কাঁচা হলুদ বাটা হাত পায়ে মুখে মাখি। রঙ পরিষ্কার হয়। আম্মা বুয়াকে দিয়ে এইসব করায়ে দেন। আমি এমনিতে রূপচর্চার ধার ধারি না, ভাল লাগে না, আইলসামি লাগে। কিন্তু ঘর লক থাকলে আমিও করি।

— তাহলে তো আপনার লাভই হয় বলা যায়।

— সেইটা ঠিক। তখন অনেক মজাও হয়। আম্মা আমাদের পছন্দের খাওয়া রান্ধেন। বাইরে থেকে গল্পের বই কিনা আনেন। আমাদের দিন কাটে আনন্দে।

সম্পূর্ণ একজন অচেনা মানুষের কাছে এক নিঃশ্বাসে ওদের পারিবারিক গোপন শাস্তিবিধান নির্দ্বিধায় বলে আশ্চর্য শান্তি পেলো লাভলী। এই প্রথম লাল মাফলারকে একটু বিচলিত দেখায়। ওর এতগুলি কথার মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে। কে জানে কোন পাগলের পাল্লায় পড়েছে, ফিরে আসার সীদ্ধান্তটা ঠিক ছিলো কি না এখন তার সেই চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু লাভলীর বোকা বোকা সরলতায় লাল মাফলার প্রবল আকৃষ্ট বোধ করছে। বাসায় নিয়ে যাওয়ার চিন্তা তাকে পেয়ে বসলো।

— আপনারা কখনও তালা ভাঙতে চেষ্টা করেন নাই?

— ক্যান, তালা ভাঙবো ক্যান? আম্মা তো আমাদেরকে কখনও বিনা কারণে তালা মারেন না। আমরা এখন আর মাইন্ড করি না।

তারপর লাভলীকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় ওর কিছু একটা মনে পড়ে গেছে। মনে পড়ায় লজ্জাও পায়। নিজের অজান্তেই জিহ্বায় কামড় দেয়। লাল মাফলার ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো, এই কিসিমের মহিলা সে আগে কখনও দেখে নাই।

— কী চিন্তা করেন?

— না কিছু না…।

— আপনার আব্বা আছেন?

— হ্যাঁ, আব্বার শরীর বেশি ভালো না।

— আপনার আম্মা যে আপনাদের তালা দিয়ে রাখেন, তিনি কিছু বলেন না?

— এইটা আপনে কী বললেন? আম্মা তো আমাদেরকে তালা দিয়া রাখেন না। যখন আমরা কিছু উল্টাপাল্টা করি তখন আর উপায় কী। এই যেমন আজকে, আমার দুইটার সময় বাসায় যাওয়ার কথা, যাবো কখন আল্লায় মালুম। তাইলে আপনেই বলেন আম্মা আমাদেরকে তালা দিবেন না তো কী করবেন, কোলে নিয়া বইসা থাকবেন? আব্বাকে তো আম্মা তাই বলেন, তালা দিবো না তো কী করবো, কোলে নিয়া বইসা থাকবো?

— একটু আগে কী চিন্তা করছিলেন?

— যখন আমাদের ঘর তিন চার দিন তালা মারা থাকে, তখন আমরা এক বোন আরেক বোনের কাছে বেড়াইতে যাই। আমাদের খুব মজা হয়।

— বেড়াতে যান মানে? আপনারা এক বাসায় থাকেন না?

— হ্যাঁ থাকি, কিন্তু দুইজনের রুম তো দুইটা। আমি আম্মাকে ডেকে বলি যে আমি বিউটির বাসায় বেড়াইতে যাইতে চাই। আপনাকে বলা হয় নাই, বিউটি আমার বোনের নাম। আম্মা তখন দরজার কাছে এসে আমাকে রেডি হইতে বলেন। আমি রেডি হই। তারপর আম্মাকে বলি যে আমি রেডি। তখন আম্মা দরজা খুলে দেন, আমি আর আম্মা বিউটির ঘরে যাই। কখনও আমি আম্মা দুইজনে, কখনও আমি একা।

— বিউটির বাসায় মানে ঘরে গিয়ে কী করেন?

