হেমলক সোসাইটি!

জীহান রানা
Published : 28 Oct 2017, 01:12 AM
Updated : 28 Oct 2017, 01:12 AM

কাউন্সেলর-কাউন্সেলিং, সাইকিয়াট্রি-সাইকিয়াট্রিস্ট,সাইকোলজি- সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপি-সাইকোথেরাপিস্ট এবং আরও অন্যান্য কিছু ব্যাপারে আজ আলোচনা করবো।
প্রথমেই অতি আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে হেমলক সোসাইটি গ্রুপটি খোলার পর ইতিমধ্যে এতো অল্প সময়ে আমাদের কাছে মানসিক সমস্যা নিয়ে যারা এসেছেন, তাদের মধ্যে শতকরা ৯৫% মানসিক সমস্যায় ভুক্তভোগী ব্যক্তি সমাধান পেয়ে বর্তমানে আগের থেকে ভালো আছেন। হেমলক সোসাইটির নীতিমালা অনুযায়ী ভিকটিমের সকল প্রকার তথ্য গোপন রাখায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকায় আমরা সরাসরি তাদেরকে আপনাদের সামনে আনতে পারছি না। তবে কোন ভিকটিম যদি সুস্থ হয়ে সরাসরি গ্রুপে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চায় তবে অবশ্যই তাকে আমরা আপনাদের সামনে হাজির করবো।

কিন্তু পাশাপাশি একটা ব্যাপার ইদানিং উঠে আসছে যে, হেমলক সোসাইটিতে কাউন্সেলর হিসেবে কর্মরত যারা আছেন, তারা কি প্রোফেশনাল কাউন্সেলর বা তারা কি সাইকোলজির উপর পড়াশোনা করে এসেছেন কিংবা তাদের এসব কাজের লাইসেন্স আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতেই আজ লিখতে বসা।

প্রথমেই আমরা কাউন্সেলর-কাউন্সেলিং, সাইকিয়াট্রি-সাইকিয়াট্রিস্ট,সাইকোলজি- সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপি-সাইকোথেরাপিস্ট সম্পর্কে বেসিক কিছু জানবো। মানুষের মানসিক প্রক্রিয়া যেমন: চিন্তা, আবেগ, সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া, স্মৃতি, আচার-আচরন নিয়ে যে বিজ্ঞান কাজ করে তা সাইকোলজি। সাইকিয়াট্রি (Psychiatry) মেডিসিনের একটি শাখা, যা মানসিক অসুস্থতা নিরূপণে কাজ করে। Psychiatry'র -iatry এর অর্থ "medical treatment' আর Psychology 'র -logy এর অর্থ 'science" বা "theory'। সুতরাং মনের সমস্যার মেডিকেল ট্রিটমেন্ট হল সাইকিয়াট্রি আর মনের 'কাজ এবং ব্যাবহার' নিয়ে যে বিজ্ঞান তা হল সাইকোলজি। মানসিক রোগের মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা দেয়া কে সাইকোথেরাপি (Psychotherapy) বলে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এটুকু বুঝতে পারি যে একজন সাইকোলজিস্ট মনোবিজ্ঞানের সাহায্য একজন ভিকটিমের সমস্যা চিন্হিত করে তার সমাধান দিতে পারেন। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট সমস্যা সমাধানের জন্য মেডিসিন সাজেস্ট করতে পারেন। আর একজন সাইকোথেরাপিস্ট মনোবিজ্ঞান দ্বারা উদ্ভাবিত বিভিন্ন উপায়ে ভিকটিমকে সরাসরি চিকিৎসা দেবে। অনেকটাই কাউন্সেলিং এর মতোই সাইকোথেরাপির চিকিৎসা ক্ষেত্রে মেডিসিন ব্যবহার করা হয় না। তবে সাইকোথেরাপি হয় অনেকটা সিস্টেমেটিক পন্থায়।

