কথাশিল্পের দিকপাল রাহাত খান

আনিসুর রহমান
Published : 10 Sept 2020, 08:42 AM
Updated : 10 Sept 2020, 08:42 AM

রবীন্দ্র উত্তর বাংলা কবিতার দিকপাল এবং বাংলা কথাশিল্পের দিকপাল দুজনেই তাদের সময়ের তরুণদের মনের রাজার আসনটি দখল করতে পেরেছিলেন। এদের একজন হলেন শামসুর রাহমান। অপরজন রাহাত খান। সৌভাগ্যক্রমে দুজনের সান্নিধ্য আর স্নেহ লাভ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। রাহমান ভাই আর রাহাত ভাইয়ের বয়সের ব্যবধান ছিল ১১ বছর। রাহমান ভাই চলে গেলেন ২০০৬ সালে। ১৯৪০ সালে জন্ম নেয়া রাহাত ভাই ৮০ বছর বয়েসে ২৮ অগাস্ট ২০২০ তারিখে আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন।

রাহমান ভাই আর রাহাত ভাই উভয়েই ছিলেন তরুণদের প্রতি বেজায় পক্ষপাতদুষ্ট। তাদের রাত দুপুর সকাল সন্ধ্যা তারুণ্যের সান্নিধ্যে ছিল। তাদের ধ্যানে-জ্ঞানে, স্বপ্ন ও কল্পনায় ছিল তারুণ্যকে উদযাপন। দুজনেই মৃদুস্বরে কথা বলতেন, ধারণ করতেন তারুণ্যের উচ্ছলতা। তাদের পোশাকে আর জীবন ও জগতকে উদযাপন করার উদ্যম ছিল তারুণ্যের অবয়বে ঠাসা। দুজনেরই বন্ধুত্বের বহর তরুণদের মাঝে ছিল দীর্ঘ। জীবনব্যাপী তারা তরুণদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে গেলেন, কত তরুণ ও তরুণীর মনে আলোর বিস্তার ঘটিয়ে গেলেন। এই লেখায় রাহাত ভাইকে নিয়েই আমার নিতান্ত আপন কিছু কথা বলতে চাই।

১৯৭১ সালে ঢাকা, স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের প্রধান নগরী ঢাকা। এরপর বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্য পরিমণ্ডলের প্রধান নগরী কলকাতার একচ্ছত্র আধিপত্য ঢাকার দিকে সরে আসতে থাকে। আর এর অন্যতম কৃতিত্ব কবিতায় শামসুর রাহমানের এবং কথাশিল্পে রাহাত খানের। বড় সম্পাদক হবার পরও রাহাত ভাই নিজস্ব প্রভাব এবং সম্পাদকীয় একচ্ছত্র অবস্থানকে নিজের লেখালেখির প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেননি, তিনি বরং লেখালেখিটা আত্মনিয়োগের প্রয়োগিক উদাহরণ হিসেবে নিয়েছিলেন।

তিনি তার কথাশিল্পে ঢাকা নগরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির জীবনকে তুলে এনেছেন। পাশাপাশি তার দেখার চোখ, লেখার ভাষা ও উপলব্ধির চিত্ত ছিল গ্রামীণ জীবনকে কথাশিল্পে ছেনে ছেঁকে তুলে আনার। তার বইয়ের নামগুলো এক একটা কালের সাক্ষী, সময়ের আগে চলা শিল্পীর মহিমার নিদর্শন বইগুলোর নামই বলে দেয় এক মুনশির মুনশিয়ানা, জীবন্ত ধ্রুপদি। যেমন ধরুন, অমল ধবল চাকরি; হে মাতবঙ্গ, হে মহাশূন্য; মধ্যমাঠের খেলোয়াড়; এক প্রিয়দর্শিনী; দুই নারী; কোলাহল; ছায়াদম্পতি; হে অনন্তের পাখি।

রাহাত ভাইয়ের লেখালেখি প্রসঙ্গে কিছু বলার আগে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগের বিষয়ে দুই একটি কথা বলে নেয়া যাক। নানাসূত্রে, নানা প্রয়োজনে জীবনের অসংখ্যবার হাটখোলা রোডের ইত্তেফাক ভবনে গিয়েছি। কখনো বেবী (বেবি মওদুদ) আপার কাছে অথবা রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই, নয়তো সাহিত্য সম্পাদক কবি আল মুজাহিদী ভাই অথবা শাহীন রেজা নূর নয়তো বা মহাদেব দা (কবি মহাদেব সাহা), শেষতক বেশির ভাগ সময় গিয়েছি আমার বন্ধু ফাইজুল ইসলাম এবং ফাইজুস সালেহীন ভাইয়ের কাছে। জানি শুরু থেকেই সময়ের তরুণ্যের আকর্ষণ কথাশিল্পী রাহাত খান এই ভবনেই বসেন।

