৫ জানুয়ারির নির্বাচন: লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গি-সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ গঠন

হাসিবুল হক
Published : 3 Jan 2015, 06:57 PM
Updated : 3 Jan 2015, 06:57 PM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ৫ জানুয়ারির সাধারন নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বারবার সংলাপের আহ্বান জানালেও তিনি সাড়া দেননি।বরং প্রতারণার আল্টিমেটাম দিয়ে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের পথে চলেছেন।তাদের সন্ত্রাস-নাশকতায় দগ্ধ হয়ে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। নির্বাচনের পরও তারা সংখ্যালঘু জনগণের ওপর নির্যাতনকরেছে।রাজনৈতিক হিংসা ও নৈরাজ্যের পরিবর্তে গণতন্ত্রের স্থিতি ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে বিএনপি কাজ করেনি। বিএনপিকে নাশকতা ও জঙ্গিবাদের বন্ধুত্ব পরিহার করে গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্ষবরণের দিন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিএনপি টানা অবরোধ কর্মসূচি দেয়।২ জানুয়ারি স্কুলে স্কুলে বই উৎসব। স্কুলগুলোতে পৌঁছে গেছে প্রায় শতভাগ বই । দেশের ৩৮টি জেলায় অন্তত ১৫৩টি ভোট কেন্দ্রে তারা পেট্রোল ও গান পাউডার ঢেলে আগুন দেয় ও ভাংচুর করে।পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় কেন্দ্রগুলো।কেন্দ্রগুলোর প্রায় সবই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।শিক্ষার্থীরা নতুন বইয়ের গন্ধ নেয়ার আগেই বই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে জামাত-বিএনপি। আগুন দেয়া হয়েছে ৫৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে

নির্বাচন বাতিলের দাবিতে লাগাতার অবরোধের পাশাপাশি হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ৪ জানুয়ারি ভোর ৬টা থেকে সারাদেশে ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ডাক দেয় বিরোধী এ জোট। ভোটগ্রহণ শুরুর আগের দিন অস্ত্র লুট, বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র, ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপারে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ভোট কেন্দ্রের সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তের দল। গরু বহন করা একটি ট্রাকে হরতাল-অবরোধ সমর্থনকারীদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় চালক নুরুজ্জামান অগ্নিদগ্ধ হয়ে পরে মারা যায়। পেট্রোল বোমা একের পর এক উপার্জনক্ষম পরিবারের সদস্যদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। স্বজনহারাদের আহাজারি পেট্রোল বোমা মেরে হত্যার সঙ্গে জড়িত ঘাতকদের হৃদয় স্পর্শ করেনি।তারা হরতাল-অবরোধে যানবাহনে কিংবা যাত্রীবাহী বাসে হামলা চালিয়ে গেছে। পুলিশের চোখ তুলে নিয়ে হত্যা করেছে।পুলিশ ফাঁড়িতে অতর্কিত আক্রমণ করে ঘুমিয়ে থাকা সদস্যদেরকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে। পুলিশের থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে সেই অস্ত্র দিয়েই নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে পুলিশকে। এমন প্রেক্ষাপটে জামায়াতও নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানায়।

নির্বাচন 'গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ' এমন কথা উল্লেখ করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন ৬ জানুয়ারি বলেছেন- বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অংশ। সহিংসতার পথ ধরে কোনো সমাধান সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব গতিপথে চলতে দিতে হবে।

নির্বাচন নিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সাইয়্যেদা হুসেইন ওয়ারসি জানান- দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ভোটে অংশ নেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় এবং অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় ভোটার উপস্থিতি 'কম' থাকায় এই নির্বাচনের বিষয়টি হতাশাজনক। তবে বিবৃতিতে বলা হয়, নতুন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের কল্যাণে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। উন্নয়ন সহযোগিতায় বাংলাদেশকে যুক্তরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশের জনগণের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের লক্ষ্যপূরণে যুক্তরাজ্য সহযোগিতা করে যাবে।

সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার সংখ্যালঘু জনগণের ওপর বিএনপি-জামায়াতের এত আক্রোশ কেন? নির্বাচনের পরপরই দিনাজপুর, যশোর, সাতক্ষীরা ও ঠাকুরগাঁওয়ে হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলা শুরু করে জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা ।প্রায় দুই দিন ধরে এসব জেলায় হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। অনেকে প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মন্দিরে।কেউ কেউ পালিয়ে থেকেছেন অন্য গ্রামে।

মায়া রানী বিশ্বাসের কথা ভুলে যাওয়ার কথা না। সাত মাসের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে মিনিট দুয়েক অঝোরে কেঁদেছেন। ৫ জানুয়ারির ভয়াবহতার কথা মনে করে তার চোখে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে জল। কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, হামলার পর সন্তান কোলে নিয়ে দৌড় শুরু করলে সন্ত্রাসীরাও তার পিছু নেয়। যশোরের মনিরামপুর উপজেলার হাজরাইল ঋষিপল্লী এলাকায় দুই নারী ধর্ষণের ঘটনার পর ঋষিপল্লীতে কী আতঙ্ক বিরাজ করেছে এখন ভাবলে গা শিউরে ওঠে। বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাতে নির্ঘুম রাত কেটেছে তাদের।

বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলার যে সব ঘটনা ঘটেছে, তার নিন্দায় সরব থেকেছে ভারতের তৎকালিন প্রধান বিরোধী দল বিজেপি।৮ জানুয়ারি দিল্লিতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও হিন্দুরা সেখানে যেভাবে অত্যাচারিত হচ্ছেন তাতে তাদের পক্ষে চুপ থাকা সম্ভব নয়।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে একটি তামাশার নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করে তারেক রহমান বলেছেন-সংলাপের আর কোনো প্রয়োজন নেই।কারণ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে দেশের মানুষ জানিয়ে দিয়েছে তারা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। এদিকে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এবং বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন- বিএনপি চলমান সহিংসতা ও নাশকতা বন্ধ করলে, জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে নাশকতা পরিহার করে সমঝোতা করতে ইচ্ছুক হলে মেয়াদ শেষের আগে নির্বাচন দেয়া যেতে পারে ।

৬ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেন-অবিলম্বে নির্বাচনের নামে এই প্রহসন বাতিল, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ একটি সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছার জন্য আহবান জানাচ্ছি। খালেদা জিয়ার আহ্বানের বিপরীতে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন- সহিংসতা ও জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে আলোচনায় আসুন।জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন,বিএনপি তাদের রাজনীতির বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে এবং কারো দ্বারা নির্দেশিত হবে না।

এদিকে ৮ জানুয়ারি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেছেন-জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রবাহমান রাখতেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেয়া হয়েছিল ।আইন কমিশনের একটি সেমিনারে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এসব কথা বলেন। খায়রুল হক বলেন-

আমরা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করতে বাধ্য হয়েছি।কারণ আমাদের সংবিধান ও আইন তিন মাসের জন্য জনগণের শাসন থাকবে না, এটা সমর্থন করে না। রায়টি পড়লেই এটা বুঝতে পারবেন।

মূলত শেখ হাসিনার 'জামাতের সঙ্গ' ছাড়ার আহ্বান খালেদা জিয়া প্রত্যাখান করার পর থেকেই সংলাপ এর প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলার আর জায়গা থাকেনি। এছাড়া আওয়ামি লীগ প্রথম থেকেই বলে আসছে নির্বাচনে জিতলে পাঁচ বছরই তারা রাষ্ট্রপরিচালনা করবে। গত বছর ১ জানুয়ারি শেখ সেলিম বলেন-জিতলে ৫ বছরই ক্ষমতায় থাকবে আওয়ামী লীগ।