— প্ল্যান করি, প্ল্যানটা আপনেরে বলা যাবে না। ওইটা আমার আর বিউটির একটা খেলা; তবে আম্মা যদি সাথে যায়, তাইলে এমনি এইটা সেইটা গল্প করি। অন্যদেরকে নিয়া হাসাহাসি করি। বিউটি অনেক খাতিরযত্ন করে। চা খাওয়ায়, নাস্তা। আমার বাসায় আসলে আমিও আদর করি।

— নাস্তা দেয় কীভাবে, ঘর তালা দেয়া না?

— আম্মা নিয়া আসেন, বিউটি আমাদের বেড়ে টেড়ে দেয়। খুব ভালো লাগে। এইটাও আমাদের একটা খেলা। আম্মা খেলাটায় খুব মজা পান, এইটা খেলতে কখনও মানা করেন না।

— আপনার আব্বা খেলেন না?

— না, না… এইটা হচ্ছে মেয়েদের খেলা। আব্বা খেলেন না। আব্বার শরীর ভালো না।

— চলেন আমার বাসায়। আমিও আপনার সাথে খেলাটা খেলতে চাই।

মাথার ভিতরের লোকটা আশ্চর্য রকম চুপ করে আছে। টু শব্দ পর্যন্ত করছে না। ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গেছে কি না কে বলতে পারে? এবার সে একটু নড়েচড়ে বসলো।

( — আপুমনি, লোকটার বাসায় চলেন যাই, খাতির টাতির করবে মনে হয়।)

লোকটার কথায় প্রবল আপত্তি জানায় লাভলী, নিজের অজান্তে শিউরে ওঠে।

— না, না আম্মা জানলে জানে মেরে ফেলবেন।

( — আম্মা জানবেনটা কেমনে, আরে… আজকে এসপার ওসপার এমনিই হবে। হবেই যখন ভালো মতোই হোক।)

লোকটার কথার জবাব দিতে গিয়েও চুপ মেরে যা‍য় ও, লাল মাফলার ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস নিয়ে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে। অথচ আধ ঘণ্টা আগে এই ছেলেটাকেই লাভলীর মনে হচ্ছিলো ভীরু ভীরু গোবেচারা টাইপের, যেন ভাজা মাছও উল্টে খেতে জানে না। এখন কেমন চোখে মুখে চালিয়াতি খেলে বেড়াচ্ছে। ভান, সবই ভান।

লাভলী লোকটার কথার উত্তর দিবে, না লাল মাফলারের সাথে রওয়ানা হবে বুঝে উঠতে পারছে না। ছেলেটার পিছে পিছে ওর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে এটা ঠিক। যেকোনো কোথাও। একেবারে কোথাও যদি নাই যাওয়া যায়, — তাহলে অন্তত সামনের দীঘীটার পাড় ঘেঁষে হাঁটতে পারে দু'জনে। ক্ষতি কী!

— আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনারা দু'জন আগে কথা শেষ করেন, আমার কোনো তাড়াহুড়া নাই।

— আমি কারও সাথে কথা বলতেছি না।

— আপনার মাথার ভিতরের লোকটার নাম কী?

— নাম নাই।

— নাম নাই?

— নাম নাই।

— আপনি একটা নাম দিয়ে দেন।

— আমার মাথার ভিতরে কেউ নাই।

লাভলীর চোখে পানি চলে এলো। কোথা থেকে, কেন তার হদিস ওর জানা নাই। ওর মনে হলো লাল মাফলার ওর সাথে ইয়ার্কি মারছে। পাগলের পিছনে বাচ্চারা যেভাবে পাগলি পাগলি বলে দৌড়ায় সেই একই নিষ্ঠুরতায়। বাচ্চারা যদিও টের পায় না কতোটা নিষ্ঠুর তারা হচ্ছে, কিন্তু লাল মাফলার কি পায়?

— আচ্ছা, আমি গিয়ে দু'টা সিগারেট নিয়ে আসি। আপনারা এর মধ্যে ঠিক করেন আমার সাথে যাবেন কি না? কোনো জোর জবরদস্তি নাই। খুশি মনে যাওয়া।

ছেলেটা উঠে দাঁড়ালো আর সঙ্গে সঙ্গে লাভলী নিশ্চিত হয়ে যায় সে আর ফিরে আসছে না। প্রবল ইচ্ছা হয় বলতে, 'হ্যাঁ যাবো। আমার কারও সাথে কথা বলে ঠিক করার দরকার নাই। আমি যাবো।' কিন্তু অনিবার্যভাবেই বলা হয় না। লাভলীর ইচ্ছা কবে আর ডালপালা মেলেছে।

লাল মাফলার লম্বা লম্বা পা ফেলে রমনা অরণ্য পেরিয়ে গেলো। মাথার ভিতরের লোকটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে উশখুশ করছে কথা বলার জন্য, এবার আর না বলে পারলো না।

( — এরকম সুযোগ আর পাবেন না আপুমনি। হাত দিয়া আর কতো দিন? চলেন যাই, কী হবে? এই লোক খুন জখম করার লোক না।)

— কেমনে জানো?

( — জানি আপুমনি, যাওয়ার জন্য আপনে ছটফট করছেন। ভালোবাসা কী তা তো জানলেনই না। একটা সুযোগ যখন আসছে, মন দিয়ে, শরীর দিয়ে জানেন।)

— ভালোবাসা কী আমি জানি না, এইটা কী বললা তুমি? আমার এখনও পরান পুড়ে।

( — সরি আপুমনি, সরি। ভুল হইছে। অবশ্যই জানেন, কিন্তু শরীরের ভালোবাসা? সেও কিছুটা জানেন যদিও — কিন্তু একটা আস্তো জীবন কাটায় দিয়ে একদিন মরেও যাবেন — অথচ আসল শরীরী ভালোবাসা কী জিনিস তা জানবেন না। এইটা কিছু হইলো? মনে করেন, উপরওয়ালাই আপনাকে সুযোগ করে দিছে।)

— তওবা তওবা, না না — আমি কখনও এই কাজ করতে পারবো না। তোমার কথায় পইড়া অনেক বেশরমের কাজ করছি। আম্মা…।

( — আরে থোন ফালায়ে আম্মা। এইখানে আম্মার ধার কে ধারে! আমার কথায় পড়ে অনেক বেশরমের কাজ করছেন, — এই কথা কি ঠিক বললেন? রসময় গুপ্ত কি আমি এনে দিছি? আমি শুধু বলছি হাত কাজে লাগান। তবে আপুমনি দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মিটে? সেই জন্যই বলতেছি চলেন…।)

— আমি সব সময়ই জানতাম তোমার সাথে কথা বলা আমার ঠিক না, বিপদ হবে একদিন, মস্ত বিপদ।

( — তাহলে এইখানে সময় নষ্ট করে লাভ কী, বাসায় চলেন। আজকে এমনিতেও আম্মা আপনাকে কিছুই জিজ্ঞেস করবেন না। কোরবানীর গরুর মতো ভালো মতন খাওয়ায় দাওয়ায় রুমে পাঠায় দিবেন আর আলগোছে দরজা লক করে দিবেন। তখন না হয় আস্তে ধীরে দুইজনে যুক্তি করে ঠিক করবো নে কী বলা যায়।)

— আচ্ছা, তোমার নাম কী? উনি জিজ্ঞেস করতেছিলেন।

( — উনিটা কে?… ও আচ্ছা, ব‍‍লেন নাম নাই।)

— আমিও তাই বলছি। — চল্লিশ বছর বয়স হলো আমার আজকে। চল্লিশ বছর! চিন্তা করতে পারো।… তুমি ঠিকই বলছো আমি যাবো তার সাথে। তার হাত ধরে বলবো আমারে নিয়ে যান। শুধু একবার আমি জানতে চাই কেমন লাগে?

( — আমিও। তবে হাতও মন্দ না। মনে পড়ে আপুমনি প্রথম দিনের কথা? আপনে, বিছানা, ঘর — সব থরথর করে কাঁপলো।)

হ্যাঁ, মনে পড়লো লাভলীর, সমস্তই মনে পড়লো। সঙ্কোচে লজ্জায় না কি শরীরী আনন্দে মুখ লাল হলো! লালে লাল দুনিয়া! আম্মাগো লাল তেরি লাল কেয়া খুনিয়া!

দুপুর তিনটার দিকে রিয়াজ সেদিন লাভলীদের বাসায় এসে উপস্থিত। রিয়াজ বাসায় আসলে ফরিদা খানম আর আগের মতো ততোটা খুশি হন না। শুকনা গলায় জানতে চাইলেন, দুপুরে খেয়ে এসেছে কিনা। রিয়াজ জানালো সে খেয়ে এসেছে। ফরিদা খানম তার চাইতেও শুকনা গলায় জানতে চাইলেন তাহলে আসার কারণ কী। রিয়াজ গোবেচারা মুখ করে বললো লাভলী আর বিউটির জন্য সে নোটস নিয়ে এসেছে। লাভলী আর বিউটি তখন প্রাইভেটে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওদের গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়ার একটা কলেজে নামমাত্র ভর্তি হয়ে আছে ওরা দুইজন। পরীক্ষার সময় শুধু গ্রামে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতে হবে। ফরিদা খানম নোটস দেখতে চাইলেন, রিয়াজ ঝোলা থেকে ভূগোল সেকেন্ড পেপারের নোটস বের করে দিলো। নোটস দেখে ফরিদা খানমের মুখে এঁটে বসা কঠিন রেখাগুলো আলগা হতে শুরু করলো এবং এক সময় মিলিয়ে গেলো। একটু আগের কঠিন ব্যবহারের জন্য তাকে একটু সঙ্কুচিতও মনে হলো। ঘরে পাতা দই নিজের হাতে এনে রিয়াজের হাতে দিলেন।

— নোট ফোট দিয়া লাভ নাই। পড়াশুনা এগুলার হবে না। বেহুদাই কষ্ট।

সেদিন নোটের সাথে জীবনের প্রথম লাভলীর হাতে এলো ২টা রসময় গুপ্ত। শরীরী আঁকিবুঁকির খুঁটিনাটি গোগ্রাসে গিললো। পড়তে পড়তে নিজের শরীর একেবারেই নিজের বশে ছিলো না। এই বই যক্ষের ধনের মতো কোথায় যে লুকাবে ও তার কুল কিনারা করতে পারছিলো না। রক্তে আগুন ধরে যাওয়া এমন বৈকল্য আর না জানা আবেশ কিছুতেই একা একা ভোগ করতে লাভলীর ইচ্ছা করলো না। কিন্তু ও বড় বোন হয়ে ছোট বোনের হাতে এই বই কীভাবে তুলে দেবে? আবার এটাও মনে হলো বই দু'টা লুকিয়ে রাখার একটা ব্যবস্থা বিউটি অবশ্যই করতে পারবে। রিয়াজের কাজ গুছানো, বইগুলা ছিলো নোট বইয়ের মলাটে ঢাকা।

ফরিদা খানম যখন গোসল করতে গেলেন, লাভলী বিউটির ঘরে উঁকি দিলো, বিউটি গভীর মনোযোগে রিমুভার দিয়ে নেল পলিশ তুলছে। বই দু'টা ও বিউটির সামনে টেবিলের উপর রাখলো।

— আমি তো বলে দিছি আমি পরীক্ষা দিবো না। নোট বইসহ ঘর থিকা বিদায় হও। আপা, আম্মারে বলছি আমারে একটা ভিসিআর কিনা দিতে, আম্মা রাজি হইছেন। তবে পরীক্ষার পরে।

— তোরে কিনা দিবে মানে?

— আমারে কিনা দিবে মানে আমারে কিনা দিবে, আমার ঘরে থাকবে ভিসিআর। তোমরা যখন খুশি আমার ঘরে সিনেমা দেখতে পারবা।

— আমার ঘরে থাকবে না কেন?

— তোমার ঘরে থাকবে না কারণ ভিসিআর কিনার বুদ্ধি তোমার না আমার। তোমার ঘরে থাকার আরেকটা অসুবিধা আছে…।

— কী অসুবিধা?

— মাসের তিরিশটা দিনের মধ্যে বত্রিশটা দিনই তো তুমি মাথাব্যথায় ঘর অন্ধকার কইরা পইড়া থাকো। তখন আমাদের হবে বিপদ, লেটেস্ট হিন্দি সিনেমা দেখা আসমানে উঠবে, তার বদলে দেখতে হবে চিৎ কুমারী।

— আমি চাইও না আমার ঘরে… আচ্ছা, তুই যা চাস আম্মা তাই কেন তোরে কিনা দেন?

— আম্মা আমারে ভয় পান। আমি যখন ঘাড় গোঁজ কইরা তর্ক করতে থাকি তখন আমারে ডরান।

— তোর এত বুকের পাটা কোত্থিকা হইলো?

— বুকের পাটা আবার কী, এইটা সহজ হিসাব… আমি তার কথা শুনবো আমার আরাম আয়েস তিনি দেখবেন।… ডরে তুমি চিকা হয়ে থাকো কেন আপা? ঘরের ভিতরে আমরা খুশিমতো চলবো, বুঝলা…।

— বুঝলাম।

বললো বটে তবে লাভলী আসলেই ঘরের ভিতরে এতটুকু হয়ে থাকে। ফরিদার সাথে তর্ক করা তো দূরের কথা দ্বিমত পোষণ করার মতো সাহসও ওর নাই।

বইগুলি টেবিলের উপর পড়ে রইলো, লাভলী ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিউটি টেবিলের সামনের চেয়ারটায় এক পা তুলে বসেছে আর ঘাড় গুঁজে নেলপলিশ তুলছে। ঘাড় গুঁজেই সে বিস্তর কথা অনেকটা আপন মনে বলে গেলো। লাভলী বেরিয়ে যাবার জন্য পিছন ফিরতেই সে আবারো মাথা না তুলে বললো, "নোট বই দুইটা নিয়া যাও আপা। বললাম না আমার লাগবে না।"

— এই দুইটা নোট বই না।

ঘাড় না তুলে চট করে শুধু চোখের পাতা উপরে তুলে তাকালো বিউটি কিন্তু কোনো কথা বললো না। পরেও রসময় গুপ্ত লাভলী কোথায় পেয়েছে, কে দিয়েছে কখনও জানতে চায় নাই। অবশ্য বই দুটা সে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সেটা বলেছে। একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে জানালার উপরের কার্নিশে রেখেছে। বইয়ের সাথে ভারি একটা ইটও ঢুকিয়ে দিয়েছে যাতে তুফানের সময়ও পড়ে না যায়। ইট যোগাড় করেছে কাজের ছেলে হারুণ আর জানালার কার্নিশের উপর রাখার দায়িত্বটাও তারই ছিলো। বিউটির কাজ সব সময়ই পাকা।

মনস্থির করে অপেক্ষা করছে লাভলী আর সেই ফাঁকে নানান ভাবনা মাছির মতো ভনভন করছে মাথার ভিতরে। সময় থেমে গেছে। কোথাও টু শব্দ নাই, এমনকি এই শীতের অপরাহ্নে পাতা ঝরার টুপটাপও না। পাশের বেঞ্চির মাথা-মালিশওয়ালা লোকটা কখন চলে গেছে, যাকে মালিশ করা হচ্ছিলো সে এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। দুপুরের নিস্তব্ধতা মৃত্যুর মতো ছেঁকে ধরলো লাভলীকে। ওর মনে হলো এই সব শেষ, আর কোনোদিন কোনো ভালোবাসার চাউনি ওর শরীরকে স্পর্শ করবে না। ওর প্রতিটা রোমকূপ হাহাকার করে উঠলো। ওর ঘুমন্ত অনুভূতি ঘাই হরিণীর মতো প্রচণ্ড বিক্রমে ওর পাঁজর এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেললো। লাভলী পাঁজরভর্তি হতাশা আর ক্ষুধা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

অরণ্য ভেদ করে লাল মাফলার হাওয়ায় দুলছে। দুলুনি আস্তে ধীরে বড় হচ্ছে… ছেলেটাকে দূর থেকে খুব শুকনা দেখালো, যেন হাওয়ায় ভাসছে, ভাসতে ভাসতে আসছে। ফিরে তাহলে আসছে, জীবনে এই প্রথম লাভলীর নিজেকে নারী মনে হলো। একটা মেয়ের অমোঘ আকষর্ণে একটা ছেলেকে ফিরতেই হবে — এই জাতীয় ভাবের উদয় হলো মনে; ওর মন তো ঠিক করাই আছে। ও যাচ্ছে ছেলেটার সঙ্গে।

(কিস্তি ৪)
রচনাকাল: ২০০৮, লন্ডন

অলঙ্করণ: রনি আহম্মেদ