একদিন ফাইজুল হঠাৎ করেই বলল, চলুন আপনাকে রাহাত ভাইয়ের ঘরে নিয়ে যাই। উনি এক ঘর পরেই বসেন। আমরা সালাম দিতেই রাহাত ভাই বললেন, এসো এসো, বলেই তিনি পিওন ডেকে চায়ের ফরমায়েশ দিলেন। এমন ভাবে আলাপ জুড়ে দিলেন, মনে হলো না জানি কত জনমের আত্মীয় আমরা। রাহাত ভাই এবং আমার বাড়ি বৃহত্তর ময়মনসিংহে হবার সুবাদে আমাদের কথার টান, আঞ্চলিকতা, শব্দচয়ন ছিল স্বতস্ফূর্ত ও সহজেই বোধগম্য।

প্রথম দিন আলাপেই আমি অনেকটা সাহস করেই তার লেখালেখি সম্পর্কে পাঠক হিসেবে কিছু কথা বলেছিলাম। কথাগুলো ছিল এরকম; রাহাত ভাই, আমার জন্ম গ্রামে। বই পড়ার পর্যাপ্ত সুযোগ আমি পাইনি। আপনার লেখাজোখা যতটুকু পড়েছি, তাতে মনে হয়েছে যৌনতা আপনার লেখায় যেভাবে স্বতস্ফূর্ত ভঙ্গিতে ও কথাশিল্পের দাবি মিটিয়ে উঠে এসেছে আর কারো লেখায় তেমনটা আসেনি। আমার কথা শুনে রাহাত ভাই আমার মুখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি ঠিক ধরেছ। যৌনতা তো জীবনেরই অংশ। কথাশিল্প তো জীবনেরই কথা। তুমি মাঝে মাঝে চা খেতে চলে এসো, গল্প করা যাবে। এই কথা বলে তিনি আমার লেখাজোখা, কাজ, পড়াশোনা সম্পর্কে আদ্যোপান্ত আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন। তারপর উৎসাহ দিয়ে বললেন, ইত্তেফাকেও লেখো, সাহিত্য পাতায় এবং সম্পাদকীয় পাতায় – যেখানে লিখতে চাও। এরপর আরো কয়েকবার তার রুমে বসে গল্প করার সুযোগ হয়েছে।

শেষবার তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম আমার বন্ধু অবজারভার পত্রিকার শিল্প সংস্কৃতি পাতার সম্পাদক শিল্পসমালোচক তকির ভাইকে সঙ্গে নিয়ে। এটাই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা, সময়টা ২০০৭ সাল; এরপর নানা দেশে নানা শহরে জীবন জীবিকার জন্যে কুত্তাদৌড়। এই দৌড়ের উপর থেকেও কয়েকবার টেলিফোনে কথা বলেছি তার সঙ্গে। শেষের দিকে কয় বছর ধরে নানা টানাপোড়েনে অনেক আপনজন আর ভালোলাগার মানুষদের সান্নিধ্য আর যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা দীর্ঘ হতে থাকল। এর মধ্যে রাহাত ভাইয়ের সঙ্গেও বিচ্ছিন্নতা। তিনিও ইত্তেফাকে আর নাই। তারপরও ফাইজুলের কাছ থেকে তার খবরাখবর নিতাম।

এই রাহাত ভাই অধ্যাপনা ছেড়ে লেখালেখি আর সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। লেখালেখির মান ও মর্যাদাকে চূড়ায় তুলেছিলেন। শয়নে-স্বপনে, নিদ্রায়-জাগরণে, ধ্যানে-জ্ঞানে, মনেপ্রাণে, খেয়ালে, চেতনে-অবচেতনে তিনি ছিলেন লেখক। জাত লেখক। ত্রিশ বছরে এক প্রজন্ম ধরলে ষাটের দশকের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তিনি দুই প্রজন্ম ধরে লিখেছেন। অথচ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার কোনো সাক্ষাৎকার পড়তে পারলাম না। তিনি লিখেছেন শিশু কিশোরের জন্যে; লিখেছেন গল্প উপন্যাস। ব্যক্তিচরিত নির্ভর কথাশিল্প যেমন তিনি লিখেছেন; তেমনি লিখেছেন ইতিহাস নির্ভর কথাসাহিত্য – উল্লেখ করা যায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন যেমন এসেছে তার লেখায় তেমনি এসেছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ।

