জামায়াত ফিরিস্তি: সেই একাত্তর এই বর্তমান

হাসিবুল হক
Published : 17 Dec 2012, 04:57 PM
Updated : 17 Dec 2012, 04:57 PM

একাত্তরে গোলাম আযম ও তার দল জামায়াত কোনো রাখঢাক না করে বাংলদেশ স্বাধীনতার শুধু বিরোধিতাই করেনি পাক হানাদার বাহিনীর চর হয়ে কাজ করেছে । হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করে জঘন্য অপরাধ করেছে । গোলাম আযম সাহেবরা বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন এবং সামরিক শাসন পরবর্তীকাল থেকে এই বাংলাদেশে বহাল তবিয়তে বসবাস করছেন ।

গোলাম আযম ও তার দল জামায়াত ভয়ানক অপরাধ করেছে জনগণের বিরুদ্ধে কিন্তু জনগণকে আইনের আশ্রয় পাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে তৎকালিন সামরিক শাসক। জনগণের সাংবিধানিক অধিকারই শুধু নয় জন্মগত অধিকারকে উপেক্ষা করা হয়েছে । দেখা যাক একাত্তরে কি ভূমিকা গোলাম আযম ও জামায়াতের এবং বর্তমান নৈতিক অবস্হানই বা কেমন ।

টিক্কা খানের কামানের গোলায় যখন ঢাকা আগুনে জ্বলছে তখন গোলাম আযম ৬ এপ্রিল, ১৯৭১ টিক্কা খানের সাথে দেখা করে পাকিস্তানি সৈন্যদের পদক্ষেপের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জানান । ( দৈনিক সংগ্রাম, ৭ এপ্রিল, ১৯৭১ )

১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি কমিটি ( পিচ কমিটি ) গঠন করা হয় । গোলাম আযম শান্তি কমিটির শীর্ষস্হানীয় সদস্য হিসেবে যোগদান করেন । ( দৈনিক সংগ্রাম, ১১ এপ্রিল, ১৯৭১ )

১৫ এপ্রিল, ১৯৭১ দৈনিক সংগ্রাম (জামায়াতের মুখপত্র) পাকিস্তানি সৈন্যদের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে দুস্কৃতকারীদের অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করার পরামর্শ দেয় । ২৩ এপ্রিল, ১৯৭১ দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিবাহিনী ধরার জন্য বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করার পরামর্শ দেয় ।

'দৈনিক সংগ্রাম' ( ৩০ এপ্রিল, ১৯৭১ সংখ্যায় ) বলে যে যারা পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ করেছে তাদের পাকিস্তানে জায়গা হবে না ।

১৮ অক্টোবর, ১৯৭১ 'দৈনিক সংগ্রাম' বলে যারা পাকিস্তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, তারা যেন এদেশ ছেড়ে চলে যায় ।

বাংলাদেশ জন্মলাভ করার পর থেকেই জনগণের দাবি গোলাম আযমদেরও জায়গা এদেশে হবে না । অথচ তারা গত কয়েক দশক ধরে বলে আসছে বাংলাদেশ ওদের জন্মগত অধিকার । এ অধিকার তাদের নাকি আল্লাহই দিয়েছেন । কোনো শক্তির অধিকার নেই তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেবার । তাহলে তারা কীভাবে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এদেশে জায়গা না দেবার হুমকি দিয়েছিল । মুক্তিযুদ্ধের সময়গুলোতে তারা আল্লাহর হুকুম ও রাসুলের আদর্শের একটা নিয়মও কী পালন করেছে । অথচ তারা পবিত্র ধর্ম ইসলামকে স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহার করে সবসময় ।

২২ আগস্ট মতিউর রহমান নিজামী এক অনুষ্ঠানে বলেন, পাকিস্তান যারা চায় না, তারা ইসলাম চায় না । ( দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ আগস্ট, ১৯৭১ )

অবশেষে পূর্ব পাকিস্তান তো টেকেনি, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভ করল । তারা বাংলাদেশে রয়ে গেছে । দম্ভভরে বাস করছে । এখন তাদের 'ইসলাম' গেল কোথায়। বাংলাদেশে বাস করার কারণে তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাননি ?

গোলাম আযম, রাজাকার ও আল-বদর নির্মূলের কথা উঠেছে কারণ তারা মুক্তিযোদ্ধা নির্মূল করতে চেয়েছিল । তারা মুক্তিকামী জনগণকে খতম করেছিল । গোলাম আযম সাহেবদের যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে । অথচ হানাদারদের ২৫ মার্চের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে দেশ এবং দেশের মানুষকে রক্ষার জন্য মুক্তিসেনারা যে লড়াই শুরু করেছিল তাদের বিচারের জন্য গোলাম আযমরা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে চেয়েছিল ।

দৈনিক সংগ্রাম (১৪ এপ্রিল, ১৯৭১) বলে যে দিনাজপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সকল ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে এবং সকল অনুপ্রবেশকারী মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করা হয়েছে ।