এবার আসি কাউন্সেলিং এর ক্ষেত্রে। কাউন্সেলিং বলতে কী বোঝায় বা কাউন্সিলিং ব্যাপারটা কী? সচরাচর যারা কাউন্সেলিং করেন তাদের আমরা কাউন্সেলর বলে থাকি। কাউন্সেলর একজন ব্যক্তির একটি নির্দিষ্ট সমস্যার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেন এবং ওই ব্যক্তির চিন্তাধারা বদলে দিতে ভূমিকা রাখেন। জীবনের এমন কোনও সমস্যা যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না, যার সমাধানের কথা ভেবে কূল-কিনারা হারিয়ে ফেলছি, যখন মনে করছি শেয়ার করলেই হয়তো ভালো লাগবে, যখন দেখছি জীবনের সমস্যা আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করছে এবং আমি নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি তখন আমরা সমাধানের জন্য বিশেষ ক্ষেত্রে একজন কাউন্সেলরের কথাই ভাবি। কারণ একজন কাউন্সেলরের প্রথম কাজই হলো ভিকটিমের সমস্যা খুব মন দিয়ে শোনা, তাকে যথেষ্ট পরিমাণ কম্পানি দেয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সমস্যার ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে তার চিন্তাধারা বদল করে আগের অবস্থা থেকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আপনার জীবনের অনেক কাছের মানুষটি আপনার কাউন্সেলরের ভূমিকা পালন করতে পারেন। আবার এমন কোনও পরিচিত মানুষ আছেন, যার সঙ্গে কথা বললেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে, জীবনের জটিল কোনও সমস্যায় এমন সব কাছের বিশ্বস্ত মানুষ পারে কাউন্সেলরের কাজ করতে। এমনকি সন্তানের জন্য অভিভাবকরা নিজেরাই একজন কাউন্সেলরের ভূমিকা পালন করতে পারেন। কারণ একজন সন্তান সম্পর্কে একজন মা বা বাবা ভালো বলতে পারবেন বা বুঝবেন। তবে কাউন্সেলিং করতে অবশ্যই নিজেকে স্থির থাকতে হবে, ভিকটিম যতোই উত্তেজিত থাকুক, কাউন্সেলর নিজে ঠান্ডা মাথায় স্থির থেকে কেইস হ্যান্ডেল করবে।

কিন্তু কথা হলো একদল জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ বলছেন কাউন্সেলিং এর এই দায়িত্ব নাকি সবাই নিতে পারবে না। মনবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক ও মাস্টার্স শেষ করে আরও ৪ বছর চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়ে সাইকোলজিস্ট হয়ে এসব ব্যাপার হ্যান্ডেল করবেন। এমবিবিএস কোর্স শেষ করে আরও ২বছর মানসিক রোগ এবং এই সম্পর্কিত চিকিৎসা বিষয় নিয়ে পড়ার পর Psychiatrist হয়ে এসব বিষয় হ্যান্ডেল করবেন। সোজা কথা আমরা কাউন্সেলিং করার কে বা আমরা কেনোই বা এগুলো করবো!! কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে কিছু কেইস সমাধান করেই আমরা একেকজন কাউন্সেলর হয়ে গেলাম কিভাবে!! কথাগুলো যদিও আমার যথেষ্ট বিনোদন যুগিয়েছে তবু কিছু কথা এ নিয়ে না বললেই নয়।

আসি মূল কথায় যে তারা কেনো এমন বলছে। এই যে জীবনের ৮/১০ বছর নস্ট করে পড়াশোনা করে একেকজন মনো বিজ্ঞানী হলো, মননোরোগ বিশেষজ্ঞ হলো, এদের ইনকাম সোর্স কিন্তু এই মানসিক সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিত্বরা। একটা সিম্পুল ব্যাপারে মানসিক অশান্তিতে পরেও যদি এদের কাছে যান তো তাদের এতো দীর্ঘদিনের পড়াশোনার ফল স্বরূপ নূন্যতম প্রোফিটটা উঠবে। এটা শুধু তাদের ক্ষেত্রে নয়, একজন রাজমিস্ত্রি যদি বাড়ি তৈরির প্লানশিট দিয়ে বাড়ি তৈরি করে দেয়, তবে আর্কিটেকচার ইন্জিনিয়ারের কিন্তু গায়ে লাগাটাই স্বাভাবিক। হ্যা এটা ঠিক যে একজন আর্কিটেকচার ইন্জিনিয়ার যতোটা দক্ষতার সাথে বাড়ি তৈরির প্লানিং দিতে পারবে তা কিন্তু রাজমিস্ত্রি দিতে পারবে না। তবে হাফ বিল্ডিং কিংবা টিনসেট ঘর করতে ঐ আর্কিটেকচার ইন্জিনিয়ার এনে টাকা খরচ না করে কিছুটা কাজ রাজমিস্ত্রির দ্বারাও সম্ভব। আমাদের হেমলক সোসাইটি একটি নন প্রফিটেবল প্রোজেক্ট যেখানে অনেক ক্ষেত্রে ফোনকলে কাউন্সেলিং এর সময় কাউন্সেলররা নিজের টাকা খরচ করেই সহায়তা করে। কিন্তু এই ছোট ছোট কেইস গুলো যদি আমরা হ্যান্ডেল না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে যায় তবে, তবে তাদের ব্যবসা কিংবা প্রফিটটা বহাল থাকে। নয়তো এই রোগীগুলোর ইনকাম থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। এটাই হলো মূল কারণ।