আবার সাংবাদিকতায় ছিলেন দারুণ পেশাদার এবং নির্মোহ। কতজন কতভাবে নানা সরকারের সময় নানা পুরস্কার পদ-পদবী সুযোগ বাগিয়ে নিয়েছে। রাহাত ভাই ছিলেন ব্যতিক্রমদের একজন; এসব সুবিধা লাভের দিকে তার কোনো টান ছিল না। একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ২০০৭-২০০৮ সালের সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। ইত্তেফাকের মালিকদের একজন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পলাতক। আরেক ভাই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। রাহাত খান ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। বিবিসিতে একদিন রাহাত ভাইয়ের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হল সকাল বেলায়। আমি সাক্ষাৎকারটি পুরোটা শুনেছিলাম। রাহাত ভাইয়ের কথাগুলো ছিল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাজনৈতিক লাইনের বিপরীতমুখী। আমি অনেকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি ওইদিন দুপুরের দিকে রাহাত ভাইকে ফোন করে বিবিসিতে সাক্ষাৎকারের বিষয়ে বললাম। উনি শুনে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, তুমি শুনেছ? আমি বললাম, রাহাত ভাই, আপনি যেভাবে যে কথাগুলো বলেছেন, তাতে সরকারের লোকজন এমনকি খোদ ব্যারিস্টার সাহেব নাখোশ হতে পারেন। তিনি বললেন, তারা নাখোশ হতে পারেন, কিন্তু আমি যা বুঝি, যা দেখতে পারি, যা উপলব্ধি করি তার বাইরে তো কিছু বলতে পারি না। এই ছিলেন রাহাত ভাই।

সেই রাহাত ভাইয়ের মূল্যায়ন কি তার সময়, তার সময়ের কুশীলবরা করতে পেরেছেন? তিনি সময়কে চিনেছেন, সময়কে ধরেছেন। সময় কি তাকে মেলে ধরতে পেরেছে? গণমাধ্যমের কর্পোরেট সিন্ডিকেটের ডামাঢোলে রাহাত খানের মতো বিরলপ্রজ প্রতিভাসমূহ মনোযোগের আড়ালে রয়ে গেলেন। বঞ্চিত হলেন প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে। যদিও এসব নিয়ে তার ভাবান্তর বা খেদ কোনোটাই ছিল না। তিনি ছিলেন এসবের উর্ধ্বে। তার টান ছিল তারুণ্যের সান্নিধ্যে। কত তরুণ যে তাকে নায়ক মনে করেছে। কত তরুণী যে রাহাত ভাইয়ের কাছে হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল ছিল! তা আর এক মহাজীবনের আখ্যান।

আমার সীমিত পঠন থেকে বলতে পারি, রাহাত ভাই ছিলেন আন্তর্জাতিক মানের একজন প্রতিশ্রুতিশীল জাত কথাশিল্পী। তার লেখাজোখা প্রসঙ্গে তারই সমবয়সী সমসাময়িক আফ্রিকান লেখক জন ম্যাক্সওয়েল কোয়েতজির কথা মনে পড়ে। কোয়েতজির জন্মও ১৯৪০ সালে। তিনি ২০০৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কোয়েতজির কথাসাহিত্যে যৌনতা যে নিরিখে উঠে এসেছে, রাহাত খানের কথাশিল্পেও তেমনটাই – পার্থক্য কেবল দেশ ভূগোল আর ভাষা সংস্কৃতি।

আমাদের দেশের সাহ্যিত্যের যথাযথ অনুবাদ, সমালোচনা সাহিত্যের বিকাশ এবং সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণ হলে রাহাত খানের অবস্থান হতো আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় কোয়েতজির কাতারে। কিন্তু কথায় আছে, আত্মঘাতী বাঙালি আমরা, আত্মভোলা আদিখ্যেতা আমরা আপনারে আপনি চিনি না আমরা ভেসে যাই জনপ্রিয় ধারায়।

কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগ রাহাত খানকে কখনো আমন্ত্রণ করেছে? তিনি কি একটা সম্মানসূচক ডক্টরেট পেতে পারতেন না? স্বাধীনতা পুরস্কার যদি রাহাত খানকে দেওয়া না হয়, কাকে দেওয়া হবে? এরকম প্রশ্ন আরো আসবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সময়ের কুশীলবদের এভাবে প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।

রাহাত ভাইকে নিয়ে কবি দিলদার হোসেনের স্মৃতিচারণের শরণ নিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাই। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার ইস্কাটনে ট্রাম টাওয়ারে রাহার ভাইয়ের বাসভবনে দুই বাংলার কথাসাহিত্যিক আর কবিদের নিয়ে সারারাত ধরে সহস্রাব্দ উদযাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেই উদযাপন প্রসঙ্গে দিলদার ভাই বলেছিলেন, সহস্রাব্দ উদযাপনের এরকম ক্ষণ যেমন হাজার বছরে একবার আসে, তেমন রাহাত খানের মতো একজন প্রতিভা জাতির জীবনে হাজার বছরেই আসে।