হাসিনা-মনমোহন শীর্ষ বৈঠক : সাধারণের প্রত্যাশা

মোহাম্মদ সেলিম
Published : 6 Sept 2011, 08:10 AM
Updated : 6 Sept 2011, 08:10 AM

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়। রাজনীতিবিদ, একাডেমিশিয়ান বা সাধারণ জনগণ সবারই এ বিষয়ে একটা মতামত বা প্রতিক্রিয়া আছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমন্ত্রন বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে দৈনিক পত্রিকা, বিভিন্ন টি.ভি. চ্যানেলে দু'দেশের সম্পর্কের নানা ইস্যু নিয়ে বিশেষ সংখ্যা, প্রতিবেদন, নিবন্ধ, সম্পদকীয় প্রকাশ করছে। এই সফর উপলক্ষে হাসিনা-মনমোহনের সময়কালে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটা মূল্যায়ন করার চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি ভারত সফর করেন। ওই সময়ে দু'দেশের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যৌথ ইশতেহার নতুন মাত্রা যুক্ত করে। বিশেষভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এরকম সহযোগিতামূলক মনোভাব দু'দেশের সরকারের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় নি।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের চার দশক সময়কালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বহু চড়াই-উৎরাই লক্ষ করা যায়। তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের উত্তরসূরি হিসেবে বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই কিছু দ্বিপাক্ষিক সমস্যা লাভ করে। আবার কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীনতার পর।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে দু'দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে সম্পর্কের সূচনা হয়। কিন্তু দু'দেশের সৌহার্দ-বন্ধুত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে জাতীয় স্বার্থে ইতিবাচক সম্পর্ক উভয়ের জন্যই কল্যাণকর।

দক্ষিণ-পূর্ব কোনে মায়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত ব্যতীত বাংলাদেশ সামগ্রিক অর্থে 'ভারত-পরিবেষ্টিত (India-locked) একটি রাষ্ট্র। এধরনের ভৌগোলিক অবস্থানের বাধ্যবাধকতার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে 'ভারত উপাদান' (India Factor) গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সঙ্গে নানা বিষয় যুক্ত হয়ে এটাকে জটিল করে তুলেছে। ইতিহাস, ভুগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি নানা বিষয় দু'দেশের সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতিমালা অনুযায়ী "জাতীয় স্বার্থই প্রতিটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে।" বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের বা ভারতের সঙ্গে ভিন্ন রাষ্ট্র সমূহের সম্পর্ক হয়তো এভাবে বিশ্লেষণ সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আবেগগত ও আদর্শগত বিষয়কে অস্বীকার করে দু'দেশের সম্পর্কের যথাযথ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়তো সম্ভব নয়। আবেগগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় বসবাসকারী বাঙালি জনগোষ্ঠীর কারণে। দু'দেশের সম্পর্কের আবেগ আর আদর্শগত ভিত্তি স্থাপিত হয় একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় উদার, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের কারণে। ফলে দু'দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যায়।

ফারাক্কা সমস্যা, সীমান্তে গোলাগুলি, সমুদ্রসীমা বিতর্ক, দক্ষিণ তালপট্টির মালিকানা সমস্যা, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ইত্যাদি। সমস্যাগুলো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে তিক্ত এবং উত্তেজনাকর অবস্থায় নিয়ে গেছে। বাংলাদেশে সামরিক বা আধা-সামরিক সরকারের শাসনামলে এমনি উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত বিরোধিতাকে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছিল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য। অন্তিমে সম্পর্কের অবনতি ছাড়া কিছুই অর্জণ করা যায় নি। বাস্তবতা হলো ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে যত রাজনীতি হয়েছে, সমাধানের চেষ্টা করা হয় নি তেমন। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সর্বনিম্ন ৪৪,০০০ কিউসেক হতে সর্বোচ্চ ৪৯,৫০০ কিউসেক পানি পায়। যা পরবর্তী কোনো সরকারের আমলে আর পায় নি।

দেশ, আঞ্চলিক রাজনীতি, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সব কিছু বদলে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিটি রাষ্ট্র খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও একটা গুনগত পরিবর্তণের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিশেষ করে গত দু'দশকে এই পরিবর্তন ক্রমে মূর্ত হয়ে উঠছে। শেখ হাসিনার ২০১০ সালের ভারত সফর, দু'দেশের সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বলেন, "Relations with Bangladesh are of the highest priority for India. India stands ready to be a full and equal partner in the realization of your vision of social change and economic development for Bangladesh." সফর শেষে ৫০ অনুচ্ছেদের যৌথ ইশতেহার প্রকাশিত হয়। এর বাইরে দু'দেশের মধ্যে পাঁচটি চুক্তি সম্পাদন হয়। ভালো ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন যথাযথ বাস্তবায়ন।

গত এক বছর আট মাসে যৌথ ইশতেহারে বাস্তবায়নে এক ধরনের ধীর গতি লক্ষ করা যাচ্ছে। কাঙ্খিত অগ্রগতি না হওয়ার জন্য অনেকে ভারত সরকারকে দায়ী করে থাকেন। ইতোমধ্যে দু'দেশের কর্মকর্তা, মন্ত্রী পর্যায়ে অনেকগুলো বৈঠক হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। ১ বিলিয়ন (৪৫০০ কোটি রুপি) ডলারের ঋণচুক্তির আওতায় রেলওয়েসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি, সীমান্তে মানুষ হত্যা হ্রাস, সীমান্ত হাট চালু, সীমান্তে যৌথ জরিপ, ইছামতি নদীতে খনন, এছাড়া বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা ও তিস্তা এবং ফেনী নদীর পানি বন্টনে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে।

বাংলাদেশের নিকটতম ও বৃহত্তম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আয়তন, জনসংখ্যা বা অর্থনৈতিক অবস্থা– কোনো ক্ষেত্রেই তুলনা হয় না বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের। কেবল আঞ্চলিক পর্যায়ে নয়, বৈশ্বিক রাজনীতিতেও ভারত ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক আমরা চাই। একই সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে নিষ্পন্ন করতে আগ্রহী। উভয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়ে যৌথ ইশতেহারের ১৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, "The territory of either would not be allowed for activities inimical to the other and resolved not to allow their respective territory to be used for training, sanctuary and other operations….. বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে নিরাপত্তার প্রশ্নে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। ভারতের সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে সব রকমের সহায়তা প্রদান বন্ধ করেছে। এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার এবং হস্তান্তরও করছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশের কোনো সরকারই এমনি দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নি।

ভারতের দিক থেকে ট্রানজিট-ই একমাত্র দাবী বাংলাদেশের কাছে। বিএনপি বা চারদলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলো ট্রানজিটের বিপক্ষে। তাদের মূল বক্তব্য ট্রানজিট দিলে সার্বভৌমত্ব থাকবে না। বর্তমান বিশ্বে ট্রানজিট দেওয়ার বহু নজির আছে এবং ট্রানজিট প্রদানকারী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হয়েছে এমন উদাহরণ নেই। দেশের সাধারণ মানুষ এই বক্তব্য সমর্থন করে বলে মনে হয় না।

মনোযোগ দেবার বিষয় হলো, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জণে আঞ্চলিক উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ বা connectivity অপরিহার্য। ভারত, নেপাল, ভুটান– তিনটি রাষ্ট্র নিয়েই যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোনভাবেই এটি দ্বিপাক্ষিক সুবিধার বিষয় হবে না। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাব আছে তা অস্বীকারের জো নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে সাহসী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রানজিটের পক্ষে।

ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান নিঃসন্দেহে এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কিন্তু রাজনীতি প্রভাবিত সিদ্ধান্ত হলে চলবে না। ট্রানজিটকে আমরা সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয় হিসেবে দেখতে চাই। অন্য দিকে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষির শেষ হাতিয়ার ট্রানজিট স্বচ্ছ জবাবদিহি প্রক্রিয়ায় ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিষ্পন্ন করতে হবে। দুঃখজনক হলো ট্রানজিট বিষয়ে সরকার সুনির্দিষ্টভাবে কী করতে যাচ্ছে দেশের জনগণ তা জানে না। বরং কর্মকর্তা, মন্ত্রী, উপদেষ্টাদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতি – অর্থনীতিতে এমন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গত চার দশকে আসে নি। তাই ট্রানজিট নিয়ে সংসদে মুক্ত আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। বাস্তবে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোতে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয় নি। এমনকি মন্ত্রি পরিষদেও কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে বলে জানি না। বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি বিবেচনায়ই নেয় হয় না। আলোচনা না করার রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে কেন আমরা যেতে পারছি না?

বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র এবং দুর্বল রাষ্ট্রের পক্ষে ভারতের ন্যায় শক্তিশালী নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে এক ধরনের বৈরী সম্পর্ক বজায় রাখা আমাদের সামর্থ্যরে মধ্যে পড়ে কি না তা নির্মোহভাবে পর্যালোচনার সময় এসেছে। উভয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা অপরিহার্য। কারণ বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের কাছেও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্ব অস্বীকারের উপায় নেই। কারণ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি ভূ-বেষ্টিত রাজ্য ভূখন্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। ১৬/১৭ মাইল প্রস্থের শিলিগুড়ি করিডোর যোগাযোগের একমাত্র উপায়। তাই ভারতের নিজের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগ দিতেই হবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে দু'দেশের সব সমস্যার সমাধান কেউ প্রত্যাশা করে না। তবে ২০১০ সালে সম্পর্ক উন্নয়নের যে ধারা সূচিত হয়েছে বর্তমান সফরে বস্তুগত কিছু অর্জন না হলে তা বাংলাদেশের মানুষকে আশাহত করবে। দু'দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের সুফল যাতে প্রান্তিক মানুষও পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। দু'দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। এই যোগাযোগের পথে অন্তরায়গুলো দূর করতে হবে। সীমান্তে মানুষ হত্যা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। ভিসা ব্যবস্থা সহজতর করতে হবে। দু'দেশের মানুষকে পরস্পরের কাছে যাবার পথ করে দেয়া দরকার। বন্ধুত্ব জোর করে হয় না, তা স্বত:স্ফুর্তভাবেই হয়ে থাকে।

মোহাম্মদ সেলিম: গবেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান।