নিস্তব্ধ রাতের ঢাকা। মধ্যরাত পেরিয়ে দুইটা ছুঁই ছুঁই। উত্তরায় সড়কের পাশে এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছেন রমা। ত্রিশ পেরুলেও যথেষ্ঠ সুশ্রী। সাইরেন আর গাড়ি থামিয়ে নেমে এলেন পুলিশ কর্মকর্তা ইসমাইল গাজী। গাজী থানার এসআই। কয়েক ফোঁটা পানি ছিটিয়ে দিতেই হুশ ফিরল রমার। কখন থেকে পড়ে আছেন নিজেও জানেন না। চেতনা অবশ্য পুরোটা ফিরেছে বলা যাবে না।
একটু পর রমা খেয়াল করলেন তিনি আর রাস্তায় শুয়ে নেই। তিনি ভ্যানে। পুলিশের পিকআপ ভ্যানে। এই-ই তো শুরু। নিজেকে পুলিশ হেফাজতে বুঝতে পেরেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু। গাজী সাহেব তো বিস্মিত!
চিন্তায় পড়ে গেলেন- মেয়েটা তো রাস্তায়ই পড়েছিল। আরেকটু হলে কি সর্বনাশই না ঘটে যেতে পারত। ভালো করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনলেন নাকি গাজী?
– এই মেয়ে, চিৎকার করছ কেন?
– স্যার আমাকে ছেড়ে দেন। আমি ভালো মেয়ে।
– তুমি খারাপ সেটা তো আমরা কেউ বলিনি। এত রাতে রাস্তায় পড়ে রয়েছ। তোমার ভালোর জন্যেই তো তোমাকে উদ্ধার করেছি।
চিন্তায় পড়ে গেলেন গাজী।
– আচ্ছা বলো তো, এত রাতে তোমার এই অবস্থা কেন? কি হয়েছিল তোমার? ওভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে কেন?
– স্যার, আমি টঙ্গী থেকে আসছিলাম। ট্রেন থেকে নেমে সড়কের পাশ হয়ে হাঁটছিলাম। অমনি একটি মাইক্রোবাস থেকে কজন লোক ধরে আমাকে গাড়িতে তুলল। পরের ঘটনা কিছুই জানি না।
– একি! এ তো সাংঘাতিক ঘটনা। অপহরণ কেস।
– তবে স্যার, ওদেরকে পুলিশের মতো মনে হয়েছে। গায়ে খাকি ছিল।
– ও, সে জন্যেই তুমি আমাদের ভয় পাচ্ছিলে। চিন্তা করো না। আমরা সেরকম কেউ নই। এই গাজী তোমাকে কথা দিচ্ছে, আমি থাকতে কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। কেউ গায়ে টোকাও দেবে না।
– না স্যার, আমি খারাপ মেয়ে নই। আমাকে ছেড়ে দেন প্লিজ।
– এখন নয়, রাতে থানার হেফাজতে থাকবে। সকালে তুমি ছাড়া পাবে। এখন ছেড়ে দিলে আবার তোমার বিপদ ঘটতে পারে।
থানা অবধি পৌঁছালেও ঘটনা রহস্যজনক ভাবছেন গাজী। পুলিশে খুব নামকরা মানুষটি। গাজীকে এক নামেই সবাই চেনে। যেমন দক্ষ, শিক্ষিত, তেমন সাহসীও। ভাল ইংরেজি জানেন। লন্ডন থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। আজকাল এমন মানুষ অন্তত পুলিশে যায় না। তবে যাওয়া উচিত। গাজী ভাল পুলিশের প্রতীকী।
ওদিকে রমা, সে যেন রহস্যনারী। থানায় যাবার পর থেকেই অবিরত কাঁদছে। আর ক্ষণে ক্ষণে বলেউঠছে- স্যার, আমাকে ছেড়ে দেন। আমি ভালো মেয়ে। তাতে মেয়েটি গাজীর কাছে আরো রহস্যাবৃত হয়ে উঠল।
– আচ্ছা, সত্যি করে বল তো, তুমি কে?
– স্যার, আমাকে এখনই ছেড়ে দেন। আমার থানার হেফাজতে থাকতে হবে না।
– এখন ছাড়া যাবে না। ভোরে আলো ফুটলেই তুমি চলে যেও। এখন তোমাকে ছেড়ে দিলে কোনো বিপদ ঘটলে তার দায়ভার পুলিশের ঘাড়েই চাপবে।
– আমার কোনো ক্ষতি হবে না স্যার। আপনি আমাকে এখন না ছাড়লে আমার পাঁচ-ছয় শ টাকা ক্ষতি হয়ে যাবে।
রমাকে ঘিরে জমে ওঠা রহস্যে গাজী এখন বিস্ময়ের চূড়ায়। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখলেন। খুব নিকটে কেউ নেই।
– আমি তোমাকে এক শর্তে ছাড়তে পারি, যদি তুমি সত্যি ঘটনা খুলে বলো।
– স্যার, আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। পাঁচটা ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ আমাকেই সামলাতে হয়। ১০-১২ দিন হলো এই কাজে নেমেছি। সুন্দরী বলে কেউ আমাকে বুয়ার কাজেও নেয় না। তাহলে পাঁচটা সন্তান নিয়ে আমি কি পথে বসব?
