শিশুর অনিরাপদ পৃথিবী!

জয়নাল আবেদীন
Published : 15 Oct 2015, 04:04 AM
Updated : 15 Oct 2015, 04:04 AM

আরব সাগরের পারে একে একে অনেকগুলো মুসলিম দেশ। অবস্থানের দিক থেকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, ইউএই, ওমান, ইয়েমেন, সিরিয়া, তুরস্ক একটির সঙ্গে অন্যটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। অথচ মুসলমানদের একতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সেটা বলাবাহুল্য।

দেশে দেশে যুদ্ধ লেগে আছে। গাজার ওপর ইসরাইলের আক্রমণের খবর তো পুরোনো। নতুন খবর হলো- গাজার শিশুদের ওপর এবার গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরাইল! ইতোমধ্যে শিশুদের ওপর গুলি বর্ষণের মতো বর্বরতা শুরু হয়েও গেছে। গত ১০ অক্টোবর দুজন শিশু গুলিতে নিহত হয়েছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানের লাখ লাখ মানুষ প্রাণে বাঁচতে চাইছে। মাতৃভূমির মায়া সিন্দুকে ভরে তারা ছুটে চলেছে জীবন হাতে। তুরস্ক উপকূল হয়ে ইউরোপের পথে অভিবাসীর দল। সাম্প্রতিক সময়ে তিন বছরের শিশু আয়লান কুর্দির মরদেহের ছবি তো সমগ্র পৃথিবীকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। সে বিষয়ে বেশি কিছু বলার নেই।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের বারুদের তেজ থেকে বাঁচতে কিংবা একটু স্বচ্ছলতার আশায় নিজের দেশ ছেড়ে শরণার্থী হলেও তাদের জায়গা পেতে এতটা কষ্ট করতে হচ্ছে। মরতে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষকে। হিসাব করলে দেখা যায়, পৃথিবীর সবগুলো মানুষ যদি চীনে গিয়ে বসবাস শুরু করেন, তবে ওই দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব হবে ৭৫১ (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে), আমেরিকায় গেলে ৭৪৮, কানাডায় গেলে হবে ৭২১ এবং রাশিয়ায় গেলে হবে মাত্র ৪২২। অথচ মাত্র কয়েক লাখ অভিবাসী ধুঁকে ধুঁকে মরেন!

সিরিয়ার আয়লান কুর্দির নিথর দেহের ছবিটি কিন্তু মৃত্যুর মিছিল থামিয়ে দিতে পারেনি। গত মাসেও গ্রীস উপকূলে শতাধিক অভিবাসী বহনকারী একটি নৌকা ডুবেছে। সম্ভবত ওই নৌকার অর্ধেকই প্রাণ হারিয়েছেন, যেখানে শিশুর সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ২৫!

মাগুরায় মায়ের পেটে থাকা বাচ্চা গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে শোরগোল উঠেছে। সেই ফাঁকে কিন্তু আমরা মিস করেছি ফিলিস্তিনের আরেক মর্মান্তিক ঘটনা। ইসরাইলের বিমান হামলায় এমন একজন নারী প্রাণ হারিয়েছেন, যার সঙ্গে থাকা তিন বছরের সন্তান তো মারা গেছেই, পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগই হারিয়েছে ওই নারীর পেটে থাকা আরেক শিশু!

যুদ্ধের শিকারে কত শত শিশুর জীবনের বাতি অসময়ে নিভে যাচ্ছে, সেই হিসাব নেই। একটা ধারণা অবশ্য দিতে পারি। চলতি বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে ঢুকেছে অন্তত চার লাখ ৩০ হাজার অভিবাসী। যাত্রাপথে নৌকাডুবেই মারা গেছে দুই হাজার ৭৪৮ জন। এদের মধ্যে বড় একটি সংখ্যা শিশু। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী প্রত্যাশী আড়াই হাজারের বেশি শরণার্থী প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য শিশু।

যুদ্ধের কথা বাদ দিলে আসে খাদ্যের অভাবে মৃত্যু! ভুল লিখিনি। খাদ্যের অভাবেই মরছে লাখ লাখ শিশু। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ১২ অক্টোবর সোমবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, সারা বিশ্বে শুধুমাত্র খাদ্যের অভাবেই বছরে গড়ে ৩১ লাখ শিশু মারা যায়। জার্মান দাতব্য সংস্থা ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফ, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) এবং কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, 'বিশ্বের ৫২টি উন্নয়নশীল দেশে গৃহযুদ্ধ ও বেসামরিক অস্থিতিশীলতার কারণে খাদ্যের অভাব মারাত্মক ও উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতার কারণে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও চাদের পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া সিরিয়া, ইরাক ও দক্ষিণ সুদানে সহিংসতার কারণে বড় রকমের খাদ্য-সংকট সৃষ্টি হয়েছে।' অভাবটা খাদ্যের হলেও এটিকে আরো বেশি প্রভাবিত করে তুলছে যুদ্ধ।

যুদ্ধ আর খাদ্য ছাড়া পুষ্টিহীনতা এবং অন্যান্য কারণেও শিশুদের মৃত্যু হয়। নানা রকমের রোগে ভুগে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতিদিন ১৬ হাজার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে বলে প্রতিবেদন ইউনিসেফ-এর। এদের মধ্যে আবার ৪৫ ভাগ শিশুর বয়স এক মাসই পূর্ণ হয় না। সেদিক থেকে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে বলেই জানাল সেভ দ্য চিলড্রেন। এ দেশে প্রতি হাজারে ৪১ জন শিশু মারা যায় নানা কারণে।

বিশ্বময় শিশুদের প্রতি নির্মমতা বেড়েই চলেছে। নইলে একজন আয়লান কুর্দির নিথর দেহ দেখার পর তো অভিবাসী সংকট শব্দটি জাদুঘরে পৌঁছ যাবার কথা। চীন, আমেরিকা, কানাডা, রাশিয়ার মতো দেশে যখন থাকার মতো মানুষ নেই, সেখানে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের স্বল্প সংখ্যক মানুষগুলো কেন মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে পাবে না? আর, গৃহপালিত পশুর জন্য লাখ লাখ ডলার খরচ করতে পারা পৃথিবীতে কেন খাদ্যের অভাবেই জীবন হারাবে ৩১ লাখ শিশু?

লেখক, সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com