হেমলক সোসাইটির নীতিমালা অনুযায়ী আমরা কোন ভয়াবহ কেইস হ্যান্ডেল করি না কিংবা জন্মগত এ্যাবনরমাল রোগীও হ্যান্ডেল করি না। বরং আমরা যদি বুঝতে পারি যে একজন ডিপ্রেশনের রোগীকেও কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে সুস্থ করা সম্ভব না, তবে আমরা তার দায়িত্ব নিয়ে শুধু শুধু সময়ও নস্ট করি না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমরা হ্যান্ডেল করি বিভিন্ন কারণে ডিপ্রেশনে ভোগা ব্যক্তিদের। চেষ্টা করি যথেষ্ট পরিমাণ কাছের একজন মানুষ হয়ে তাদের ডিপ্রেশন দূর করতে। সরাসরি ডাক্তার দেখাতে হলে অন্তত পরিবার বা আশেপাশের কাউকে না কাউকে কিন্তু জানাতে হয়। যারা এ কাজটি করতে পারছে না ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে, তাদের জন্য কিন্তু আমাদের উদ্যোগ অনেক উপকারী। কারণ আমাদের কাউন্সেলিং এর মাধ্যম অনলাইন যেখানে ব্যক্তি চাইলে নিজের পরিচয় আমাদের কাছ থেকেও গোপন রেখে সেবা নিতে পারে।

হেমলক সোসাইটিতে কর্মরত আছেন যারা তাদের কাউন্সেলর বলা যায় কি না, সেক্ষেত্রে একটু পরিষ্কার করে বলি। কাউন্সেলর (counselor) বা কখনো কাউন্সিলর (Councilor) বলে সম্বোধন করা হয়। এই দুটো ইংরেজি শব্দেরই সমার্থক শব্দ হলো উপদেষ্টা/উপদেশক। তবে যথার্থ হলো ইংরেজি কাউন্সেলর (counselor) যার অর্থ পরামর্শদাতা। এখন আমরা একজন ডিপ্রেশনে থাকা মানুষকে কিভাবে এ থেকে উঠে আসতে হবে সে সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছি। তবে আমাদের কাউন্সেলর বলে সম্বোধন করাটা কী অন্যায় কিছু? তাছাড়া কাউন্সেলিং সম্পর্কে নূন্যতম বই পড়া জ্ঞানের পাশাপাশি আমাদের হেমলক সোসাইটির প্রত্যেকটি কাউন্সেলর ব্যক্তিজীবনে নানাভাবে মানসিক সমস্যা থেকে ওঠে আসা মানুষ। তাদের ডিপ্রেশনসহ অন্যান্য মানসিক সমস্যা থেকে ওঠে আসার ব্যক্তি অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি নিজে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছি জীবনে বহুবার। মানসিক সমস্যার কারণে সাইকোথেরাপি, কাউন্সেলিং এসবের সাথে যথেষ্ট পরিচিতি আমার আছে। এক গাদা ঘুমের ওষুধ, এন্টিডিপ্রেসিং ওষধ প্রয়োজন আছে অবশ্যই। চরম খারাপ অবস্থায় এগুলো দিয়ে হ্যাং করে পরিস্থিতি সামলাতে হয়। তবে সেটা গণহারে না, কেইসের উপর ডিপেন্ড করে। কিন্তু আফসোস করে বলতে হয় বাংলাদেশের নামকরা অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখেছি যারা প্রতিনিয়ত যে কোন ডিপ্রেশনের রোগী পেলেই প্যারাসিটামল দুই বেলার মতো ঘুমের ওষধ দিয়ে খালাস হয়ে যায়। এটা অনেকটা রোগী ধরে রাখার পন্থা। আমাদের হেমলক সোসাইটি পরিবারের উদ্দেশ্য সবাইকে প্যারাসিটামল দুই বেলার মতো ঘুমের ওষুধ চিকিৎসা না দিয়ে কিংবা সব ক্ষেত্রেই আর্থের বিনিময়ে কাউন্সেলিং না করে একটু মানবতার জন্য কাজ করা। আমরা মানোরোগ বিশেষজ্ঞ কিংবা সার্টিফাইড কাউন্সেলরদের প্রতিযোগী না, আমরা শুধু অসহায় মানুষের সেবক মাত্র। আপনারা আমাদের সহায়তা করুন, মানব সেবা করতে চাইলে প্রয়োজনে আমাদের ট্রেইন করুন, নন প্রফিটেবল এই গ্রুপটার সাথে থেকে এগিয়ে আসুন নিজের ভেতরে কষ্টগুলোকে লুকিয়ে রেখে জীবন্মৃত মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটাতে।