৭ মার্চের ভাষণ হোক মানবিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন

হাসিবুল হক
Published : 6 March 2018, 10:56 PM
Updated : 6 March 2018, 10:56 PM

বাঙালির জনপ্রিয় নেতার কাছে পাকিস্তানের শাসনভার অর্পিত হবে এমন গণরায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মেনে নেবেন না, এমন ভাবনা হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাওয়া তেলের শিশি উল্টে ফেলা শিশুও বোধ হয় বুঝে নিতে পেরেছে তখন। বাঙালির কোনো অর্জনই কি সহজে অর্জিত হয়েছে? হয়নি।বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে যখন মুক্তি সংগ্রামের আহ্বান জানালেন। সেই মুক্তির আহ্বান শুধুই রাজনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিল না। অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক মুক্তির পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও তিনি মুক্তিকামী জনগণকে পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।যখনই বাংলার জণগণ বুঝতে পেরেছে সে বাঙালি, সে মানুষ তখনই সেই ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করা হয়েছে।গুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়ছে বাঙালির মনোবল ও সাহসকে।

কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করা হয়েছিল মানবিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়েই। মানবিক বাংলাদেশ গড়ার শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ। হোঁচট খেতে খেতে এই পর্যায়ে আসা। এই জনপদে সংখ্যাগরিষ্ঠ উৎকৃষ্ট নাগরিক যেমন রয়েছে তেমনি পেছন থেকে ছুরি চালানো ঘাতক গোষ্ঠীর অস্তিত্ত্বও রয়েছে, আমরা সাধারণ নাগরিকরা তা কি হাড়ে হাড়ে টের পাই না? টের পাই।

আমাদের এবং উত্তর প্রজন্মের জন্মভূমি যেন নিরাপদ আশ্রয়ের হয়, এমন স্বপ্ন দেখা এবং যাপিত জীবনে তা পাবার অধিকারও নিশ্চয় বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। ঘর থেকে বের হয়ে নাগরিকরা ঘাতকের ছুরিতে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে জীবন দেবে,কথার যুক্তিতে না পেরে হেরে গিয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে মহামূল্যবান জীবনগুলোকে একেবারে জবাই করে নি:শেষ করে দেবে পাষন্ডরা, সন্ত্রাসবাদের কালো থাবার নীচে নিজের ঘাড় পেতে দেবে আর কতদিন? বৃথায় কেঁদে মরবো তাও হতে দিতে পারি না। স্বস্তিতে বেঁচে থাকার দাবী নিয়ে লিখতে বসেছি। আমরা মিলিটারি শাসনে যেমন বাঁচতে চাইনি তেমনি জঙ্গিরা জঙ্গিবাদের শাসন চালাবে তেমনটাও হতে দিতে পারি না। আমরা বাংলাদেশের জনগণ ভূত নই যে আমাদের পায়ের দিক ঘুরে পেছনে চলে গেছে ভূতের মতো।এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিশ্চয় বঙ্গবন্ধু দ্যাখেননি।

এমন বাংলদেশ চাই যে বাসের দরজায় ঝুলে ঘেমে নেয়ে কর্মস্হলে যেতে না হয় নাগরিকদের।কচুরিপানার মতো ভাসমান যে মায়ের জীবন,তাঁকে যেন ফুটপাতে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে আর দেখতে চাই না।দেখবো না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক,প্রকৌশলী,কৃষিবিদ, সাংবাদিক দলবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন। ঘুষ-দুর্নীতির সাথে যেন আমাদের কোনো পরিচয়ই নেই। স্বজনপ্রীতি নেই।পুলিশ এর কাছে কোনো নাগরিক যেতে ভয়ই পায় না। সরকারি কর্মকর্তাদের সামনে গিয়ে কোনো নাগরিককে কাঁচুমাচুঁ হয়ে দাঁড়াতে দেখা যায় না। ভূমি অফিস থেকে দালাল শব্দটির বিলুপ্তি ঘটেছে সেই কবে থেকে যেন তা নাগরিকদের মনেই নেই।