দৈনিক সংগ্রাম ( ১ মে, ১৯৭১ সংখ্যায় ) বলে দেশের শান্তির জন্য দুস্কৃতিকারীর মূল উৎস উৎখাত হওয়া প্রয়োজন । আরও মন্তব্য করে, দুস্কৃতকারীদের ( মুক্তিবাহিনীর ) নির্মূল করা একান্ত প্রয়োজন । দৈনিকটি আরও উল্লেখ করে পূর্ব পাকিস্তানে 'বাংলাদেশ সরকার' নামক কোনো কিছুর অস্তিত্বও নেই ।

২৮ মে, ১৯৭১ দৈনিক সংগ্রাম মুক্তিবাহিনী নির্মূলের জন্য অস্ত্রশস্ত্র দাবি করে । তারা একই সাথে বেসামরিক পোশাকধারী একটি বাহিনী গঠনেরও পরামর্শ দেয় ।

গোলাম আযম বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের দুশমন আখ্যা দিয়ে তন্নতন্ন করে তালাশ করে খুঁজে বের করার আহ্বান জানান । ( দৈনিক সংগ্রাম, ১২ আগস্ট, ১৯৭১ )
১৪ সেপ্টেম্বর মতিউর রহমান নিজামী যশোরে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের খতম করার আহ্বান জানান । ( দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ )

দৈনিক সংগ্রাম (২৭ মে, ১৯৭১) মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামীলীগ নেতাদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে আবেদন জানায় ।

বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তরা কারাগারে আছেন । তাদের সকল সুযোগ সুবিধা পর্যাপ্ত পরিমাণে নিশ্চিত করা হয়েছে । সাংবাদিক পর্যবেক্ষক সকলেই যেখানে তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন তারপরও তাদের বিস্তর অভিযোগ । অথচ সেদিন ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ দৈনিক সংগ্রাম 'শেখ সাহেবের খাদ্য তালিকা' শীর্ষক এক নিবন্ধে বলে, রাষ্ট্রদ্রোহী শেখ মুজিব জেলের ভেতরে ভাল খাওয়া-দাওয়া করছেন এটা দুঃখজনক ।

জামায়াত বরাবর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠনে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করে এসেছে । বাংলাদেশের অফিস আদালতে তারা ব্যাপকহারে নিয়োগ নিয়ে প্রবেশ করেছে তাতে আমরা বাংলাদেশের জনগণ আপত্তি করিনি কিন্তু একাত্তরে তাদের বক্তব্য লক্ষ্য করুন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের উদ্দেশ্যে কি বলেছে ।

১৮ সেপ্টেম্বর মোহম্মদপুরে রাজাকারদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গোলাম আযম এক ভাষণে বলেন, বাইরের চেয়ে ঘরের শত্রু বেশি ক্ষতিকর । এদের খতম করতে হবে । ( দৈনিক সংগ্রাম, ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ )

১৪ অক্টোবর, ১৯৭১ পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক এক বিবৃতিতে বলেন, রাজাকাররা সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকে কাজ করছে ।

'দৈনিক সংগ্রাম' ( ৮ নভেম্বর, ১৯৭১ ) বলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পরই রাজাকারদের স্হান । রাজাকার বাহিনীর দুই শাখা আলবদর ও আলশামস এর ওপরই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ।

২৯ অক্টোবর, ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম অফিস-আদালত থেকে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থকদের বের করে দেয়ার আহ্বান জানায় ।

অথচ রাজাকার প্রসঙ্গে বিএনপি'র তৎকালিন শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার জাতীয় সংসদে বললেন, " তৎকালিন রাজাকাররা অকজিলিয়ারি ফোর্স নয় । তারা পুলিশ নিয়ন্ত্রিত ছিল এবং পুলিশ কোন আর্মড ফোর্স নয় । তারা মিউনিসিপ্যাল ফোর্স, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাই তাদের কাজ ।" ( বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা- ৪১৩, এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া, প্রকাশক- দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ-১৯৯৩ )

বাংলাদেশে যখন জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে তখন তাদের বক্তব্য এটা নাকি গণতান্ত্রিক নয় । এখানে সে বিশ্লেষণে যাব না । কিন্তু গোলাম আযমের একাত্তরের বক্তব্য কি প্রমাণ করে ।

২২ জুন গোলাম আযম এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে যেসব দল আন্দোলন করছে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আহ্বান জানান । ( দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ জুন, ১৯৭১ )

একাত্তরে জামায়াত রাজাকার আলবদর বাহিনী গঠন করে ইসলাম রক্ষার নামে নারী ধর্ষণ ও বাঙালি নিধনে নামিয়ে দেয় । তখন বাংলাদেশের জনগণকে কাপড় খুলে প্রমাণ দিতে হয়েছে তাদের মুসলমানিত্বের । কলেমা পড়তে জানে কিনা তার প্রমাণ দিতে হয়েছে তাদের কাছে । ইসলাম রক্ষার নামে পবিত্র ইসলামকে এভাবে অবমাননা করেছে তারা । বাংলাদেশের জনগণকে অপমান করেছে জঘন্য উপায়ে ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে বানচাল করতে জামায়াত বর্তমান যে ভয়ংকর সহিংস রূপে আবির্ভূত হয়েছে এটা তাদের অনেক পুরনো চেহারা ।