মেয়েটি বলেই চলল।
– রেল লাইনের পাশে বস্তিতে থাকি। দিনে দূরের কোনো কাজে গেলে বাচ্চারা কই যাবে? ওরা ছোট। ট্রেনে কাটা পড়ার ভয়ও তো আছে। রাতে ওদের ঘুম পাড়িয়ে তারপর বের হই। ওরা জাগার ঠিক আগেই ফিরি। বাচ্চাদের বুঝতে দিই না।
সুন্দরী রমাকে নিয়ে এতক্ষণ যে মানুষটি রহস্যের জালে আঁকড়ে ছিলেন, সেই গাজী চুপষে গেলেন। মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। গাজী নিশ্চুপ।
২,
এসআই ইসমাইল গাজী ঢাকার উত্তরা থানায় কর্মরত। তাঁর সঙ্গে এবারই প্রথম দেখা। খুবই মিশুক প্রকৃতির। ঘণ্টা দুয়েকের আড্ডায় বেশ গল্প হলো। রাত দুইটার কাহিনিটি গল্প নয়, বাস্তব। রমার ঘটনা বলতে গিয়ে গাজী আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন।
– আমি হয়তো পুলিশ কর্মকর্তা। আমার দায়িত্ব, এত রাতে মেয়েটিকে থানার হেফাজতে রাখা। পরদিন আইনি ব্যবস্থা নিয়ে তাকে আদালতে সোপর্দ করা। কিন্তু তাতে যে মেয়েটির পরদিনের হাসি মুছে যাবে! তার বাচ্চারা অনাহারে থাকবে। একজন মানুষ হিসেবে আমি কি করব? পেশাগত দায়িত্ব পালন, নাকি আর্তমানবতা? কোনটা আগে?
৩,
নচিকেতার কথা মনে পড়ল। তিনি গানে বলেছেন, 'যে মেয়েটা রোজ রাতে, বদলায় হাতে হাতে/ তার অভিশাপ নিয়ে চলাই জীবন'।
আসলে অভিশাপ নিয়ে চলছে কে? যাদের হাতে রমা রোজ রাতে বদলায় তারা, নাকি সরকার? অভিশাপটা আসলে কার ঘাড়ে?
ধরুন, রমা রাতে হাতে হাতে বদলানোর মত ঘৃণ্য কাজে যায়নি। ট্রেনের মৃত্যু থেকে বাচ্চাদের বাঁচাতে দূরের কোথাও কাজেও যেতে পারছে না। বাধ্য জননী ধরুন পথে বসে পড়ল। সেখান থেকে তাকে টেনে তুলবে কে? নিয়তির ফেরে সন্তান-সন্তুতি নিয়ে রাস্তায় তারা বসে পড়ছে বলেই এত এত বস্তি আমাদের চোখ ফেরায় না। রমা বস্তিজীবনে ভালই আছেন। তার সন্তানেরা আজ অভূক্ত থাকে না। একেবারে ছোট্ট শিশুটির ঘুম ভাঙে মায়ের বুকেই।
রাস্তার পাশে খোলা ফুটপাতে কিংবা ছোট্ট ছাউনির নিচের জীবন কেমন- সন্ধ্যার পর রাস্তায় বেরুলেই কেবল বোঝা যায়।
আমাদের কত বড় বড় অর্জন। আমরা গর্বে বুক ফুলাই। সম্ভাবনার দেশের নাগরিক আমরা ষোল কোটি। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। আমরা এখন মধ্যম সারির দেশের পথে। অর্থনীতির সব সূচকেই ক্রমাগত উন্নতি। তবু কেন বস্তিবাসীর জীবন বদলায় না? কেন বস্তিজীবনের অন্ত মেলে না?
এত সম্ভাবনার দেশেও আমরা আজ ভাল নেই। আপনি অভিযোগ নিয়ে থানায় যান। ঘুষ চাই। ভিটেমাটি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সেটি রক্ষা করতে ভূমি অফিসে যান, সেখানে তো উপরি ছাড়া কথাই নেই। আদালতে যান, ঘুষ। সরকারি চাকরি পেতে চান, সেখানেও ঘুষ। কোথায় নেই ঘুষ? স্থান-কাল-পাত্রভেদে ঘুষের প্রকরণ আছে। ঘুষের হরেক রকমের নামও আছে। ছোট ঘুষ। বড় ঘুষ। ঘুষাঘুষির জীবনে আমরা আজ অতিষ্ঠ।
ধরুন, আপনি থানায় গেছেন একটা যৌক্তিক অভিযোগ নিয়ে। অথচ আপনি ভয়ে আছেন। প্রস্তুতি তো আছেই, ওই পুলিশ অফিসারকে খুশি করবেন। এমন না হয়ে আপনি কি অন্যরকম হতে পারেন না? আপনি কি তাকে বলতে পারেন না যে, গত মাসে যে বেতনটা পেয়েছেন তাতে আমার মতো শ্রমিকের রক্তমাখা কর আছে…।
না, আপনি সেটা বলতে পারছেন না। কারণ, বললে উল্টো বিপদও আছে। আপনি ন্যূনতম হলেও ১৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন হিসেবে আদালত অবধি গড়াবেন। এটা আপনার ঘুষাঘুষিতে না জড়ানোর 'উপহার'।
এত আশংকার মাঝেও আপনাকে বদলাতে হবে। যে রীতি আজ সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে, তাকে ভেঙে দিন। নিজের মতো করে নতুন রীতি চালু করুন। প্রথমে আপনি সচেতন হউন। এক, দুই করে একদিন সবাই যখন বদলে যাবে- দেখবেন দেশটা ঠিকই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। দেশের মেরুদণ্ডই যখন সোজা হবে না, আপনি নিজেকে কোথায় দাঁড় করাবেন? কারণ, দেশ তো লুটিয়ে পড়েছে সেই কবে থেকে। শুধু লুটিয়ে পড়েছে বললে ভুল হবে, এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। ঠিক রাত দুইটায় রাস্তার ধারে যেভাবে পড়েছিলেন রমা। রমা যেন আমাদের সোনার বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি।
লেখক : সাংবদিক, ঢাকা
news.joynal@gmail.com