সড়ক দুর্ঘটনা: বাংলাদেশের নিয়তি কোন পথে

হাসিবুল হক
Published : 25 August 2011, 03:20 PM
Updated : 25 August 2011, 03:20 PM

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে । কথার বাণে জর্জরিত দুই মন্ত্রীর অবস্থাও বর্তমানে বেহাল । কেউ বলছেন রাস্তা মেরামতের রোলার মেশিন দিয়ে মন্ত্রীকে পিষে মেরে ফেলার কথা । কেউ ঘোষণা দিয়েছেন ঈদ পালন করবেন শহীদ মিনারে । এইসব ঝোপ বুঝে কোপ মারা নষ্ট রাজনীতিই দেখতে হয় আমাদের । একজন তো রোলার মেশিন দিয়ে মন্ত্রীকে পিষে মারতে চেয়েছেন । যা বোঝা যাচ্ছে তাকে মন্ত্রী বানিয়ে দিলে তো সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি জনগণকেই পিষে মেরে দেবেন , যাতে রাস্তায় কেউ বের না হয় তাতে দুর্ঘটনাও ঘটবে না । শুধু নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করার চিন্তা মাথায় আসে কেন , আসল সমাধান নেই ? বাংলাদেশের যা সামাজিক চিত্র শুধু মন্ত্রী বদল করেও সমাধান হবে না । শুধু রাস্তা মেরামত করেও হবে না । শুভ্র সফেদ থান কাপড় গায়ে জড়িয়ে যিনি বা যারা একাজে নেমেছেন তারা ভাল করেই জানেন শুধুমাত্র পদত্যাগেই সমাধান না । তাহলে কি শুধু অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করা ! যে কথাগুলো বললাম তার মানে এই না যে আমি আবার সড়ক মেরামতের কথা অস্বীকার করছি । তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর সহ যে পাঁচ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলেন সেই সড়কের কিন্তু বেহাল দশা ছিল না । চালকও অদক্ষ ছিল না । মিরসরাইয়ের দুর্ঘটনা সড়কের বেহাল দশার কারণে ঘটেনি । দুর্ঘটনা যত কারণে ঘটে বা ঘটতে পারে সেসব কারণগুলো কখনোই একইসাথে আমাদের আলোচনায় উপস্থাপিত হয় না ।

বরেণ্য চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরের নিহত হবার ঘটনায় যে বিশ্লেষণ চলছে তা একই ধাঁচের । পত্র-পত্রিকাতেও পুরনো ধারাবাহিকতায় খবর হয়েছে । বাকি যে তিনজন নিহত হয়েছেন তাদের জীবনচিত্র প্রয়াত মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের মতো উজ্জ্বল না তাই বলে এতোটা অনুজ্জ্বল না । কিন্তু এক্ষেত্রে নিউজ চ্যানেলগুলো কি করল ! তারা নিজেদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ ভাবেন । সেই দর্পণে হতভাগ্য তিনজনকে দেখা যায়নি । অবশ্য এ নিয়ে তাদের কোনো লজ্জা আছে বলে মনে হয় না । কিন্তু মন্ত্রীদের নির্লজ্জ বলতে কুণ্ঠাবোধ নেই তাদের । এ দুর্ঘটনায় পুলিশের মামলার প্রধান আসামী গ্রেফতার হয়েছে । বাসটি মাইক্রোবাসকে মেরেছে এভাবেই চার্জশিট হয়ে হয়ত আদালতে যাবে । কিন্তু মাইক্রোবাসটিও তো বাসটিকে মেরেছে । এমন যদি হতো প্রয়াত মিশুক মুনীর বাসের যাত্রী হয়ে গেছেন আর মাইক্রোবাসের অজানা অচেনা যাত্রীরা নিহত হয়েছেন তাহলে কী মন্ত্রীদের পদত্যাগের দাবী এভাবে উঠত ! বিশেষ করে গতকাল ২৪ আগস্ট শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে যারা দাবী তুললেন । ঐ সকল ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষ একটি গোষ্ঠী ওখানে ছিলেন যারা আইনের শাসনের কথা বলেন , গণতন্ত্রের কথা বলেন অথচ তারা সামরিক শাসনামলে বাস করতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন । উনারা সত্যিই কি এসকল দুর্বিষহ সমস্যা থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে চান ? তাহলে সস্তা পথে না গিয়ে সমাধানের উপায় বের করে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় সরকারকে চাপ দিচ্ছেন না কেন ?

