সাইফা পৃথিবীর আলো দেখেছে ১৫ মাস হয়ে গেলো। অথচ তার মায়ের তলপেটের ব্যাথা আজো কমেনি! ১০ মাস পেটে থাকার পর নাড়িছেঁড়া শিশুটি তার ঘরে আলোকিত সকাল এনে দেয়নি। দিয়েছে মধ্যরাতের ঘোর অমানিশা!
সোয়া বছরের শিশু একটি সংসারের চোখের মনি। এই বয়সের শিশু ঘরে থাকলে অভাবও ভুলে থাকা যায়। এরাই শীতল করে তুলতে পারে অনেক কঠিন হৃদয়। আনন্দে মেতে ওঠার সময় কী আর বিভেদ মনে থাকে?
কিন্তু ফারজানার সুন্দর জীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার পেছনে নাকি ১৫ মাসের শিশুটিই দায়ী!
সাইফা ইসলাম আম্মি ডাকতে শিখে গেছে! এর দিকে ওর দিকে তাকাতেও পারে। শুধু পারে না কাউকে ছুঁতে। পারে না হামাগুড়ি দিতে! মাথা তুলতে পারে না, পা নাড়তে পারে না! শোয়া থেকে বসতেও পারে না। দিনদিন বেঁকে যাচ্ছে ওর কোমল চারটি হাত-পা!
এখনই শিশুটিকে প্রতিবন্ধী ভাবতে শুরু করেছে সবাই! জানি না, ওর ভবিষ্যৎ কি! চিকিৎসক নাকি ওর মধ্যে প্রতিবন্ধিতার বেশকিছু লক্ষণ পেয়েছেনও! তবে ভরসাও দিয়েছেন- সঠিক চিকিৎসা পেলে স্বাভাবিক পথেই বেড়ে উঠতে পারে শিশুটি।
সত্যিই যদি এই শিশুটি প্রতিবন্ধী হয়ে যায়? এর শতভাগ দায় আমি ওর বাবাকে দিতে পারছি না। কিছুটা দিচ্ছি এই সমাজের যন্ত্রণাময় শৃঙ্খলকে। জাগতিক রীতিকে। শত শত বছর ধরে চলমান একটি ব্যাধিকে!
একটি স্টীলের আলমারির গল্প শুনবেন?
– গল্প নয়, সত্যি।
এককালের যৌতুক নামটি হালের আধুনিকতায় 'উপহার'-এ রূপ পেয়েছে। এটি কারো অজানা নয়। ফারজানার বিয়ের সময় দেওয়া 'উপহারে' সাইফুলের পরিবার খুশি হয়েছিল কি না জানি না। তবে বিয়ের পরও কিছু একটা পাওয়ার তাড়া ছিল এই ঘরে।
সাইফুলের অনেক দিনের আবদার- বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে একটি স্টীলের আলমারি চাই। স্বামীর এই আবদার মেটাতে পারেননি ফারজানা। এ নিয়ে স্বামী-শ্বাশুড়ির কম নির্যাতন সইতে হয়নি মেয়েটিকে।
মায়ের পেটে তখন সাইফা আট মাসের নবজাতক। আলমারি না পাওয়ার ক্ষোভে বেঁধে যায় তুমুল বিতণ্ডা। একপর্যায়ে ফারজানার তলপেটে কষিয়ে এক লাথি মারেন স্বামী। ভীষণ ব্যাথায় কুঁকড়ে যায় মেয়েটি!
পেটের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে ওঠে। বাচ্চা তো আর নড়ে না! পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই বুঝি নিভে গেল নবজাতক! চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে দুদিন পর হাসি ফুটলো ফারজানার মুখে।
তার পেটের ব্যাথা কোনমতেই কমে না। সঠিক সময়ে একদিন পৃথিবীর মুখ দেখে ফুটফুটে সন্তান। নাম রাখা হয় সাইফা। আলমারি না পাওয়ার বেদনা ভুলে ঠিকঠাকই চলছিল। বাধ সাধে কিছুদিন পর।
শিশুটি প্রতিবন্ধী- ডাক্তারের মুখে এমন কথা শুনে নির্যাতন ফেরে আবারও। প্রতিবন্ধী মেয়ে জন্ম দেওয়ার অপরাধে স্ত্রীকে তালাক দিতে চায় সাইফুল! ফারজানার দুঃখ বুঝি আর যায় না।
কী অদ্ভুত ঘটনা! মাত্র একটি স্টীলের আলমারি না পাওয়ার দহন ওই পাষাণ স্বামীকে এতটাই পুড়িয়েছে যে, ফলস্বরূপ একটি শিশু হয়ে যাচ্ছে প্রতিবন্ধী! ভেঙে যাচ্ছে সাজানো সংসার!
শিক্ষিতা মেয়েটির সময় কাটে করেরহাট ইউনিয়নে বাবার বাড়িতে। বাবা প্রবাসে। তাতে কি! ভীতু বাবার মুখে কলুপ! বেয়াই বাড়ির সঙ্গে নাকি আওয়ামী লীগ নেতাদের দহরম! থানা-পুলিশ করতে গেলে যদি কিছু হয়ে যায়?
ফারজানা এখন উভয় সংকটে। একটি সাদা কাগজে তালাকনামা লিখে পোস্ট করেছে স্বামী। তার বাবাও চায় 'প্রতিবন্ধী' নাতনিকে বিদায় করে মেয়েকে নতুন করে বিয়ে দিতে! তাতেই নাকি সমাধান দেখেন তারা!
প্রতিবন্ধী বলে মাত্র ১৫ মাসের শিশুটিকে গ্রহণ করছে না কেউই। তাহলে অবুঝ শিশুটি যাবে কোথায়? একবার নাকি দাদি নিজেই গলা চেপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল শিশুটিকে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে সেবার।
তালাকের বিষয়টি যদি চূড়ান্ত পরিণতি নাগাদ গড়ায়, আইন মতে সাইফার জায়গা হবে বাবার বাড়ি। কিন্তু সে বাড়িতেই তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল!
ফারজানার প্রশ্ন হলো- যারা তার বুকের ধনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল, তারা কী আদৌ ওকে সারিয়ে তুলতে চাইবে?
নাকি ফোটার আগেই ঝরে যাবে একটি ফুল?
সাইফুলের বক্তব্য :