মাচে দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হলে ২৫ মার্চ সরকার সাধারণ ছুটির ঘোষণা দেয় নাগরিকদের ঘরে থাকার জন্য। হুট করে লকডাউন চলে এলো সবার জীবনে; কিন্তু অনেকেই তখনও বিষয়টা বুঝে ওঠেনি।
ওরমধ্যেই একদিন, ১৬ এপ্রিল, সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বাইরে বের হয়েছি। ফুটপাথে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। নিস্তব্ধ চারপাশ। আকাশ পানে চেয়ে দেখি দৃষ্টির সীমানায় কোনো প্রাণের দেখা নেই; পাখিরা এখনও ঘুম থেকে জাগেনি বোধ হয়।
সড়কে যান চলাচল নেই, ধোঁয়া নেই, বিশ্রী শব্দ দূষণ নেই, ঘষামাজা ফুটপাথ। পরিচ্ছন্ন শহর দেখে যে কারোও মন ভাল হয়ে যাবার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের মন ভাল নেই। মাত্র কয়টা দিনের ফাঁকে চেনা শহরটাকে বড্ড অচেনা লাগছে। গা ছমছম করা অনুভূতি। বাসায় ফিরে যাবো কি না তাই ভাবলাম একবার।
কখন যে হাঁটতে শুরু করেছি মনে নেই। এই গলি সেই গলি করছি। দুয়েকজনের দেখা মিলতে শুরু হল। ঘন্টাখানেক ধরে এদিক-ওদিক ঘুরে মেইন রাস্তায় উঠে গেছি। পথ চলতি কিছু মানুষের এখন দেখা মিলছে। আকাশে দেখা মিলছে বৈশাখী সূর্যের চেহারাও।
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের দিকে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে চলছি। পাশের ফুটপাথে দেখি মুখে মাস্ক নিয়ে এক চা বিক্রেতা নারী অসুস্হ স্বামীকে পাশে রেখে পায়চারি করছে। মনে হলো ক্লান্ত দেহ নিয়ে চা-বিস্কুট,পান বিক্রির পাশাপাশি স্বামীর অসুস্হতা নিয়েও অস্হির সে। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে কি না বোঝা দায়, কিন্তু বিবর্ণ চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ষাটোর্ধ। এগিয়ে গেলাম। যাই প্রশ্ন করি বিক্ষিপ্ত আর অস্পষ্ট জবাব দিলেন নারী।
একবার মনে হলো প্রতিবন্ধী কি না। তবে অভাব-অনটন যে ঐ নারীর সারাজীবনের সঙ্গী তার অবয়ব বলে দিচ্ছে।
এরপর রাস্তার উল্টোদিকের ফুটপাথে দেখি আরেক চা বিক্রেতা, মুখে মাস্ক। বড় ফ্লাস্কে পরিপাটি বেশবাসে চুপচাপ বসা। চা-টোস্ট,পান-সিগারেটের ব্যবসা তার। বোঝা যাচ্ছে মন ভার কোনো কারণে।
বললাম, এখনই তো বসলেন। রাস্তায় তেমন কেউ বের হয়নি। ডেইলি বিক্রি কেমন হয়?
চা বিক্রেতা বললেন,একটু আগে তালতলা মার্কেটের সামনে বসা ছিলাম। বেচাবিক্রি নেই। লোকজন কম বের হয়।
আমি আরেকটু কথা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বুঝলাম লোকটার কথা বলার ইচ্ছে নেই।
সাব্বির। বন্ধুর সাথে ফুটপাথে উচ্ছল ফুটফুটে চেহারার ছোট্ট শিশু পান-সিগারেটের ডালা নিয়ে ফুরেফুরে মেজাজে গল্পে মশগুল। সে নাকি ব্যবসায় একেবারে পাকা। কথাবার্তায় দারুণ চটপটে। দুই বন্ধুর মুখে মাস্ক।
বললো, করোনা আইছে; তাই মাক্স পরছি।
জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের একটা ছবি তুলবো?
হেসে বললো, মামা ছবি কি ফেইসবুকে দিবা?
আমি জবাব দেওয়ার আগে আবার বললো, বুজছি ফেইসবুকেই দিবা।
ওর বন্ধুর নাম জানতে চাইলে লজ্জায় মুখ গুঁজে বসে রইল। দুইজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে এলাম তোমাদের ছবি পত্রিকায় দিব। কথাটা শোনার পর দুইজন চেহারায় আনন্দ দেখা গেল।
ফেরার সময় মনের অজান্তে বললাম, সাব্বির সারা জীবন ভাল থেকো। তোমাদের অমলিন চেহারা যেন কখনো মলিন না হয়।
বাইরে তখন ঝলমলে রোদ। এতো আলো তবু সবকিছু আজ আমার চোখে বিবর্ণ, আঁধারে ঢাকা। এই জীবনে কোভিড-১৯ আমাদের জানিয়ে দিলো মানুষ কত নিরুপায় হতে পারে।