শহীদ মিনারের প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে যোগাযোগমন্ত্রীর *লোভ কাতরতা* নিয়ে । লোভ কাতরতার প্রসঙ্গটি মিলিয়ে দেয়া হলো কিসের সাথে ? এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সাথে বড় বড় সেতুর সাথে । তাহলে কী পদ্মা সেতু মেট্রোরেল ইত্যাকার উন্নয়ন প্রকল্পগুলো শুধুমাত্র যোগাযোগমন্ত্রীর আখের গোছানোর প্রকল্প ? এসব প্রকল্প দেশ এবং জনগণের জন্য না ? এদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে, না বুঝে জনগণের একটা অংশ যদি দাবি তুলতে শুরু করে এসব আকাশচুম্বি দুর্নীতির প্রকল্প আমাদের দরকার নেই , আমাদের শুধু রাস্তা ঠিক করে দাও । তাহলে অবস্থাটা কি দাঁড়াবে আমরা কি তা ভেবেছি ! আমাদের সমস্যাগুলো কত প্রকট হয়ে উঠবে তখন ! যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠবে উঠুক সুনির্দিষ্টভাবে তবে সেটা বিভ্রান্তি ছড়ানোর মাধ্যমে নিশ্চয় না । দেশের মানুষ যাদের বিবেকবান বলে জানে তারা বিভ্রান্তি ছড়ালে রাজনীতির যে অঙ্গটুকু মোটামুটি ভাল আছে সেটুকুও পচে যেতে সময় লাগবে না ।

এখানে ভেবে দেখা দরকার মিশুক মুনীরকে বহনকারী মাইক্রোবাসের চালকেরও বোকামি ছিল কিনা । তারেক মাসুদ মিশুক মুনীরের মতো প্রতিভাদের অকালে চলে যাওয়া জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি । এ দুর্ঘটনায় দেশের জনগণ বেদনায় কাতর । তবে সেই আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে আসল সত্য বের করার প্রক্রিয়াকে যদি প্রভাবিত বা বাধাগ্রস্ত করা হয় তা ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ উদাহরণ হয়ে থাকবে । ড্রাইভিং কে কেমন জানে , কতটা দক্ষ এ বিষয়গুলো অবশ্যই মূখ্য । কিন্তু তার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ কে কীভাবে গাড়ি চালায় । দক্ষ চালক যে দুর্ঘটনা ঘটায় না এটা বলা যাবে না । দক্ষ চালক যদি অসতর্ক হয় অসহিষ্ণু হয় তাহলে তার দক্ষতা কোনোই কাজে আসবে না । দক্ষ চালক সতর্ক থাকেন এমনটা বলা বোধ হয় সবক্ষেত্রে ঠিক হবে না । কিন্তু চালক যদি সবসময় সতর্ক ও সহিষ্ণু থাকে সে দিনে দিনে দক্ষ হয়ে উঠে , এটিই পরীক্ষিত । দু*জন চালকের কারো হয়ত পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না দুর্ঘটনা ঘটাবার । তবে তাদের মধ্যে অবহেলা ও বেপরোয়া মনোভাব কাজ করেছে তা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে । বেপরোয়া মনোভাবই যদি কাজ করে থাকে তাহলে কী বাস চালক এককভাবে দায়ী হবে ? বাস চালকেরও তো নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় বেঁধে দেয়া আছে । আবার নির্দিষ্ট সময়ে সেখানকার ট্রিপ নিয়ে তাকে নির্দিষ্ট সময়েই ফিরতে হবে । পথে যানজটে দীর্ঘ সময় নষ্ট হওয়া , চালকের পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পাওয়ার সুযোগ ছাড়াও আরো অনেক কারণ রয়েছে যার জন্য চালকই শুধু এককভাবে দায়ী না । সেক্ষেত্রে এই চালককে যদি হত্যাকান্ডের অপরাধে চূড়ান্ত শাস্তি দেয়া হয় সেটাও কী সুবিচার হবে !

সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে সরকার , বিভিন্ন রাজনৈতিক দল , বিভিন্ন শ্রেণি পেশার নাগরিক ,পরিবহন মালিক , শ্রমিক সংগঠন, ব্যবসায়ী , গণমাধ্যম এবং অন্যান্য আরো যারা আছেন সকলে মিলে সমস্যার গভীরে না গিয়ে যদি সস্তা উপায় খুঁজতে থাকেন তাহলে যে ভুলের মধ্যে আছি আমরা সেই ভুলের সাথেই দিন যাপন করতে হবে । এসকল দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যদি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন উঠে না আসে , গণমাধ্যম যা বলে আর শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে কিছু কিছু বক্তা যা বলেন সেটাই যদি তদন্তের অংশ হয়ে যায় তাহলে আরো ভয়ংকর পরিস্থিতির জন্য আমদের অপেক্ষা করতে হবে । শুধু প্রকট সমস্যাগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে হাততালি বাজানোর রাজনীতি বাদ দিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে সেটা বাস্তবায়নের রাজনীতি শুরু করার কাজ করা দরকার , সে আমরা রাজনীতিক হই পেশাজীবী হই বা সাংবাদিক যেই হই না কেন । এভাবে আর কতদিন চলব আমরা !