নদী দখল নেই, দূষণ নেই। নদ-নদীর স্বচ্ছ জলের ভেতর থেকে যেন ঝর্ণার গান ভেসে আসছে।নদ-নদীগুলোতে রূপালি মাছের অদ্ভূত নাচন! মাছে-ভাতে বাঙালি হয়ে গেছি আবার আমরা। ভূমি দুস্য,মাদক সম্রাটদের অস্তিত্ত্ব বিলীন হয়ে গেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার শেষ হয়েছে।সকল হত্যাকানণ্ডের বিচার শেষ হচ্ছে হবে, কোনো টালবাহানা থাকবে না। সকলেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ধুমপানে বিষপান। বস্তির আধুনিক রূপ দেখে মুগ্ধতায় ডুবে গেছে সবাই। সুপেয় পানির অভাব নেই কোথাও। গাছ গাছালিতে সড়কের দু'ধার যেন যাত্রীদের জীবনে স্বস্তি এনে দিয়েছে। আকাশে পাখিদের সে কি আনাগোনা!পরিযায়ী পাখির আগমনে বাংলাদেশের রঙটাই বদলে গেছে। বন কেটে উজাড় করা হয় না এখানে, অযথা পাহাড় কেটে দেশের ভূকম্পনের আশংকা বাড়াতে কেউ রাজি হয় না।দেশের কোনো শহরে মফস্বলে গ্রামে জলজট নেই। মশার কামড় খাওয়া তো দূরের কথা গুনগুন আওয়াজও কেউ শুনতে পা্য় না।

রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ আর খুঁজে পাই না তা। টেন্ডারবাজি নেই, ছাত্ররা পড়াশুনা করছে, সুস্হ ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত তাঁরা। অবসরে যার যার এলাকায় সামাজিক কাজে ব্যস্ত।পাঠাগারে বই আছে পাঠকও আছে। প্রশ্ন ফাঁস নেই, ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন পাওয়া গেলেও ছাত্র-ছাত্রী ও তাঁদের বাবা মা কেউ সেদিকে ফিরেও চা্য় না। অটিস্টিক শিশুদেরকে দেশের বোঝা মনে করে না কেউ।

ব্যবসায়ীরা চাল-ডাল,পিয়াজ-রসুন,মাছ-মাংস ইত্যকার দ্রব্য নিয়ে জনগণের সাথে কৃষকদের সাথে ভেলকিবাজিতে নেই। বিদ্যুতের ঘাটতি নেই, বিদ্যুতের অপচয়ও নেই। গ্যাসের অপচয় কেউ করে না। গ্রাম্য দলাদলিতে সকলের অভক্তি। ধর্ষকরা নির্জীব হয়ে গেছে। অন্ত্যজ সম্প্রদায় তাঁদের শতভাগ অধিকার ভোগ করছে। চাকমা, মারমা, মনিপুরি, সাঁওতালসহ সকল জনগোষ্ঠী তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য অধিকার নিয়ে বাঙালিদের সাথে বাংলাদেশের সকল জনগণ এক ও অভিন্ন এমন বিশ্বাস ও ভালবাসা নিয়ে হাজার বছর ধরে বসবাস করে চলেছে। হিজড়াদের সরকারি চাকরি হয়েছে।

বাংলাদেশের মাটিতে আযানের সমধুর আওয়াজ ভেসে আসুক তবে মাইকের উচ্চ মাত্রার প্রাণ কাঁপানো ধ্বনির পরিবর্তন এসেছে।ওয়াজ মাহফিলের নামে আবাসিক এলাকায় মধ্যরাত পর্যন্ত মাইকের উৎকট শব্দের চিতকার নেই। মন্দির থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে কিন্তু ভয়ঙ্কর মিউজিক সিস্টেমের ব্যবহার নেই। বাসাবাড়ির ছাদে দালান কেঁপে ওঠা হৃদকম্পন শুরু হওয়া ভয়াবহ ব্যান্ড সঙ্গীতের সেই প্রকোপ নেই। আছে নাজমা জামানের সেই 'চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেঁধো না'। আছে রাঁখালের হারিয়ে যাওয়া বাঁশির সুর। আছে মেঠো পথ।

মোটা দাগে এই তো আমাদের বাংলাদেশ হতে পারে যা ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় বাংলাদেশ।